প্রথম জন ব্যারি রিচার্ডস। বয়স ৬৯।
দ্বিতীয় জন জেফ টমসন। বয়স ৬৪।
ব্যাট-বল ধরার বয়সই নেই এঁদের। বিশ্বকাপের সঙ্গে কোচ বা মন্ত্রণাদাতা, কোনও ভাবেই জড়িত নন। অথচ বিশ্বকাপের পাঁচ নম্বর দিনে এঁরাই তোলপাড় ফেলে দিয়েছেন ক্রিকেটমহলে।
টমসন বুধবার বলেছেন, “হ্যাঁ ব্যাটসম্যানের রক্ত আমি ক্রিকেট উইকেটে দেখতে চেয়েছি তো। ওই হেলমেট পরেও ন্যাকা-ন্যাকা, সখী-সখী মনোভাব আমার একেবারেই পছন্দ নয়। একটু গায়ে লাগল কী কান্না শুরু হয়ে গেল। কী চ্যানেল সেটা নিয়ে সোপ অপেরা বানাতে বসে গেল।” সাধারণ ভাবে কথাগুলো বললে কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু মনে করা হচ্ছে টমসন কথাগুলো বলেছেন ফিল হিউজের মৃত্যু সংক্রান্ত ক্লার্ক এবং চ্যানেল নাইনের প্রতিক্রিয়ায়।
টেস্টে দুশো উইকেট নেওয়া তীব্র গতিসম্পন্ন টমসন আরও বলেছেন, “ব্যাটসম্যান দু’একটা মার খেলে, তাদের দাঁত-টাঁত পড়লে তাদেরও জাত বাড়ে। তাদের নাম হয়। এই যে ডেভিড লয়েড! ওকে যখন প্রতি বার দেখি আমার মনে হয়, ব্যাটাচ্ছেলের আমাকে আজকের দিনে ও যা রোজগার করে তার একটা অংশ রয়্যালটি দেওয়া উচিত। কে চিনত নইলে ওকে? এই যে কোচিং-টোচিং করেছে, চাকরি পেয়েছে, আজ কমেন্ট্রি করে, সবই তো আমার কাছে মার খেয়ে করা নামে। নইলে ক্রিকেটার হিসেবে ও কীই বা করেছে?”
অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত ক্রিকেট চ্যানেলকে দেওয়া ইন্টারভিউয়ে টমসন তাঁর আরও একটা অভিজ্ঞতার কথাও বলেছেন। দ্বিতীয় প্রসঙ্গ— যা জীবনে শেয়ার করেননি। বিশ্বকাপের ভরা বাজারে ফাঁস করলেন ডন ব্র্যাডম্যানকে এক বার বল করার সুযোগ তাঁর হয়েছিল।
কেউ জানতই না, ক্রিকেট যুদ্ধেও যে কখনও মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন টমসন আর ব্র্যাডম্যান!
এটা নাকি ১৯৭৮ সালের কথা। ব্র্যাডম্যান তখন সত্তর এবং ত্রিশ বছরের উপর ক্রিকেট থেকে অবসৃত। অ্যাডিলেডেরই ওঁদের কমন বন্ধুর বাড়িতে খেতে গিয়ে দু’জনে দেখা। আর ঠিক হয় ওই বাড়িরই প্রশস্ত লনে ডুয়েলটা হবে। ডন একেবারেই ধরাচূড়ো ছাড়া। প্যাডও পরেননি। টমসনের লেগ স্পিনকে তিনি গ্লাভস ছাড়াই বাইরে ফেলে দেন। তার পর উপস্থিত বাকি বোলাররা বল করতে শুরু করেন। এমন নাকি তাঁদের মেরেছিলেন ব্র্যাডম্যান যে আজও টমসন ভুলতে পারেন না। এ দিন বললেন, “কেউ যদি বলে ব্র্যাডম্যান কেমন ব্যাটসম্যান ছিলেন, সবার ওপরে ছিলেন কি না আমার সন্দেহ হচ্ছে, তা হলে আমার কাছে যেন তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়!”
এমন চমকপ্রদ, আজ পর্যন্ত অপ্রকাশিত ঘটনার পরেও টমসনের রক্ত সম্পর্কিত উদ্ধৃতি বেশি সাড়া ফেলছে।
আর তিনি ব্যারি রিচার্ডস তো ভারতের সঙ্গে সম্মানযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান ক্রিকেটমহলের মুখে হাসি ফিরিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে, ক্রিকেট বলের চামড়া তোলা আইনসিদ্ধ হোক!
বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোয় যেমন হুড়হুড় করে রান হচ্ছে তাতে আতঙ্কিত রিচার্ডস বলেছেন, “আজ ৩০০ হচ্ছে। খুব শিগগিরই এক দিন ৫০০ হবে ওয়ান ডে-র এক ইনিংসে। কিন্তু তাতে কী লাভ? বোলাররা তো তা হলে আস্তে আস্তে মরেই যাবে ক্রিকেট থেকে। কেউ বোলার হতে চাইবে না।” এই ভাঙন ঠেকাতে রিচার্ডসের পরামর্শ— বলের চামড়া তোলাটা আইনসিদ্ধ করা হোক যাতে বেশি রিভার্স সুইং হয়। যাতে ব্যাটসম্যানের সামনে সমস্যা বাড়ে। পাকিস্তান দীর্ঘ দিন ইমরানের মাধ্যমে একই দাবি বিশ্ব ক্রিকেট বাজারে জানিয়ে যাচ্ছে। কেউ তাদের পাত্তাও দেয়নি।
এ বার ব্যারি রিচার্ডসের মতো সম্মানীয় ব্যক্তি একই কথা বলছেন। তা-ও বিশ্বকাপের ভরা ক্রিকেট বাজারে। এটা পাকিস্তানের কাছে প্রায় রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হতে দেখার দিন।
রিচার্ডস অবশ্য পাকিস্তানের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়, খুব খোলা ভাবেই বোলারদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন। চার টেস্টে ৭২ গড়সম্পন্ন দক্ষিণ আফ্রিকান মনে করেন, রিভার্স সুইং একটা আর্ট। বলের চামড়া তুললেও যার ওটা করাবার ক্ষমতা নেই, সে সুইং করাতে পারবে না। তাই এটাকে আইনসিদ্ধ করলে গেল-গেল রব উঠবে না। বরং নিয়ম বদলানোটা প্র্যাক্টিক্যাল হবে। রিচার্ডস আরও বলেন, “ব্যাটগুলো কী ভয়ানক চেহারা নিয়েছে! খেলাটার ব্যালান্সই তো তাতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আগে সুইট স্পট থাকত পঞ্চাশ পেন্সের সাইজের। এখন সেটা অনেক বেড়ে গেছে। ব্যাট বেশি চওড়া হয়ে গিয়েছে। এগুলো আর না মেনে অবিলম্বে সংশোধন ঘটাতেই হবে।”
রিচার্ডসের মতে ব্যাট তৈরির প্রযুক্তি নিয়ে ভাবতে হবে। ব্যাটসম্যানকে এমন গদা হাতে ব্যাট করার সুযোগ দিলে হবে না। ব্যাটের চওড়া কমাতে হবে। ব্যাটের ওপর সুইট স্পটের সংখ্যা কমাতে হবে। তিনশো রান কয়েকটা ম্যাচে ওঠায় এমন একটা হইহই কাপ বাজারে শুরু হয়েছিল যে তার বিরুদ্ধে নিজের অসন্তুষ্টি তীব্র ভাবে ব্যক্ত করলেন ব্যারি। অনেকের ধারণা, গোটা বিশ্বে এ বার তাঁর এই সব বৈপ্লবিক মন্তব্য নিয়ে সাড়া পড়বে। লোকে অন্তত ভেবে দেখবে— কী বলতে চাইছে!