মুগ্ধ: ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের নয়নের মণি ছিলেন বিজয়ন। ফাইল চিত্র
কলকাতা ময়দানে আমার অভিষেক সবুজ-মেরুন জার্সিতে। শহরে পা দেওয়ার পর থেকেই শুনছিলাম, ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকদের থেকে সাবধান থেকো। ওরা ভয়ঙ্কর। নানা ভাবে হেনস্তা করতে পারে।
আমি একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। একে আমার বয়স কম। তার উপরে কেরলের ত্রিশূর থেকে প্রথম বার কলকাতার কোনও ক্লাবে খেলতে এসেছি। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমার ভুলটা ভেঙে গেল। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরাও ভালবাসা উজাড় করে দিলেন। মোহনবাগান মাঠে অনুশীলনের পরে কখনও হাঁটতে হাঁটতে ধর্মতলা চলে যেতাম। কখনও আবার ময়দানে মার্কেটে বুট কেনার জন্য যেতাম। এ ছাড়াও অবসর সময়ে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা আমাকে দেখলেই ঘিরে ধরে পরের মরসুমে তাঁদের ক্লাবে খেলার অনুরোধ করতেন। আমিও হেসে ওদের বলতাম, নিশ্চয়ই চেষ্টা করব।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্তারাও আমাকে নেওয়ার জন্য মরিয়া ছিলেন। পল্টুদা (দীপক দাস) নিতুদা (দেবব্রত সরকার) আমাকে ইস্টবেঙ্গলে সই করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তত দিনে আমি মোহনবাগানের সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেছি। তা ছাড়া আমার ভাষা সমস্যা ছিল। তবুও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম লাল-হলুদ কর্তাদের আন্তরিকতায়। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের ফুটবলার হওয়া সত্ত্বেও আমার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রেখেছিলেন। ইস্টবেঙ্গলে সই করিনি বলে একবারের জন্যও ক্ষোভ জানাননি। পরম আত্মীয়ের মতো মিশতেন। অবশেষে ২০০১ সালে সফল হলেন ওঁরা।
ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে আমার চুক্তির কাহিনিও কম রোমাঞ্চকর নয়। এফসি কোচির হয়ে খেলতে বেঙ্গালুরুতে গিয়েছি। ইস্টবেঙ্গলও তখন ওখানে ছিল। এক রাতে আমাকে ও জো পল আনচেরিকে একটি হোটেলে নিয়ে গেলেন নিতুদা। অনেকেই হয়তো শুনলে অবাক হবেন, কোনও অগ্রিম ছাড়াই চুক্তিতে সই করে দিয়েছিলাম আমরা। কারণ, মনে মনে আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, অন্তত এক বছর লাল-হলুদ জার্সি গায়ে খেলবই। ইস্টবেঙ্গলে প্রথম দিনটা এখনও ভুলব না। অনুশীলন দেখতেও গ্যালারি ভরে গিয়েছে। আমি ও আনচেরি মাঠে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন চিৎকার করলেন ওঁরা, মনে হচ্ছিল যেন ডার্বিতে গোল করেছি। বরাবরই ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের ভালবাসা আমি পেয়েছি। সই করার পরে তা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। ক্লাব তাঁবু থেকে বেরোনো মাত্র জনতা আমাদের ঘিরে ধরল। কেউ অটোগ্রাফ নিচ্ছেন। কেউ আনন্দে জড়িয়ে ধরছেন। কয়েক জন তো অতি উৎসাহে আমাদের পায়ের উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। একটাই আবদার, ডার্বিতে গোল করতেই হবে। আমি আর আনচেরি প্রমাদ গুনলাম। ডার্বিতে ব্যর্থ হলে হয়তো এঁরাই আমাদের আক্রমণ করবেন। দুশ্চিন্তা নিয়েই বাড়ি ফিরেছিলাম প্রথম দিন।
যদিও ডার্বি নিয়ে কোনও দিনই আমার উদ্বেগ হয়নি। মোহনবাগানে প্রথম বছরেও তা হয়নি। ডার্বির আগে থেকেই দেখতাম, কলকাতার ফুটবলারদের শরীরী ভাষাই বদলে গিয়েছে। আমি বরাবরই ড্রেসিংরুমে মজা করতাম সকলের সঙ্গে। কিন্তু বড় ম্যাচের আগে তা করলেই কলকাতার ফুটবলারেরা রেগে যেত। আমাকে বলত, ‘‘ডার্বির আগে অন্তত সংযত হও। এই ম্যাচটার উপরেই ফুটবলারদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। ডার্বি কাউকে নায়ক বানায়। কাউকে নায়কের আসন থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়। তাই ম্যাচটা নিয়ে ভাবো।’’ আমার মনে প্রশ্ন জাগত, আলাদা করে কী ভাবব? এক জন ফুটবলার মাঠে নেমে নিজেকে উজাড় করে দিতে দায়বদ্ধ। সব ম্যাচই তাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমি অন্তত কখনও ডার্বির আগে বিশেষ কোনও প্রস্তুতি নিইনি। মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল— যখন যে দলে খেলেছি, আমার দর্শনের পরিবর্তন হয়নি। বরং ডার্বির আগের রাতে আমি সিনেমা দেখতে যেতাম। কখনও আমার সঙ্গে থাকত শরাফ আলি, ভি পি সত্যেন। কখনও আবার আনচেরি আমার সঙ্গী হত। সব সময় ফুরফুরে মেজাজে থাকতাম। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা রীতিমতো চিন্তায় ফেলে দিল।
আমার আশঙ্কা যে সম্পূর্ণ ভুল, তা প্রমাণিত হতে খুব বেশি দিন লাগেনি। যত দিন ইস্টবেঙ্গলে খেলেছি, কখনও সমর্থকেরা আমাকে অসম্মান করেননি। বরং, ব্যর্থ হলে উৎসাহ দিয়েছেন। বারবার বলেছেন, আমরা তোমার পাশে আছি বিজু ভাই। তুমি কোনও চিন্তা কোরো না। আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম ওঁদের ব্যবহারে। মনে মনে খুব আক্ষেপ হত, আরও আগে কেন ইস্টবেঙ্গলে খেলতে এলাম না! তা হলে হয়তো আমার জীবনটাই অন্য রকম হত।
এখনও সেই আফসোসটা মনের মধ্যে থেকে গিয়েছে। আমার খেলোয়াড় জীবনের সেরা সময়টা কেরল পুলিশ, মোহনবাগান ও জেসিটি-তে কেটেছে। ইস্টবেঙ্গলে যখন সই করেছি, তখন অবসরের কথা মনে মনে ভাবতে শুরু করে দিয়েছি। বয়সটাও বেড়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম, আগের তুলনায় ক্ষিপ্রতা ও গতি কমে গিয়েছে। তবে আমার স্বভাব কিন্তু একই রকম ছিল। সুভাষ ভৌমিক তখন কোচ ছিলেন। প্রাক্-মরসুম প্রস্তুতি শিবির করেছিলেন কলকাতার বাইরে। এক মাস দারুণ কাটিয়েছিলাম। সুভাষ ভৌমিক এখনও আমাকে নিজের ছেলের মতো ভালবাসেন। কিন্তু ওঁকেও অতিষ্ঠ করে তুলেছিলাম। দলের অন্যেরা খুব উপভোগ করত। ক্লাব কর্তারাও কখনও কিছু বলেননি। সমর্থকদের মতো ওঁরাও আমাকে অসম্ভব ভালবাসেন।
গোকুলম এফসি-র বিরুদ্ধে আই লিগের শেষ ম্যাচ খেলতে কোজ়িকোড় গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। ত্রিশূর থেকে ঘণ্টা তিনেক লাগে। আমি পুরো পরিবার নিয়ে ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম। ইস্টবেঙ্গল ম্যাচটা জিতেও আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। সবার মন খারাপ।
তার মধ্যেও ক্লাব কর্তারা টিম হোটেলে আমাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি মোহনবাগানে আগে খেললেও ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে সম্পর্কটা একদম আলাদা। ময়দানে লাল-হলুদ ক্লাব তাঁবুতে ঢুকলে মনে হয়, নিজের বাড়িতেই এসেছি। এখনও সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। কলকাতায় ক্লাবের শতবর্ষের অনুষ্ঠানে আবার সবার সঙ্গে যোগাযোগ হবে ভেবেই দারুণ আনন্দ হচ্ছে।
(সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন)