(বাঁ দিকে) শাকারি রিচার্ডসন। মজিদ বিসকর (ডান দিকে)। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
শাকারি রিচার্ডসন আর মজিদ বিসকর একই পৃথিবীর বাসিন্দা। আবার শাকারি রিচার্ডসন এবং মজিদ বিসকর একই পৃথিবীর বাসিন্দা ননও বটে। প্রথম জনের জীবনগাথায় লেখা থাকবে মাদকাসক্তির কারণে নির্বাসিত হয়েও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে নাটকীয় প্রত্যাবর্তন। দ্বিতীয় জনও মাদকের কবলে পড়েছিলেন। ফিরতে পারেননি। শাকারি রিচার্ডসনকে নিয়ে হইচই পড়েছে সারা দুনিয়ায়। কলকাতা ময়দান থেকে হারিয়ে গিয়ে মজিদ বিসকর বেঁচে ছিলেন শুধু স্মৃতিতে।
শাকারি ১০০ মিটার দৌড়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। এই গ্রহের দ্রুততম মহিলা। গত বছর বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ১০.৬৫ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। যোগ্যতা অর্জন করেছেন আসন্ন প্যারিস অলিম্পিক্সেও। মাদকাসক্ত শাকারিকে পুলিশ ধরেনি। ধরেছিল বিশ্ব ডোপ বিরোধী সংস্থা (ওয়াডা)। এক মাসের নির্বাসন তাঁর জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছিল অলিম্পিক্স পদক জয়ের স্বপ্ন। সেই অভিজ্ঞতা তিনি ভুলতে পারেননি। কিন্তু ধারাবাহিক সাফল্যে নিজের অতীত ভুলিয়ে দিতে পেরেছেন ক্রীড়াবিশ্বকে।
মারিজুয়ানা (শুকনো নেশা, বাংলায় যাকে বলে পাতা খাওয়া) সেবনের অপরাধে ২০২১ সালের ৬ জুলাই শাকারিকে নির্বাসনের শাস্তি শুনিয়েছিল ওয়াডা। ২৮ জুন থেকে ২৮ জুলাই— এক মাসের নির্বাসন। তার মধ্যে টোকিয়ো অলিম্পিক্সের ১০০ মিটারের ইভেন্ট হয়ে গিয়েছিল। বাকি ছিল রিলে রেস। কিন্তু আমেরিকার অ্যাথলেটিক্স কমিটি সেই দল থেকেও বাদ দিয়েছিল শাকারিকে। অলিম্পিক্সে নামতে পারেননি শাকারি। সেই সিদ্ধান্ত মেনে তিনি জানিয়েছিলেন, অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জনের কঠিন লড়াই এবং মায়ের মৃত্যুর খবর জানতে পেরে নেশা করেছিলেন। ঠাকুমা এবং এক কাকিমার কাছে বড় হওয়া শাকারি প্রথমে জানতেন না জন্মদাত্রীর মৃত্যুসংবাদ। এক সাংবাদিক তাঁকে জানান সে কথা। বিষণ্ণ, অবসাদগ্রস্ত অ্যাথলিট সে রাতেই মারিজুয়ানায় ডুবে যান।
মহিলাদের ১০০ মিটারে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শাকারি রিচার্ডসন। —ফাইল চিত্র
শাকারির নির্বাসন নতুন বিতর্কের জ্বালামুখ খুলে দিয়েছিল। উত্তাল হয়ে উঠেছিল আমেরিকা। বিখ্যাত ক্রীড়াবিদেরা প্রশ্ন তোলেন, মারিজুয়ানা সেবন করা কি আদৌ ‘ডোপিং’? ক্রীড়াবিশ্বে ‘ডোপ’ করানো হয় পারফরম্যান্স বৃদ্ধির কারণে। তা সাধারণত বিভিন্ন বলবর্ধক ওষুধই হয়ে থাকে। মাদক কি কারও পারফরম্যান্স বৃদ্ধি করতে পারে? সেই প্রশ্নের মুখে গাঁজা বা অন্যান্য শুকনো নেশা নিয়ে আমেরিকায় প্রচলিত আইন সংশোধনের দাবি ওঠে। আসরে নামেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনিও স্পষ্ট বলেন, ডোপিং-বিরোধী আইন বদলানো দরকার। আমেরিকার ডোপ বিরোধী সংস্থা অবশ্য জানিয়ে দেয়, তাদের একার পক্ষে ওই আইন বদলানো অসম্ভব। কারণ, বিশ্বের অনেক দেশেই মারিজুয়ানা ‘নিষিদ্ধ’। চাপের মুখে ওয়াডা জানায়, গাঁজা এবং মারিজুয়ানা নিয়ে যে আইন রয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখা হবে।
সে তো গেল আইনের কচকচি। যা আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। চলতেই থাকবে। সেই হিসেবনিকেশে যা লেখা থাকবে না, তা হল মানুষের জয়ের কাহিনি। যাবতীয় প্রতিকূলতা কাটিয়ে নাটকীয় প্রত্যাবর্তনের বিজয়গাথা। যা করে দেখিয়েছেন শাকারি।
কিন্তু ওই যে, শাকারির পৃথিবী আর মজিদের পৃথিবী আলাদা!
ইরান থেকে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা এবং সেই সূত্রে কলকাতা ময়দানে খেলা সম্ভবত সবচেয়ে প্রতিভাবান ফুটবলার মজিদের ফুটবলজীবন শেষ হয়ে গিয়েছিল শুকনো নেশায় ডুবে গিয়ে। সেই তালিকায় রয়েছেন দক্ষিণের পুঙ্গব কান্নন, মিজ়োরামের লালমপুইয়া থেকে বাংলার ফাল্গুনী দত্তেরাও। কিন্তু সবচেয়ে বড় নাম মজিদই।
ভারতে আসার আগে থেকেই বিয়ারের প্রতি মজিদের আসক্তি ছিল। ভারতে এসে তা বহু গুণ বাড়ে। কলকাতা ময়দানে পায়ের জাদুতে দর্শকদের মুগ্ধ-করা মজিদের কাছে খ্যাতির পাশাপাশি এসেছিল কলকাতার অন্ধকার জগতের হাতছানি। ধীরে ধীরে নেশায় ডুবে যান প্রতিভাবান ফুটবলার। কলকাতা ময়দানে সকলে জানতেন, মারিজুয়ানা, হাশিস থেকে গাঁজা— এমন কোনও শুকনো নেশা ছিল না, যা মজিদ করেননি। তাঁর নেশাগ্রস্ততার যে কাহিনি তখন ময়দানে শোনা যেত, তার মধ্যে অন্যতম, নেশা করার টাকা না থাকলে মহমেডান গ্যালারি থেকে ক্ষিপ্ত হয়ে মাঠে চেয়ার-পাথর ছোড়া। অনেক অনুরাগী গোপনে নেশার দ্রব্য এনে দিতেন মজিদকে। ‘পাতাখোর’ মজিদ জড়িয়ে পড়েছিলেন নারীসঙ্গেও। কেরিয়ারের তুঙ্গে ইস্টবেঙ্গলে থাকার সময় পুলিশ নাকি তাঁকে এক বার উদ্ধার করেছিল কলকাতার নামজাদা পতিতাপল্লি থেকে। খবরের কাগজ ছয়লাপ হয়ে গিয়েছিল সেই খবরে। জনশ্রুতি: এক খ্যাতনামা টেনিস খেলোয়াড়ের মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল মজিদের। সেই সম্পর্ক পরিণতি না পাওয়ায় হতাশায় আরও বেশি নেশা করতে শুরু করেছিলেন মজিদ।
কলকাতা ময়দানে মজিদ বিসকর। —ফাইল চিত্র
ইস্টবেঙ্গলে থাকাকালীন মজিদকে কড়া নজরে রেখেছিলেন ক্লাবের কর্তারা। মজিদ থাকতেন তাঁর সতীর্থ জামশিদ নাসিরির সঙ্গে। চাইলেই বাইরে বেরোতে পারতেন না মজিদ। সেই সময়েই ছোট চিরকুটে আসে মহমেডানে খেলার প্রস্তাব। ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মজিদ। মহমেডানে গিয়ে বাঁধনহারা হয়ে পড়েন তিনি। সম্পূর্ণ ‘স্বাধীনতা’ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে এবং জামশিদকে। জামশিদ বরাবর সংযত থাকলেও নেশা, নারীসঙ্গ, মদ্যপানে নিজেকে ডুবিয়ে দেন মজিদ। অনুশীলনও ঠিকঠাক করতেন না। হালকা অনুশীলন সেরে চলে যেতেন বিয়ার পানের আসরে। জামশিদের বারণ শুনতেন না।
আশির দশকের শেষে কার্যত ভিখারি হয়ে যান মজিদ। রাস্তায় রাস্তায় ফাটা জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়াতেন। সাংবাদিক বা প্রাক্তন সতীর্থদের দেখলেই নেশা করার টাকা চাইতেন। বন্ধুর অবস্থা দেখে চিন্তিত জামশিদ ইরান থেকে মজিদের বাবা-মাকে ডেকে পাঠান। তাঁদের সঙ্গে দেশে ফিরে যান মজিদ। তার পর থেকে তাঁকে আর দেখেনি কলকাতা ময়দান। ফুটবলার মজিদ হারিয়ে গিয়েছেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক, মজিদের এক প্রাক্তন সতীর্থের কথায়, “কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চর্চা করা আমাদের কাজ নয়। তাই মজিদের জীবনের ভিতরে ঢুকতে চাইনি। তবে যত দূর সম্ভব সাহায্য করেছি। ওর অবস্থা দেখলে খারাপ লাগত। চোখের সামনে এমন প্রতিভার শেষ হয়ে যাওয়া মানতে পারিনি। এখনও মনে হয়, মজিদ সংযত থাকলে এখনও ওকে নিয়ে আলোচনা হত। এখনকার প্রজন্ম মজিদকে চেনেই না। তারা মজিদকে মাথায় তুলে রাখত।”
হারিয়ে গিয়েছেন লালমপুইয়াও। বছর ১৬/১৭ আগে মোহনবাগানে খেলতে এসেছিলেন। কিছু দিনের মধ্যেই তাঁকে ভবিষ্যতের তারকা হিসেবে চিহ্নিত করা হতে থাকে। শারীরিক গঠন এবং গতিতে অনবদ্য ছিলেন। টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমির ছাত্র লালমপুইয়া জার্মানিতে গিয়ে নজর কেড়েছিলেন সেখানকার কোচেদেরও। কিন্তু মিজ়োরামের ছোট গ্রাম থেকে উঠে আসা লালমপুইয়া শহরের ‘হাতছানি’ এড়াতে পারেননি। প্রলোভনে পা বাড়িয়ে দেন। মদ্যপান এবং শুকনো নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। পারফরম্যান্স খারাপ হতে থাকে। শোনা যায়, কখনও কখনও অনুশীলনেও আসতেন নেশা করে। মত্ত অবস্থায় মোহনবাগানের এক কর্মীকে পেটানোর অভিযোগও উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে।
লালমপুইয়াকে কাছ থেকে দেখা মোহনবাগান সচিব দেবাশিস দত্তের কথায়, “ও প্রতিভাবান ফুটবলার। কিন্তু খেলা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম, কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। কিন্তু কী সমস্যা বুঝতে পারছিলাম না। মদ খেলে তবু বোঝা যায়। কিন্তু শুকনো নেশা করলে বোঝা মুশকিল। আমরা ওর বাড়িতে লোক পাঠাই। শেষ পর্যন্ত বারুইপুরের একটা রিহ্যাবে ভর্তি করি। ফল হয়েছিল। কিন্তু মাঠে ফিরলেও ফুটবলে সেই জায়গায় আর ফিরতে পারেনি।”
এখন কি কলকাতা ময়দানে নেশার আগ্রাসন রয়েছে? দেবাশিস মনে করেন না। তাঁর কথায়, “বাঙালিদের মধ্যে শুকনো নেশার প্রবণতা কম। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ফুটবলারদের মধ্যে ওই প্রবণতা ছিল। এখন নেশা করার ব্যাপারটা প্রায় নেই-ই। সকলে অত্যন্ত পেশাদার। ধূমপানও করতে দেখি না। সকলে ফিটনেস নিয়ে সচেতন। কড়া ডায়েটে থাকতে হয়। কোচেরাও এখন এ সব বরদাস্ত করেন না।”
কলকাতা ময়দানের ঘাস জানে, দক্ষিণের ফুটবলার পুঙ্গব কান্নন কলকাতায় খেলতে এসে জড়িয়ে পড়েন নেশার জগতে। আর বেরোতে পারেননি। অল্প বয়সেই কেরিয়ার শেষ হয়ে যায়। বাঙালি ফুটবলার ফাল্গুনীর কথাও জানেন সকলে। তবে তিনি শুকনো নেশার থেকে বেশি আসক্ত ছিলেন মদ্যপানে। নিয়মিত মদ্যপানে চেহারা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রভাব পড়ছিল পারফরম্যান্সেও। মোটরবাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন ফাল্গুনী। আর মাঠে ফিরতে পারেননি।
শুকনো নেশা করলে কি ফুটবল খেলা যায় না? মাদক নেওয়ার উদাহরণ যদি মজিদ হন, তা হলে বিশ্ব ফুটবলে দৃষ্টান্ত আছে ব্রাজিলের সক্রেটিসের। পেশায় চিকিৎসক, নেশায় ফুটবলার সক্রেটিস ‘চেন স্মোকার’ ছিলেন। ম্যাচের বিরতিতে সাজঘরেও সিগারেট টানতেন। মদ্যপানেও আসক্তি ছিল। সে কথা কখনও গোপনও করেননি। পারফরম্যান্সেও খুব প্রভাব পড়েনি। ১৯৮২ এবং ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ব্রাজিল খেলেছিল তাঁর নেতৃত্বে।
শাকারি রিচার্ডসন, মজিদ বিসকর, সক্রেটিস একই পৃথিবীর বাসিন্দা। আবার শাকারি রিচার্ডসন, মজিদ বিসকর, সক্রেটিস একই পৃথিবীর বাসিন্দা ননও বটে!
(এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশের সময় লেখা হয়েছিল, মোটরবাইক দুর্ঘটনায় ফাল্গুনী দত্তের অকালমৃত্যু হয়েছে। সেই তথ্য সম্পূর্ণ ভুল। ফাল্গুনী ওই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা আন্তরিক দুঃখিত। আমরা ফাল্গুনী, তাঁর পরিবার এবং তাঁর শুভানুধ্যায়ীদের কাছে নিঃশর্তে ক্ষমাপ্রার্থী)