ঘটনাটা এখনও চোখের সামনে ভাসছে। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাস। স্থান, ইডেন গার্ডেন্স। ম্যাচ, বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ভারত বনাম শ্রীলঙ্কা। যে ম্যাচে ইডেন দেখেছিল দর্শকদের তাণ্ডব। আমি তখন অন্যতম জাতীয় নির্বাচক। আমি, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, সবাই বক্সে বসে খেলা দেখছিলাম। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে দেখে নীচে নেমে অজিত ওয়াড়েকরকে (ওই দলের কোচ তথা ম্যানেজার ছিলেন) বলি, ‘আমাদের সঙ্গে গাড়িতে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে চলুন। না হলে সমস্যা হতে পারে। দর্শকরা তাণ্ডব শুরু করেছে।’ কিন্তু ওয়াড়েকর সে দিন আমাদের সঙ্গে ইডেন ছেড়ে যাননি। উনি বলেন, ‘যাই ঘটুক না কেন, আমি ক্রিকেটারদের সঙ্গে টিম বাসেই মাঠ ছাড়ব।’’
এই ছিলেন অজিত লক্ষ্মণ ওয়াড়েকর। কখনও পিঠ দেখিয়ে চলে যাননি। সব সময় লড়াই করেছেন বুক চিতিয়ে। তা প্রতিপক্ষ যত শক্তিশালীই হোক না কেন। এই লড়াকু মনোভাবটা না থাকলে ভারতের প্রথম বিদেশে টেস্ট সিরিজ জেতা হত না। তাও কাদের বিরুদ্ধে? ১৯৭১ সালে গ্যারফিল্ড সোবার্স, ক্লাইভ লয়েড, রোহন কানহাইয়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তার পরে জন এড্রিচ, কিথ ফ্লেচার, ডেরেক আন্ডারউডদের ইংল্যান্ড। এই দু’টো সিরিজ জয়ই ভারতকে শিখিয়েছিল, বিদেশেও আমরা জিততে পারি। এই দু’টো সিরিজ জয়েই ভারতীয় ক্রিকেটে অমরত্ব পেয়ে গিয়েছেন ওয়াড়েকর।
কিন্তু ওয়াড়েকরের কথা উঠলে সেই ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি এখনও ভুলতে পারি না। শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গিয়েছে ভারত। আমরা সেই রাতে টিম হোটেলে বিশ্বনাথের ঘরে এসে বসেছি। মাঝরাত পেরিয়ে ওয়াড়েকর এসে ঢুকলেন। বিধ্বস্ত চেহারা। কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না, কী হয়ে গেল। মাঝে মাঝে বলছিলেন, ‘এটা কী করে হল?’ এর পরে প্রায় যত বারই দেখা হয়েছে, একই কথা বলেছেন— ‘কী করে হেরেছিলাম, বলো তো?’ ওয়াড়েকরের অবসরোত্তর ক্রিকেট কেরিয়ারে ওটা একটা বিশাল কালো দাগ।
শ্রীলঙ্কার কাছে ওই হারের পরে দেশ উত্তাল হয়েছিল একটা প্রশ্ন নিয়ে। টস জিতে কেন ফিল্ডিং নেওয়া হয়েছিল? এখনও মনে আছে দিনটা। ম্যাচের দিন সকালে ভিশি (বিশ্বনাথ) আমাকে ফোন করে বলে, এখনই মাঠে চলে এসো। সকাল ন’টায় ইডেনে ওয়াড়েকর, সন্দীপ পাটিল, আজহারের সঙ্গে আমি, ভিশি পিচ দেখতে যাই। সবাই বিভ্রান্ত ছিলাম, টস জিতলে কী হবে। আমি স্থানীয় ছেলে বলে ওয়াড়েকর পরামর্শ চেয়েছিলেন। ব্যাট করার কথাই বলেছিলাম। পাটিল তখন সহকারী কোচ। ও চাইছিল, ফিল্ডিং নিতে। ওই সময় ভিশি আমাকে বলে, ওটা টিম ম্যানেজমেন্টের ব্যাপার। ওদের ওপরই ছেড়ে দাও। ভারত ফিল্ডিং নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ওই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিশ্চয়ই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আক্ষেপ করে গিয়েছেন ওয়াড়েকর।
কেমন ক্রিকেটার ছিলেন ওয়াড়েকর? খেলাটাকে দারুণ বুঝতেন। ব্যক্তিত্বের সঙঘাতের প্রভাব মাঠে পড়তে দিতেন না। ব্যাক লিফ্টটা বেশি ছিল না। বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে হয়তো ডেভিড গাওয়ারের মতো সৌন্দর্য ছিল না তাঁর ব্যাটিংয়ে, কিন্তু ভীষণ কার্যকর ছিলেন। মুম্বইয়ের কঠিন মানসিকতার ছাপ দেখা যেত ওয়াড়েকরের খেলায়। ৩৭ টেস্ট খেলে একটা সেঞ্চুরি, ওয়াড়েকরের ক্রিকেট প্রতিভার সঠিক প্রতিফলন নয়। ওয়াড়েকরই হল প্রথম ক্রিকেটার, যিনি ভারতীয় অধিনায়কের আসনকে উজ্জ্বল করেছিলেন। ভারতীয় পেস আক্রমণের অবস্থা দেখে চার স্পিনার— বিষাণ সিংহ বেদী, শ্রীনিবাস বেঙ্কটরাঘবন, ভগবৎ চন্দ্রশেখর, এরাপল্লি প্রসন্নকে নিয়ে স্পিনের জাল ছড়িয়েছিলেন। যখন ভারতীয় দলের কোচ হন, তখনও স্পিনের জাল বুনেছিলেন ঘরের মাঠে। মহম্মদ আজহারউদ্দিনের হাতে তুলে দেন, অনিল কুম্বলে, বেঙ্কটপতি রাজু আর রাজেশ চৌহানকে।
ওয়াড়েকর কিন্তু খুব ভাল স্লিপ ফিল্ডারও ছিলেন। বাঁ-হাতি হওয়ার কারণে উইকেটকিপার ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের ছেড়ে দেওয়া ক্যাচগুলোকে সহজে ডাইভ দিয়ে তালুবন্দি করতেন। ওয়াড়েকরের ক্রিকেট জীবন তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এক ব্যাটসম্যান এবং অধিনায়ক। যেখানে তিনি ’৭১ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সুনীল গাওস্করকে ভারতীয় ক্রিকেটকে উপহার দিয়েছিলেন। এর পরেই ইংল্যান্ড সফরে বিশ্বকে দিয়েছিলেন চন্দ্রশেখর নামের এক প্রহেলিকাকে। তার পরে কোচ বা ম্যানেজার। শেষে জাতীয় নির্বাচক। কিন্তু মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন ওয়াড়েকর? যখন খেলতেন, তখন খুব একটা কাছ থেকে দেখিনি। কিন্তু পরবর্তী কালে ভাল ভাবে মেশার সুযোগ পেয়েছি। দেখেছি, কতটা দিলদরিয়া মানুষ ছিলেন।
ক্রিকেটের বাইরেও ওয়াড়েকরের একটা জীবন ছিল। খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। স্টেট ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার হয়েছিলেন। চেন্নাইয়ে পোস্টিং থাকার সময় একবার পুরো ভারতীয় দল আর আমাদের, মানে নির্বাচকদের বাড়িতে ডেকে খাইয়েছিলেন। মাঠের বাইরেও ওঁর সাফল্য দেখে শেখার চেষ্টা করতাম।
স্বাধীনতার রাতে চলে গেলেন তিনি। ভারতীয় ক্রিকেটকে বিদেশে ‘স্বাধীন’ করা প্রথম অধিনায়ক— অজিত ওয়াড়েকর।