ধারাভাষ্যকার: তখনও ভেস্তে যায়নি প্রথম দিনের খেলা। কভারে ঢাকা লর্ডসে হাজির হরভজন সিংহ। টুইটার
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের টিম ইন্ডিয়ার আগ্রাসী, অন্যতম সেরা অস্ত্র। ইডেনে স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে যাঁর উত্থান। ১০৩ টেস্টে ৪১৭ উইকেট। স্পিনার হয়েও বিদেশের মাটিতে বেশ ভাল রেকর্ড। ৪৮ টেস্টে ১৫২ উইকেট। ভারত বনাম ইংল্যান্ড মহারণের টেস্ট সিরিজে এসেছেন ধারাভাষ্যকার হিসেবে। লর্ডসে সারা দিনের বৃষ্টিতে একঘেয়েমির মধ্যে সদা চনমনে চরিত্র জমিয়ে রেখেছিলেন আশেপাশের মহল। এক ফাঁকে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বসলেন হরভজন সিংহ। বরাবরের মতোই অকপট!
প্রশ্ন: কুলদীপ যাদবকে খেলানো উচিত বলে অনেকে মনে করছেন। আপনার কী মত?
হরভজন সিংহ: খেলানো তো যেতেই পারে। টি-টোয়েন্টি আর ওয়ান ডে সিরিজে কুলদীপকে খুব ভাল খেলতে পারেনি ইংল্যান্ড। একমাত্র জো রুট দু’টো ম্যাচে ওকে ভাল খেলে দিয়ে রান করেছে। অইন মর্গ্যান একটা ম্যাচে রান করেছে। কিন্তু মর্গ্যান টেস্ট দলে নেই। কুলদীপকে কতটা ভাল খেলতে পারবে ইংল্যান্ড, আমারও সংশয় আছে। কমেন্ট্রিতে দাদা (তাঁর প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়) বলে চলেছে, যতই বৃষ্টি হোক, দ্বিতীয় স্পিনার খেলানো উচিত!
প্র: সৌরভের অধিনায়কত্বে হেডিংলেতে দুই স্পিনার খেলিয়ে জিতেছিল ভারত। টসে জিতে ভিজে পিচে প্রথম ব্যাটিং করেছিল টিম।
হরভজন: ইয়েস। বিদেশের মাটিতে আমাদের সেই টিম ইন্ডিয়ার সেরা জয়গুলোর একটা। এখনকার ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গার দারুণ ব্যাট করেছিল। বাঙ্গার ৬০-প্লাস করেছিল (সেই ইনিংসে ভিজে পিচে ওপেন করতে নেমে বাঙ্গার ২৯৬ মিনিট ধরে ক্রিজে কাটিয়ে করেন ৬৮) কিন্তু সেই রানটা ১৬০-এর সমান ছিল। খুব খারাপ পিচে টসে জিতেও ব্যাট করছিলাম আমরা কারণ দুই স্পিনার ছিল দলে। সেটার অ্যাডভান্টেজ নিতে চেয়েছিল দাদা (সৌরভ)। আমি আর অনিল ভাই (কুম্বলে) দুই ইনিংস মিলিয়ে ১১ উইকেট নিয়েছিলাম। টেস্টটা আমরা জিতি ইনিংসে (ঐতিহাসিক সেই জয়ে প্রথমে ব্যাট করে ভারত তুলেছিল ৬২৮-৮। ভারতীয় ব্যাটিংয়ের মহাত্রয়ী সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড় এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তিন জনেই সেঞ্চুরি করেন)।
প্র: কী দেখে তা হলে দল নির্বাচন করা হবে? নিজেদের শক্তি নাকি সেই দেশের আবহাওয়া, পরিবেশ?
হরভজন: দু’টোই মাথায় রাখা উচিত। তবে আমার মনে হয়, সাবধান থাকা দরকার যে, কন্ডিশনের কথা বেশি ভাবতে গিয়ে যেন নিজেদের শক্তিটাকে গুলিয়ে না ফেলি। আর প্রতিপক্ষ কোনটা চায় না, সেটাও তো ভাবতে হবে। কুলদীপকে নিয়ে আপনাকে একটা গল্প বলি শুনুন। অইন মর্গ্যান ইংল্যান্ডের ওয়ান ডে টিমের ক্যাপ্টেন। এই সিরিজে একটা ম্যাচ তো কুলদীপকে খেলে দিয়ে ও আর জো রুট জেতাল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করছিলাম, কুলদীপকে নিয়ে তোমরা কী ভাবছিলে? মর্গ্যান বলল, ভাবছিলাম ও বাঁহাতি লেগস্পিন আর গুগলি তো করতেই পারে, আর কী কী বৈচিত্র ওর হাতে আছে! ভাবুন এক বার (হাসতে হাসতে)...আমি তো অবাক। কুলদীপ আর কী বল করে? একটা বাচ্চা ছেলেও তো জানে, ও হচ্ছে বাঁ হাতে রিস্ট স্পিনার (কব্জির ব্যবহারে যাঁরা স্পিন করান)। দু’দিকেই স্পিন করাতে পারে। আবার কী অস্ত্র থাকবে! এই দু’টো বল খেলতে গিয়েই তোরা উল্টে দিচ্ছিস! আরও বৈচিত্র চাই!
প্র: কুলদীপকে আপনি কী ধরনের বোলার বলবেন? মিস্ট্রি বা রহস্য স্পিনার বলা হয় ওঁকে।
হরভজন: শুনুন, ওই মিস্ট্রি স্পিনার বলে কিছু নেই। পরিষ্কার কথা হচ্ছে, তুমি ভাল বোলার না খারাপ। আমি খেলার সময় থেকে একটা জিনিস দেখে এসেছি। সেরা স্পিনাররা কেউ রহস্য স্পিনার নয়। শেন ওয়ার্ন কি রহস্য স্পিনার ছিল? সবাই জানত ওয়ার্ন লেগস্পিন করাবে, ফ্লিপার করাবে, গুগলি দেবে। তার পরেও বিশ্বের সর্বত্র উইকেট নিয়ে গেল ওয়ার্ন। রহস্য-টহস্য আবার কী, কুলদীপকে হচ্ছে ‘আনঅর্থডক্স’ স্পিনার। চায়নাম্যান খুব একটা দেখা যায় না। ক্রিকেটের বিরল শিল্পই থেকে গিয়েছে। কিন্তু ওর গুণগত মান যাচাই হবে, ও ভাল না খারাপ বোলার তা দিয়ে।
প্র: এখনকার ক্রিকেটে আপনার কোন স্পিনারকে ভাল লাগে?
হরভজন: নেথান লায়ন। আমি স্পিনার হিসেবে একটু ট্র্যাডিশনাল। স্পিনারের ফ্লাইট, লুপ, ড্রিফ্ট থাকবে— এ ভাবেই এখনও ভাবি। স্পিনারের বলটা হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে যখন বাতাস কেটে যায়, একটা শব্দ হয়— ফর্র্র্র্। ওটাই বোঝায় কে কত বড় স্পিনার। কে জানে, হয়তো আমাকে লোকে সেকেলে বলবে। বললে বলুক। কিন্তু আমি স্পিনের শিল্প বলতে ওটাকেই বুঝি। ব্যাটসম্যান দেখবে বল আসছে আর হঠাৎ করে ‘ডিপ’ করে গিয়ে ব্যাট বা ব্যাট-প্যাড হয়ে শর্ট লেগে ক্যাচ— এটাই তো অফস্পিনারের স্বপ্নের ডেলিভারি। শুনুন, এখনকার ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানেরা আক্রমণ করে বেশি, রক্ষণাত্মক গুণ কম। সম্ভবত যুগের হাওয়া। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রভাবে হয়তো এই বদল ঘটেছে। কিন্তু এক জন স্পিনারের আসল পরীক্ষা হচ্ছে, ব্যাটসম্যান যখন ‘ডেড ডিফেন্স’ করে যাচ্ছে, তখন তাঁকে বোকা বানিয়ে আউট করা। স্পিন হচ্ছে একটা মায়াজাল। মরুদ্যান মনে করে ব্যাটসম্যান এগোবে বলের দিকে। আর কাছে এসে বুঝবে মরীচিকা। তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। যাও, ব্যাট হাতে প্যাভিলিয়নে ফেরো।
প্র: অশ্বিনকে নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী? কত বড় স্পিনার?
হরভজন: নিঃসন্দেহে বড় স্পিনার। এখনকার ক্রিকেটে যারা আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম সেরা। ইংল্যান্ডে এসেও তো সফল হয়ে দেখাল। এজবাস্টনে অশ্বিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। তবে সর্বকালের সেরাদের তালিকায় ঢুকতে গেলে পন্ডিতরা নিশ্চয়ই চাইবে, অশ্বিন বিদেশের মাটিতেও ম্যাচ জেতানো
স্পেল করুক।
প্র: টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের রমরমায় স্পিন কি লুপ্তপ্রায় শিল্প হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে ভুগছে?
হরভজন: চিন্তা তো আছেই। আমি তো ভারতেও খুব বেশি নতুন স্পিনার উঠে আসতে দেখছি না। ভুল প্রমাণিত হলেই খুশি হব কিন্তু দেখতে তো পাচ্ছি না। সেই অশ্বিন, জাডেজা, কুলদীপ। এর বাইরে রয়েছে চহাল। ওকে তো বোধ হয় চার দিনের ম্যাচে খেলিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে জানি না ও টেস্টে কতটা সফল হবে। এ ছাড়া যা রয়েছে, খুব প্রতিশ্রুতিমান কি না, দেখতে হবে।
প্র: কলকাতায় স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়া টিমের রথ থামিয়ে দেওয়ার সেই ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের দিকে ফিরে তাকালে কী মনে হয়? সেই হ্যাটট্রিকের বলটা কি এখনও রেখে দিয়েছেন?
হরভজন: অবশ্যই। আরে, ২০০১-এর ইডেন আমার জীবনের সব চেয়ে স্মরণীয় স্টেশনগুলোর একটা। জীবনের প্রথম টেস্ট হ্যাটট্রিক। তার উপর আমরা হারিয়েছি বিশ্বসেরা দলকে। বলটা রাখব না? এখন টেস্ট ম্যাচটার কথা ভাবলে শিহরণ জাগে। হোয়াট আ টেস্ট ম্যাচ! এখনও মনে হয় যেন সত্যি নয়, স্বপ্ন দেখছি। আমার ক্রিকেট জীবন তৈরি করে দিয়েছিল কলকাতার ওই টেস্ট। শুধু আমার নয়, ভারতীয় ক্রিকেটের জন্যই সেই টেস্ট ছিল বিরাট এক টার্নিং পয়েন্ট। ইডেনই আমাদের মনে বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল যে, আমরা যে কাউকে হারাতে পারি। এর পর ওই দলটা যে বিশ্বের সর্বত্র ভাল খেলেছে, সব বড় দলকে তাদের দেশে গিয়ে হারিয়েছে, তার জন্য বড় অবদান ছিল ইডেনের।
প্র: আপনি যাঁদের বিরুদ্ধে খেলেছেন, সব চেয়ে কঠিন ছিল কাকে বল করা?
হরভজন: জাক কালিস। ম্যাথু হেডেন। দারুণ স্পিন খেলত ওরা। একটা গল্প বলি শুনুন। দক্ষিণ আফ্রিকায় সেঞ্চুরিয়নে প্রথম টেস্টে আমরা হারলাম। কালিস আর হাসিম আমলা আমাকে খুব মেরেছিল। মন খারাপ ছিল খুব। রবি শাস্ত্রী তখন কোচ নয়, ধারাভাষ্যকার। আমাকে ওর ঘরে ডাকল। সেই রাতে রবি ভাই আমাকে বোঝাল, এই লাইন-লেংথে বল করে গেলে গোটা সিরিজ ধরে ওরা তোকে মারবে। বলল, উইকেটের মধ্যে বল কর। ছোট্ট একটা পরামর্শ। কিন্তু দারুণ কাজে দিয়েছিল। আমি ডারবান আর কেপ টাউনে ভাল করে উইকেট নিলাম। এই গল্পটা বললাম কারণ, কখনওসখনও ছোটখাটো পরামর্শও ছবিটা পুরো পাল্টে দিতে পারে। আমার মনে হয় এই যে ভারতীয় দল খেলছে, তাদেরও উচিত নানা ‘গ্রেট প্লেয়ার’-এর থেকে পরামর্শ নেওয়া।
প্র: যেমন?
হরভজন: যেমন ব্যাটিং ইউনিট রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে কথা বলতে পারত। এখানে কত রান করেছে রাহুল ভাই। বিশ্বের সব জায়গায় করেছে। ভারত ‘এ’ দলের কোচ হিসেবে এখানেই তো ছিল। সচিন তেন্ডুলকর এখানে ছিল। ওকে ডাকা যেতে পারত টপ অর্ডারের কী সমস্যা হচ্ছে, ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।
প্র: কিন্তু রাহুল দ্রাবিড় যে ভারতীয় ‘এ’ দলের কোচ ছিলেন এ বারের ইংল্যান্ড সফরে, সেই দলেই তো ছিলেন মুরলী বিজয়, অজিঙ্ক রাহানেরা! তার পরেও উন্নতি দেখা যাচ্ছে কোথায়? গুণগত মান বা স্কিলেরও কি অভাব ঘটছে?
হরভজন: দক্ষতার অভাব ক্রিকেটে সব মিলিয়েই দেখা যাচ্ছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আগে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকা টিমে এক থেকে ছয় প্রত্যেকে দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান থাকত। এক-দু’জনকে ফেরালেই হত না, অন্তত ছ’টা উইকেট তুলতে হত। তার পরে জেতার কথা ভাবতে পারবে। এখন প্রত্যেক দলে খুব বেশি হলে এক জন কী দু’জন স্পেশাল ব্যাটসম্যান দেখতে পাওয়া যায়। তারা সফল হলে তবেই টিম স্কোর চারশো পেরোবে। না হলে গেল। টেস্ট ক্রিকেটে অন্তত গুণগত মান যে পড়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
ক্রিকেটারদের ইন্টারভিউ, ফুটবলারদের ইন্টারভিউ, অ্যাথলিটদের লড়াইয়ের গল্প - ক্রীড়াজগতের সব খবর আমাদের খেলা বিভাগে।