ষোলো বছরের মেয়ে বলেছিল, ‘‘বাবা তুমি আজ মাঠে যেও না।’’
ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড-লিভারপুল ম্যাচ পড়লে বাড়িতে বাবার সঙ্গে যুদ্ধ চলে তার। বাবা লিভারপুল সমর্থক, মেয়ে ইউনাইটেডের। কিন্তু সেই নভেম্বর-সন্ধেয় ষোড়শী মন বলে উঠেছিল, স্তাদ দ্য ফ্রঁসে আজ ফ্রান্স-জার্মানি ম্যাচটায় অন্য রকম কিছু হবে। ওই স্টেডিয়ামেই সে
দিন নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা বাবার। নিরাপত্তারক্ষী বাবা বুঝতে পারেননি, মেয়ে কেন এ কথা বলছে। মেয়েও পারেনি বোঝাতে, কেন সে আটকাচ্ছে।
মেয়েকে মনে পড়েছিল সেলিম টুরাবালির। রাতে আচমকা যখন লোকটাকে আবিষ্কার করেছিলেন। হাতে টিকিট নেই, তবু স্টেডিয়ামে ঢুকতে চাইছে। ওয়াকিটকিতে তত ক্ষণে খবর ঢুকতে শুরু করেছে, কিছু একটা ঘটছে প্যারিস জুড়ে। গুলি চলছে। বোমা ফাটছে। স্তাদ দ্য ফ্রঁসের কাছেও ফেটেছে একটা। মেয়েকে মনে পড়েছিল সেলিম টুরাবালির যখন দেখেছিলেন, বের করে দেওয়ার পরেও তাঁর দিকে জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রয়েছে লোকটা। ফুঁসছে, উন্মত্তের মতো খুঁজছে অন্য কোনও গেট, যাতে স্টেডিয়ামে ঢুকে পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দিতে পারে আঁতোয়া গ্রিজম্যান-বাস্তিয়ান সোয়াইনস্টাইগারদের।
১৩ নভেম্বর, সাল ২০১৫, দিনটা শুক্রবার।
স্তাদ দ্য ফ্রঁস যেতে স্যাঁ দেনিতে নামলেই একটা বেয়াড়া হাওয়া এসে লাগে। শীত-শীত করে। নিরাপত্তারক্ষী সেলিম এ দেশে আছেন বহু দিন। খেয়ালি আবহাওয়াকে চেনেন, কোট পরতেও তাই ভোলেননি। তবু যেন কাঁপছেন সন্ত্রাসের পুরনো আতঙ্কে। স্টেডিয়ামে জঙ্গির প্রবেশ একা হাতে আটকানোর এত দিন পরেও যে কাঁপুনি বেঁচে রয়েছে— “মেয়ে কেন ও-রকম বলছিল বুঝিনি। পরে চার দিক থেকে গণ্ডগোলের খবর যখন আসছে, বারবার ঈশ্বরকে বলছিলাম, আমাদের বাঁচিয়ে দাও।” কিন্তু প্যারিস হামলার পরে আট মাস তো হয়ে
গেল। আপনাদের দেশ তার পরেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়েছে, সে আজ আর এক ইতিহাসের সামনে। ইউরো জিতলে দুঃখে কিছুটা প্রলেপ পড়বে না? সেলিম বলছেন, “নাহ্, সম্ভব নয়। তা ছাড়া আপনি লোকটাকে দেখেননি। পাগলের মতো চেষ্টা করছিল মাঠে ঢোকার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে অন্য গার্ডদেরও সতর্ক করে দিয়েছিলাম, একে যেন ঢুকতে দেওয়া না হয়। কপাল ভাল, সে দিন আমি জিতে গিয়েছিলাম।”
জীবন-মৃত্যুর হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকা যাঁরা খুব কাছ থেকে দেখেন, একটা ইউরো জয় তার পাশে কতটুকু? ওই রাতের বুলেট-ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাতাক্লঁ থিয়েটার লাগোয়া বার্গারের দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনিও দেখলাম বিশ্বাস করেন না যে, গ্রিজম্যানরা ইউরো জিতলে ফ্রান্সের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরা বন্ধ হবে। সেলিম টুরাবালিরা নিরুপায়!
কিন্তু ইউরো ফাইনালের আগে এটা একটা ফ্রান্স হলে, অন্য একটা ফ্রান্স তারই গা ঘেঁষে দাড়িয়ে।
যে ফ্রান্সে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বনাম আঁতোয়া গ্রিজম্যান মহাযুদ্ধের আঁচে স্যুভেনির শপ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। দোকানদার বারবার বলেন, যে কোনও মুহূর্তে তালা ঝুলবে। পতাকা, টুপি, জার্সি সব নিঃশেষ।
যে ফ্রান্সে মেট্রো স্টেশনে আমদানি হয় নতুন ইলেকট্রনিক বোর্ড। যেখানে শুধুমাত্র দেখানো হয় গ্রিজম্যানকে।
যে ফ্রান্সে আভিজাত্যের স্মারক শঁজেলিজে-তে নীল পতাকার সঙ্গে দেদার সেলফি তোলে ছেলে-বুড়ো-যুবতীর দল। গুঁড়িয়ে যায় যাবতীয় ‘এটিকেট’-এর বর্ম।
মেট্রোর ব্যাপারটা শনিবারই প্রথম দেখা গেল। এলইডি বোর্ডে বারবার ঘুরে আসছে গ্রিজম্যানের ফুটফুটে চেহারা, নীচে লেখা— ‘ডমিনেশন রেডি!’ ফরাসি মিডিয়াও কেমন যেন ক্ষিপ্ত। তারা ফাইনালে যুযুধান দু’দেশের সমর্থকদেরই বলেছে শনিবার ভাল করে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে নিতে। রবিবার সব তো বন্ধ রাখতে হবে! একটা কাগজে তীব্র আলোচনা, ব্যালন ডি’অর কার পাওয়া উচিত— গ্রিজম্যান না রোনাল্ডো? ফ্রান্সের ৭ নম্বর জার্সি, না পর্তুগালের ৭ নম্বর? কোচ দিদিয়ের দেশঁকে নিয়ে এত দিন ধিক্কার আর প্রশংসার জোড়া অনুভূতিতে ভুগেছে ফ্রান্স। তাঁকে নিয়ে পর্যন্ত একটা প্রতিবেদন—‘গুড স্টার দিদিয়ের দেশঁ’!
শঁজেলিজে-তে বিক্রি হচ্ছে দেশঁ ও তাঁর প্লেয়ারদের ছোট ছোট পুতুল। দাম দশ ইউরো থেকে শুরু। চড়া দর নিঃসন্দেহে, কিন্তু বিক্রিবাটাও বেশ ভাল। লুই নামের দোকানদার বলছিলেন, “যে’কটা দেখছেন, ঠিক ততগুলোই পড়ে আছে। কাল আসুন, দেখবেন একটাও আর নেই।” বাড়তি পুতুল তৈরি করেও নাকি চাহিদা সামলানো যাচ্ছে না। ইউরো-আকাশ থেকে আলোকবর্ষ দূরে থাকা ফ্র্যাঙ্ক রিবেরির পুতুলও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে! লুই নিশ্চিত, ফ্রান্স জিতছেই। অতএব আগামী এক সপ্তাহ তাঁকে স্মারকের পর্যাপ্ত স্টক রাখতে হবে! ভদ্রলোক শুনলে খুশি হতেন যে, তাঁর দেশের কোচও রবিবাসরীয় যুদ্ধ নিয়ে ন্যূনতম টেনশনে ভুগছেন না।
দেশঁ প্রাক্-ফাইনাল সাংবাদিক সম্মেলন করতে এসে বলে গেলেন, “আমার শুধু একটাই লক্ষ্য। নিজেদের ফোকাসড রাখো। রিল্যাক্সড থাকো। অসাধারণ মুহূর্তের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। একটু দূরেই আছে ট্রফি।”
আর রোনাল্ডো? দেশঁর এ বার উত্তর, “রোনাল্ডোকে আটকানোর কোনও ওষুধ বেরিয়েছে নাকি? আমার তো জানা নেই।” ফরাসি কোচের সিআর-বন্দনা এটুকুতেই শেষ ভাবলে ভুল হবে। দেশঁ আবার বলেছেন, “হেড নেওয়ার সময় যে অ্যাথলেটিসিজম দেখায়, ভাবা যায় না। ও যে শুধু লাফায় তা-ই নয়, লাফিয়ে অনেক ক্ষণ ভেসে থাকতে পারে। কেন যে রোনাল্ডোর সিক্স প্যাকস, বুঝি। ফুটবলে দু’টো জিনিস সামলানো খুব মুশকিল। গতি আর অতর্কিত লাফিয়ে ওঠা। রোনাল্ডোর দু’টোই আছে। যদি ফাইনালে ওকে থামানো যায়, নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব!” আসলে ফ্রান্স বুঝতে না চাইলেও দেশঁ অবুঝ নন। ফরাসি কোচ জানেন, কে তাঁর জাতির স্বপ্নের বিরুদ্ধে একা বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারেন। কে পারেন, তাঁর হাত থেকে একা ফাইনাল নিয়ে চলে যেতে!
কিন্তু সেই ‘বিদ্রোহী’কে শান্ত করে ফাইনাল জিতলেও ফ্রান্সের জয় সার্বিক হবে তো? কে জানে কেন মনে হয়, ফ্রান্সের ইউরো ফাইনাল রবিবার রাতেও শেষ হয়ে যাবে না। রোনাল্ডোকে হারালেও গ্রিজম্যানদের কাজ বিস্তৃত হবে আরও কিছু দিন। কোনও এক সেলিম টুরাবালির দুঃসহ স্মৃতি শুষে নিতে হবে, বন্ধ বাতাক্লঁ কাফের শাটার মানুষের মনে খুলে দিতে হবে নির্ধারিত আগামী নভেম্বরেও বহু আগে, পাশের বার্গার বিক্রেতা সালাহ-কে ‘‘খেলাটাকে আমি একটা খেলা হিসেবেই দেখছি”-র বদলে বলাতে হবে, “এই জয়কে আমি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জয় হিসেবে দেখছি।” নীল সাগরের স্বপ্ন-ঢেউয়ে মুছে দিতে হবে রক্তের লাল ফোঁটা। তবে লেখা যাবে নতুন ইতিহাস। তবে বলা যাবে, ফ্রান্স জিতেছে।
‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ বলে হয় ফুটবলকে। তার একটা মর্যাদাআছে না!