প্রতীকী ছবি
ইস্টবেঙ্গল আমার কাছে নিছক একটি ফুটবল ক্লাব নয়। এটা দেশভাগের পরে ছিন্নমূল মানুষের একটা আশা-ভরসার জায়গাও। প্রতিকূলতা জয় করে জীবনধারণ করার জন্যই হয়তো বাঙালরা প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করে জেতার আত্মবিশ্বাস ও হার না মানা মনোভাব নিয়ে এগোতে পারেন। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে একদিন জ্যাঠার সঙ্গে শিয়ালদা স্টেশনে গিয়েছিলাম। ওই ছোট বয়সে দেখেছিলাম, প্ল্যাটফর্মে গিজগিজ করছে অসহায় মানুষ। চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। ওপার বাংলা থেকে ভিটেমাটি হারিয়ে কলকাতায় এসেছেন। অভাব, অনাহার, চোখের জল, মনখারাপ তাঁদের সঙ্গী। সেই মানুষগুলো তাঁদের প্রত্যাবর্তনের লড়াই শুরু করেছিল কিন্তু এই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে সামনে রেখেই। সংসার নিয়ে অভাব-অনটনের মধ্যেও তাঁরা প্রিয় ক্লাবের জয় দেখে লড়াইয়ের রসদ সংগ্রহ করতেন। অন্ধকার ভবিষ্যতের সামনে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবই ছিল ওই সব মানুষের কাছে বড় প্রেরণা।
আমার বাবা তিনের দশকে কালীঘাট ক্লাবের হয়ে কলকাতা ময়দানে ফুটবল খেলতেন। তাঁর কাছ থেকে ছোটবেলায় শুনতাম লক্ষ্মীনারায়ণ ও মুর্গেশ নামে ইস্টবেঙ্গলের দুই বিখ্যাত খেলোয়াড়ের কথা। বাবা বলতেন, ১৯২০ সালে আত্মপ্রকাশের পরে প্রথম দুই দশক খুব সাফল্য আসেনি। চারের দশক থেকেই কলকাতা ময়দানে ইস্টবেঙ্গলের দাপট শুরু হয়। সুনীল ঘোষ, পরিতোষ চক্রবর্তী, সোমানা, সূর্য চক্রবর্তীর কথা বাবা খুব বলতেন।
একটু বড় হতেই জানলাম ব্যোমকেশ বসুর নাম। বিখ্যাত পঞ্চপাণ্ডবের কথা— আপ্পা রাও। সালে, বেঙ্কটেশ, আমেদ খান ও ধনরাজ। স্বপ্নের সেই পাঁচ তারকা। খাতায় এঁদের ছবি আটকে রাখতাম। কাকার সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে গিয়ে পঞ্চপাণ্ডবের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সেই সময়েই কলকাতা লিগে ২৪ ম্যাচে ৩৬ গোল করে নজির গড়া ইস্টবেঙ্গলের নায়ারও ছিলেন আমাদের আদর্শ।
১৯৬১ সালে আমার ইস্টবেঙ্গল জার্সি পরার নেপথ্যে বন্ধু অরুণ ঘোষের অবদান প্রচুর। ১৯৫৩ সালে ইস্টবেঙ্গল লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে সাত বছর কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। আমি ইস্টবেঙ্গলে আসার পরে ফের লিগ চ্যাম্পিয়ন হল লাল-হলুদ ক্লাব। সে দিনটা আজও চোখের সামনে দেখতে পাই। সেই দলের ন’জন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লুজ। অবনী বসু, অরুণ, শ্রীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, বিক্রমজিৎ দেবনাথের মতো বাঙালি ছেলেদের নিয়ে এই সাহস দেখাতে পেরেছিল ইস্টবেঙ্গল। সঙ্গে তুলসীদাস বলরাম, রামবাহাদুর। ওটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা জয়।
আরও পড়ুন: ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষে অভিনব শুভেচ্ছাবার্তা বাগান সমর্থকদের
ইস্টবেঙ্গলে খেলার সময়ে আমার দেখা সেরা গোলটিও বলরামের। ১৯৬২ সালের রোভার্স কাপ ফাইনালে। ড্র করলেই যুগ্মজয়ী হব। হায়দরাবাদ পুলিশের বিরুদ্ধে ০-১ পিছিয়ে। খেলা শেষ হওয়ার মিনিট দশেক আগে ফ্রি-কিক পেলাম। ওই জায়গায় দুরূহ কোণ থেকে ডান পায়ে এমন একটা বাঁক খাওয়ানো শট বলরাম মারল যে বলটা গোত্তা খেয়ে গোলে ঢুকে গেল। আজও চোখে ভাসে।
ইস্টবেঙ্গল কী ভাবে প্রেরণা জোগায় তা দেখেছিলাম ১৯৬১ সালের লিগে মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে। সে দিন ১০২ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে অরুণ ঘোষ যেন চুনীদার (গোস্বামী) সামনে পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ছ’য়ের দশকে ইস্টবেঙ্গলের সব স্মরণীয় ঘটনার মাঝে অবশ্যই আসবে ক্লাবের প্রাণপুরুষ জ্যোতিষ গুহর নাম। আমার মনে হত, উনি আমাকে পছন্দ করেন না। ১৯৬৬ সালের একটা বড় ম্যাচ। তার আগে আমার হাঁটুতে চোট। এক প্রাক্তন ফুটবলার জ্যোতিষবাবুকে গিয়ে বলেন, আমাকে বাদ দিতে। তাঁকে উনি বলেছিলেন, ‘‘তুমি ফুটবলের ব্যাকরণ ভাল জানতে পার। কিন্তু আমি জানি সুকুমার মাঠে নামলে কী করতে পারে।’’ সে দিন আমার গোলেই জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল। এটাই লাল-হলুদ স্পিরিট। যা বিখ্যাত করেছে ইস্টবেঙ্গলকে। যেখানে গুণমান নিয়ে এক সময় কোনও আপস হত না।
ভারতের যেখানে খেলতে গিয়েছি সেখানেই দেখেছি ইস্টবেঙ্গলের প্রভাব। কিন্তু আজ প্রিয় ক্লাবের শতবর্ষে দাঁড়িয়ে খুব দুঃখ হয়। অপমানিত লাগে। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। সেখানে নতুন চুক্তি করে এটিকে-মোহনবাগান নামে খেলবে এখন দেশের এক নম্বর লিগ আইএসএলে। আর ইস্টবেঙ্গলকে হয়তো থাকতে হবে আই লিগে। যদি রাতারাতি নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে ইস্টবেঙ্গলও খেলে আইএসএলে, তা হলে সেটাই হবে শতবর্ষের সেরা উপহার।