প্রতীকী ছবি
পয়লা অগস্ট দিনটা আইলেই আনন্দে বুক ভইরা ওঠে। প্রাণের ক্লাব ইস্টব্যাঙ্গল শতবর্ষ পূর্ণ করায় আনন্দ কয়েক গুণ বাইর্যা গ্যাসে। এই লাল-হলুদ জার্সি পইরা খেলার স্বপ্নই তো দ্যাখতাম শৈশবে। মনে পইড়া যাইতাসে সেই দিনগুলার কথা। আমি আগে ইস্টব্যাঙ্গলের সমর্থক। পরে ফুটবলার।
অবিভক্ত ভারতের চট্টগ্রামে ছিল আমাগো আদি বাড়ি। যদিও আমি বড় হইসি অশোকনগরে। আমাগো পাড়ার কালুদা তখন ইস্টব্যাঙ্গলের বড় কর্তা। ওঁর উদ্যোগেই ১৯৬৪-তে অশোক নগরে প্রদর্শনী ম্যাচ খ্যালতে আইসিলেন বলরামদা, থঙ্গরাজ, রামবাহাদুর, অসীম মৌলিক, প্রশান্ত সিংহ, পরিমল দে-র মতো তারকারা। তখন আমার বয়স চোদ্দো কি পনেরো। ইস্টব্যাঙ্গলের খেলা দেখুম বইল্যা দুপুর সাড়ে বারোটাতেই মাঠের ধারে গিয়্যা বইয়া পড়সি। লাল-হলুদ জার্সি আর চোখ ধাঁধানো ফুটবল দেইখ্যা সে দিনই শপথ নিসিলাম, ইস্টব্যাঙ্গলে খ্যালতে না পারলে জীবনই বৃথা হইয়া যাইব। ১৯৬৬। পাড়ার এক দাদা আমারে ডাইক্যা কইল, বেনিয়াটোলা ক্লাবের হইয়্যা কলকাতা ময়দানে তুই খ্যালবি। আমি এক কথায় রাজি। বেনিয়াটোলা থাইক্যা সই করি উয়ারিতে। চাকরি পাই এজি ব্যাঙ্গলে। তার পরে যোগ দিই ইস্টব্যাঙ্গলে। এক দিন অফিসে কাজ করতাসি, এক জন আইসা বাইরে ডাইক্যা কহিলেন, জ্যোতিষ গুহ তোমারে ডাকতাসেন। গাড়িতে উইঠ্যা পড়ো। আনন্দে প্রায় নাচতে নাচতে ওয়েলিংটনের জ্যোতিষবাবুর অফিসে গিয়্যা নমস্কার কইরাই জিগাইলাম, আমারে ডাকসেন ক্যান? উনি আমারে জিগাইলেন, ‘‘তুমি কি ইস্টব্যাঙ্গলে খ্যালবা?’’ আমি কইলাম, কী কইতাসেন আপনে? ইস্টব্যাঙ্গলে খেলাই তো স্বপ্ন। নিলেই খেলুম। তবে আমারে খেলাইতে হইব। বসায় রাখবেন না।
আমার লগেই ইস্টব্যাঙ্গলে সই করসিল সুধীর (কর্মকার) আর স্বপন (সেনগুপ্ত)। কিন্তু প্রথম দুইটা ম্যাচে সুধীর, স্বপন সুযোগ পাইলেও আমার জায়গা হইল না। মন ভাইঙ্গা গেল। তা হলে কি ভুল করসি ইস্টব্যাঙ্গলে সই কইরা? তৃতীয় ম্যাচে সুযোগ পাইলাম। প্রথম দিনই ইস্টব্যাঙ্গলের সমর্থকেরা আমারে বুকে টাইন্যা লইসিল। ম্যাচের মধ্যেই গ্যালারি থাইক্যা চিৎকার শুরু হইল, ‘‘আমাগো এক জন প্লেয়ার আইয়্যা পড়সে রে...। বাঙাল পোলা। মাঝমাঠ লইয়া আর চিন্তা করতে হইব না।’’ সব হারানো মানুষগুলানের কাছে ইস্টব্যাঙ্গল শুধু ক্লাব নয়, লড়াইয়ের মন্ত্র ছিল। প্রিয় দলের জয়ের মধ্যে দিয়া ওরা মুক্তির পথ খুঁজত। ভুইল্যা থাকার চেষ্টা করত দ্যাশ ভাগের যন্ত্রণা। আমি নিজেও ওদেরই এক জন।
পঁচাত্তরের আইএফএ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে পাঁচ গোলের সেই জয় থাইক্যা কোরিয়ার পিয়ং ইংয়কে হারানো— অসংখ্য স্মরণীয় ম্যাচ আমি খেলসি। ইস্টব্যাঙ্গলে খ্যালতাম বইল্যাই, শচীন কত্তা (শচীন দেব বর্মন) আমারে নিজের সন্তানের মতো দ্যাখতেন। সম্ভবত ১৯৭২ সাল। স্ত্রীকে লইয়া বম্বেতে (তখনও মুম্বই হয়নি) রোভার্স কাপ খ্যালতে গেসি। ইস্টব্যাঙ্গল বম্বেতে গ্যালেই শচীন কত্তা নিয়ম কইর্যা সকাল নয়টার মধ্যে হোটেলে আইয়া পড়তেন। পুরা দিন কাটাইয়া আমাগো লগেই কুপারেজ স্টেডিয়ামে যাইতেন ম্যাচ দ্যাখতে। এক দিন শচীন কত্তা আইসা দ্যাখলেন, প্রদীপদা মিটিং করতাসে আমাগো লগে। আমি শচীন কত্তাকে আমার ঘরে বসাইয়া রাইখ্যা ফের মিটিংয়ে যোগ দিলাম। সে দিন দুপুরে আমার ঘরেই খাইয়া-দাইয়া ঘুম দিসিলেন ম্যাচে রওনা হওয়ার আগে। মোহনবাগানের নাম শোনলেই উত্তেজিত হইয়া পড়ত হক্কলে। বড় ম্যাচে জীবনদা (চক্রবর্তী) মাঠে নামার আগে চিৎকার কইরা কইতেন, ‘‘চল...অগো আজ দুই-তিন গোল মাইর্যা আসি।’’ স্বপন বলও ওই রকম আছিল। লাল-হলুদ জার্সি ছিল আমাগো মা।
বড় ম্যাচ লইয়্যা আমার কোনও দিনই টেনশন হয় নাই। নুন শো-তে সিনেমা দেইখ্যা নিউ মার্কেটে যাইতাম স্ট্রু খাইতে। তার পরে পান চিবোইতে চিবোইতে হাওয়াই চটি ফটফট করতা করতা ম্যাচ শুরুর মিনিট পনেরো আগে মাঠে আইসতাম। হক্কলে জিগাইতো তোমার ভয় করে না? আমি কইতাম, ধুর ওরা তো ভিতুর দল। ওরা একশো জন থাকলেও আমাগো চার-পাঁচ জনেরে দ্যাখলেই পলাইবে। আমি ভয় করুম ক্যান? চল ওদের হারাইয়া আসি। ইস্টব্যাঙ্গল আগাইয়া যাইবে আবার।
আরও পড়ুন: বিনিয়োগ নেই, ফিকে আইএসএলের স্বপ্ন, শতবর্ষে ম্রিয়মান মশাল
আরও পড়ুন: দর্শকশূন্য স্টেডিয়াম বক্সারের বড় পরীক্ষা, তবু মানাতে হবে