রঞ্জি জয়ী দলের দুই তারকা ইন্দুভূষণ রায় ও প্রণব রায় বাংলার লড়াই দেখে উচ্ছ্বসিত।
তিরিশ বছর আগে বাংলার রঞ্জি জয়ের কাণ্ডারী ছিলেন তাঁরা। রাজকোটে অনুজ অনুষ্টুপ মজুমদার, মনোজ তিওয়ারিদের মরিয়া লড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন বাংলাকে শেষ বার রঞ্জি ট্রফি জেতানোর কারিগররা। পঞ্চম দিনের সকালে স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার পরে কী বললেন তাঁরা—
প্রণব রায়: মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। জয়ের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম। তাই কষ্টটা বেশি। জেতা-হারা দিয়ে বিচার করছি না। কেন জেতা সম্ভব হল না, সেই ময়নাতদন্ত করতেও চাইছি না। হেরে গেলে অনেক কিছু চোখে পড়ে, যা জিতলে সামনে আসে না। ছেলেরা উজাড় করে দিয়েছিল নিজেদের, আমি এ ভাবেই দেখছি।
প্রত্যেকে নিজের সেরাটাই দিয়েছে। বাংলা চ্যাম্পিয়ন হতেই পারত। সৌরাষ্ট্র চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ঠিকই, তবে বাংলার কৃতিত্ব কেড়ে নেওয়া যাবে না। দল হিসেবে বাংলার লড়াকু মানসিকতা আমাকে সব চেয়ে আকর্ষণ করেছে। দু’দিনের বেশি ওরা ঘাম ঝরিয়েছে ফিল্ডিংয়ে। তার পরে চারশোর বেশি রান তাড়া করতে হয়েছে বিপক্ষের মাঠে। কাজটা খুবই কঠিন ছিল। তবুও বাংলার ব্যাটসম্যানরা নিজেদের মেলে ধরেছে দুর্দান্ত ভাবে।
আরও পড়ুন: স্বপ্নভঙ্গ! রঞ্জিতে রানার্স হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল বাংলাকে
এই পিচে যে ভাবে ব্যাট করা উচিত, সেই ভাবেই সবাই করেছে। উল্টোপাল্টা শট নিয়ে কেউ আউট হয়নি। সুদীপ যে মানসিক শৃঙ্খলা দেখিয়েছে, সেটাই মনোজ, ঋদ্ধি, অনুষ্টুপ, অর্ণবরা মেনে চলেছে। যেন এক জনই ব্যাট করছে! সবাই ধৈর্য দেখিয়েছে। সামনের পায়ে খেলেছে। তার জন্যই বাংলা লড়াইয়ে ছিল আগাগোড়া। বাংলার এই হারের মধ্যেও অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। আসল হল মানসিকতা। সেটা এই দলের দুর্দান্ত। পরের বছরও এই পারফরম্যান্স ধরে রাখা ও উন্নতির সম্ভাবনা যথেষ্ট। আমাদের তিন জন দারুণ পেসার রয়েছে। শাহবাজ, অর্ণবের মতো স্পিনার অলরাউন্ডার আছে। সুদীপ, মনোজ, অনুষ্টুপ, ঋদ্ধিমানের মতো ব্যাটসম্যান রয়েছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি আশাবাদী। আজ হল না, কিন্তু এই বাংলা দল অনেক গর্বের মুহূর্ত উপহার দেবে আগামী দিনে।
ইন্দুভূষণ রায়: কাল মনে হচ্ছিল আমরাই জিতব। কারণ, আমাদের লোয়ার অর্ডার। গোটা মরসুম জুড়ে ওরা রান করে গিয়েছে। এটাই আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছিল। আর অনুষ্টুপ ও অর্ণব যে মেজাজে ব্যাট করছিল, তাতে ইতিবাচক মানসিকতা ঠিকরে বের হচ্ছিল। ওরা দাপটের সঙ্গে ব্যাটিং করছিল। লুজ বল মারছিল। মনে হচ্ছিল জিতবই। তবে ক্রিকেট তো এক বলের খেলা। একটা বলই বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সেটাই হল পঞ্চম দিনের সকালে।
রাজকোটে যে পিচে খেলা হয়েছে, সেখানে রঞ্জি ট্রফির ফাইনাল হওয়া উচিতই হয়নি। খুবই মন্থর পিচ। বল কখনও গড়িয়ে গিয়েছে, কখনও আবার একই জায়গায় পড়ে লাফিয়েছে। সৌরাষ্ট্রের ব্যাটসম্যানরা ঠিক যে ভাবে খেলেছিল, আমাদের ব্যাটসম্যানরাও সে ভাবেই এগিয়েছে। নিজেদের প্রয়োগ করেছে। এই পিচে পিছনের পায়ে খেলা ঠিক নয়। ফ্রন্টফুটে আসতে হবে। বাংলার ব্যাটসম্যানরা ঠিক তাই করেছে। ক্রিজ থেকে এক হাত বেরিয়ে স্টান্স নিয়েছে। তার পরও সামনে গিয়ে খেলেছে। ঋদ্ধি অবশ্য পিছনের পায়ে খেলতে গিয়ে আউট হয়েছে। তবে ডিআরএস নিয়ে একটা কথা বলার আছে। আমরা ডিআরএস নিয়ে সমালোচনা করছিলাম। কিন্তু ডিআরএস-ই দু’বার বাঁচিয়ে দিয়েছিল ঋদ্ধিকে।
আরও পড়ুন: ‘আড়াই দিন ফিল্ডিংয়ের পর এ রকম লড়াকু ব্যাটিং, বাংলার লড়াইকে কুর্নিশ’
রাজীব শেঠ: আমাদের সময়ে দিল্লি দল ছিল ‘মিনি ভারত’। তারকাখচিত দল ছিল। কী সব ক্রিকেটার! মনোজ প্রভাকর, কীর্তি আজাদ। ওদের হারানো একেবারেই সহজ ছিল না। আমরা কোশেন্টে ম্যাচ জিতেছিলাম। আর সেটাতেও অঙ্ক কষে এগিয়ে থাকতে হয়েছিল। খুব তৃপ্তির জয় ছিল। প্রতিশোধের একটা ব্যাপার ছিল। আগের বছরই রঞ্জি ট্রফি ফাইনালে ফিরোজ শাহ কোটলায় হেরে গিয়েছিলাম দিল্লির কাছে।
তবে এ বার আমরা বাইরের মাঠে গিয়ে খেললাম। সৌরাষ্ট্রের ঘরের মাঠে খেলা। সেখানে নিজেদের মাঠে খেলার সুবিধা পায়নি অভিমন্যুরা। সে বার আমরা সেই সুবিধা পেয়েছিলাম। এর অবশ্য দুটো দিক আছে। একটা হল, জনসমর্থন। যা আমরা পেয়েছিলাম ইডেনে। এ বার রাজকোটে সেটা পূজারাদের সঙ্গেই ছিল। কিন্তু, উল্টো দিকটাও রয়েছে। ঘরের মাঠে প্রত্যাশার চাপ থাকে বিশাল। সেটা অনেক সময় চাপে ফেলে দেয় হোম টিমকে। এটার ভাল-মন্দ দুটোই রয়েছে। নার্ভের খেলা হল ফাইনালে। খুব চাপ ছিল। তার মধ্যে একটা দিক হল আমাদের এই বাংলার ব্যাটিং অনেক গভীর। এরা বিভিন্ন ধরনের উইকেটে মানিয়ে নিতে পেরেছে।
কখনও গ্রিনটপে জিতেছে, কখনও টার্নিং ট্র্যাকে জিতেছে। ফাইনালে খেলেছে পাটা পিচে। বল পড়ে নিচু হচ্ছে যখন তখন। বাংলা জিততে না পারলেও এই লড়াইকে সম্মান করতেই হবে। দলের এই পারফরম্যান্সের পিছনে অরুণ লালের বড় অবদান রয়েছে। এত বড় একটা রোগ থেকে উঠে এসেছে অরুণ। লড়াকু মানসিকতা ছড়িয়ে দিয়েছে সবার মধ্যে। তাই এত বড় রান তাড়া করতে নেমেও ঘাবড়ে যায়নি দল। রণদেব, জয়দীপ-সহ সাপোর্ট স্টাফদের কথাও বলতে হবে।
দত্তাত্রেয় মুখোপাধ্যায়: এই দলটার সবচেয়ে বড় গুণ হল চাপের মধ্যেও নিজেদের উজাড় করে দেওয়ার ক্ষমতা। বৃহস্পতিবার রাতে মনে হচ্ছিল ম্যাচটা ফিফটি-ফিফটি। উইকেট এমনই যে কখনওই থিতু হওয়া যায় না। একশো বল খেলে ফেলার পরেও যে কোনও মুহূর্তে আউট হয়ে যেতে পারে ব্যাটসম্যান। বল এমন টার্ন নিচ্ছিল যে, স্লিপের পাশ দিয়ে বল বেরিয়ে যাচ্ছিল। এটা অদ্ভুত টাইপের পিচ। বাংলার ব্যাটিংয়ের প্রশংসা করতেই হবে। এই সৌরাষ্ট্রই যদি রান তাড়া করতো, তা হলে চারশো রানের চাপে ওরা দুশোয় গুটিয়ে যেত। সেই জায়গায় বাংলা তো সৌরাষ্ট্রের রানের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।