গোলের পর ফোরলান। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
মুম্বই সিটি- ১ (ফোরলান) এটিকে-০
দিয়েগো ফোরলান যখন নিখুঁত প্লেসিংয়ে গোলটা করলেন, রবীন্দ্র সরোবরের ভিভিআইপি বক্সে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন থিয়েরি অরিও!
হাততালিটা ফ্রান্সের সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার মঙ্গলবারের স্কোরারকে কুর্ণিশ জানাতে দিচ্ছিলেন, না বিস্মিত হয়ে, তাঁর মুখাবয়ব দেখে ঠিক বোঝা গেল না ।
তবে ম্যাচের শেষে অঁরির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলতে দেখা গেল ফোরলানকে। আলোচনার বিষয় কী ছিল তা নিয়ে দু’জনের কেউই মুখ খুলছেন না। তবে ওই মুহূর্তটায় দু’জনের সামনে থাকা এক টিভি ভাষ্যকারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, কুশল বিনিময়ের পর অঁরি নাকি বিশ্বকাপের সোনার বলজয়ী উরুগুয়ান তারকাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘মাঠে এটাই কী তোমার শেষ বছর?’’ উত্তরে ফোরলান বিখ্যাত ফরাসির দিকে একটা হাসি দিয়ে ফিরে গিয়েছেন ড্রেসিংরুমে।
উনআশি মিনিট পর্যন্ত যাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল ম্যাচে শো-পিস, একটা ব্যাক হিলে বল তোলা ছাড়া আর গুটিকয়েক পাস দেওয়া ছাড়া কোনও চমক ছিল না যাঁর খেলায়, সেই মুম্বই স্ট্রাইকারকে ম্যাচ জিতিয়ে ড্রেসিংরুমে ফেরার সময় দেখে মনে হচ্ছিল, ‘বুড়োদের বাতিল করো’ আইএসএলে হঠাৎ ওঠা জোরাল স্লোগানটা মুছে দিতে পেরে তিনি তৃপ্ত।
ভারতে আসার আগে কলামে ফোরলান লিখেছিলেন, ‘ফুটবলারদের জীবনের গড় আয়ু পনেরো বছর। এই ধারণাটা বদলাতে আইএসএল খেলতে যাচ্ছি।’ সেই লক্ষ্যে তিনি কতটা সফল হবেন, সেটা বুঝতে ডিসেম্বর হয়ে যাবে। তবে ‘বুড়ো হাড়ে ভেল্কি’ দেখানো লাইনটা এ দিনই ফোরলানের জন্য প্রয়োগ করা যেতে পারে। নিজের ট্রেড মার্ক ফ্রি কিকে চূড়ান্ত ব্যর্থ। তাঁর নেওয়া কর্নারগুলোও নিশানায় পড়ছিল না। এ দিক-ও দিক দৌড়েছেন আর বল না পেয়ে হতাশায় হাত-পা ছুড়েছেন। তা সত্ত্বেও গোলটা করার সময় কী নিখুঁত। কী দারুণ ঠান্ডা মাথা। তবে ফোরলান সৌভাগ্যবান, সনির শটটা বিপক্ষের তিরির গায়ে লেগে ডিফ্লেক্ট হয়ে ফোরলানের পায়েই গিয়ে পড়ে!
ভিয়ারিয়ালের জার্সিতে লা লিগায় সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন ফোরলান। কিন্তু কখনও হারাতে পারেননি জোসে মলিনাকে।আটলেটিকো কলকাতা কোচ তখন গোলকিপার ছিলেন দেপের্তিভোর। মুম্বইয়ের মার্কি তাঁকে এক বারও পরাস্ত করতে পারেননি। এটা নিয়ে ম্যাচের আগের দিন একান্তে নিজের গর্বের কথা জানিয়েছিলেন মলিনা। এ দিন কলকাতায় স্বপ্নপূরণ ফোরলানের। সঙ্গে আইএসএলে ছয় ম্যাচে এসে অপরাজিত থাকার জামাটাও খুলে নিলেন মলিনার দলের গা থেকে।
ফোরলান গোল করেছেন ঠিক। কিন্তু তিনি বেরোনোর সময় যতগুলো হাত এগিয়ে এল শুভেচ্ছা জানাতে, তাঁর দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসে ভাসল স্টেডিয়াম সনি নর্ডির জন্য। হয়তো মোহনবাগান সমর্থকদের হার্টথ্রব বলে। গ্যালারিতে এ দিন লালের পাশে কয়েকটা সবুজ-মেরুন পতাকাও উড়তেও দেখা গেল হাইতি ফুটবলারের জন্য। ফোরলান যদি ম্যাচটা জেতান তা হলে সনি ছিলেন মুম্বইয়ের আক্রমণের হৃদপিণ্ড। ব্রাজিলিয়ান আলভেজের সঙ্গে বারবার জায়গা বদল করে সনি চাপে ফেলে দিচ্ছিলেন কলকাতাকে। তাঁকে নিয়ে একটা ফাটকা খেলেছিলেন মুম্বই কোচ গুইমারেস। কলকাতা তাঁকে চেনে মিডিও হিসেবে। সনি কিন্তু এ দিন খেললেন স্ট্রাইকারে। ‘সনি, সনি’ চিৎকারের মধ্যে মাঠ ছাড়ার সময় নিজে বলেও গেলেন, ‘‘এটিকেকে বোকা বানানোর জন্য এটাই ছিল আমাদের কোচের প্ল্যান।’’
ফোরলানে মলিন মলিনা। মঙ্গলবার। ছবি: উৎপল সরকার।
কলকাতা কোচ আবার খুব একটা পাত্তা দেননি এ দিন ফোরলানকে। তাঁর স্ট্যাটেজি ছিল উরুগুয়ের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ডকে জোনাল মার্কিংয়ে রাখা। যেটা বোরহা আর পিয়েরসন করছিলেন পালা করে। গোলের সময়ের কয়েকটা সেকেন্ড ছাড়া তাতে সফলও কলকাতা। কিন্তু সনিকে ধরতে কালঘাম ছুটল এটিকের। ম্যাচটা যে কোনও দলই জিততে পারত। কলকাতা গোলকিপার দেবজিৎ মজুমদার ফের পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে ‘সেভজিৎ’ হলেন। নিয়ে গেলেন ‘মুহূর্ত সেরা’-র পুরস্কার। হিউম-দ্যুতি-লারারা গোলের প্রচুর সুযোগ পেয়েও ব্যর্থ। দ্যুতি বক্সের মধ্যে হুমড়ি খেলেন নিশ্চিত গোলের সুযোগ নষ্ট করে। মুম্বইও পেয়েছিল বেশ কয়েকটা গোলের সুযোগ। সনির দু’টো শট রুখলেন এটিকে কিপার।
মাঝমাঠ জমাট করে মুম্বইকে রুখতে চেয়েছিলেন মলিনা। চার ডিফেন্ডারের সামনে বোরহা আর পিয়েরসনকে রেখে। উইং প্লে-র বদলে কোনাকুনি বিপক্ষের বক্সে ঢোকার চেষ্টা দ্যুতি আর অবিনাশকে দিয়ে। তাতে সফস হয়েও হতে পারলেন না কলকাতার স্প্যানিশ কোচ। উল্টে গোল করে ফোরলান উচ্ছ্বাসে দৌড়ে এসে ভাসলেন তাঁর মুম্বই সতীর্থদের ঢেউয়ে। আর মলিনাকে পড়তে হল রেফারির রোষে।
প্রথমার্ধ থেকেই ব্রাজিলিয়ান রেফারির নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করছিলেন কলকাতা কোচ। ম্যাচ শেষ হওয়ার দু’মিনিট আগে সেটাই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলে ব্রাজিলিয়ান রেফারি স্যান্দ্রো রিকি গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিলেন হাবাসের উত্তরসূরিকে। যা খবর, তাতে পরের নর্থ-ইস্ট ম্যাচে সম্ভবত নেই মলিনা। এ দিন ম্যাচের পরে তাঁকে সাংবাদিক সম্মেলনে আসতে দেননি আইএসএল কমিটি। এটিকে কোচ মানেই কি নির্বাসনের খাঁড়া? এই প্রশ্ন কিন্তু উঠে গেল এ দিনের পরে!
মাঠে খেলছেন ফোরলানের মতো মহাতারকা। গ্যালারিতে অঁরির মতো কিংবদন্তি। মাঠে যাঁকে নামানো হল চার বার। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছবিও তোলানো হল ফোটোসেশনে। তা সত্ত্বেও বেশ কিছুটা ফাঁকা গ্যালারি উচ্ছ্বসিত হল না। যে কলকাতা মারাদোনাকে একবার চোখের দেখা দেখতে হামলে পড়ে, অলিভার কানের বিদায়ী ম্যাচ নিয়ে উদ্বেল হয়, সেখানে এই হাল কেন তা নিয়ে গবেষণা শুরু করে দেওয়া উচিত আইএসএল ভক্তদের। কিন্তু আপাতত যেটা মনে হচ্ছে, ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট তিনে পা দিতেই খেলায় সেই উত্তেজনা হয়তো পাচ্ছেন না দর্শক।
ফর্মেশনে চমক নেই, সেট পিসে বিষ নেই। গোলমুখী আগুনে শট নেই। তার উপর বেশির ভাগ টিমের মার্কি জগগ্বিখ্যাত কেউ নন। ফোরলান ছাড়া। সঙ্গে আবার আনোয়ার আলিদের মতো আই লিগ বাতিল ফুটবলারদের ভিড়। হয়তো সে জন্যও মাঠ অনেকটা ফাঁকা। আবার এও হতে পারে, কলকাতার একেবারে দক্ষিণে খেলা বলে দূর থেকে দর্শক আসছেন না। রাতে বাড়ি ফেরার অসুবিধের কথা ভেবে। মহিলা দর্শকদের ভিড় বা সপরিবার ফুটবল-উৎসবে যোগ দেবার তাগিদও আগের মতো দেখা যাচ্ছে না এ বার। যা যুবভারতীতে গত দু’বার অন্য রং দিয়েছিল এটিকে ম্যাচের। তবে ঠিক কী জন্য মাঠে আসার অনীহা বাংলার ফুটবল দর্শকদের, সেটা বোঝা যাবে বাংলার উৎসব-মরসুম শেষ হলেই!
ঘটনা যাই হোক, ম্যাচটায় কিন্তু পাওয়া গেল অন্য রকম ময়দানি আমেজ। মুম্বইয়ের সনিকে যখন কলকাতার অর্ণব আর রবার্ট আটকাতে বারবার মরিয়া হচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল আইএসএল নয়, কলকাতা ডার্বি হচ্ছে। মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল! আবার যখন সনির অসাধারণ শট চমকপ্রদ আটকালেন দেবজিৎ,মনে হচ্ছিল সঞ্জয় সেনের টিমের ম্যাচ প্র্যাকটিস দেখছি!
তবে কঠিন বাস্তব হল, কলকাতাকে হারিয়ে মুম্বই চলে গেল লিগ টেবলের এক নম্বরে। দুই থেকে তিনে নেমে কলকাতা যাচ্ছে গুয়াহাটি অভিযানে। সেখানে আবার মলিনার টিমে আলো ফেরে কি না দেখার। জন আব্রাহামের নর্থ-ইস্টের বিরুদ্ধে খেলা যে আবার দীপাবলির আগের দিনই!
আটলেটিকো দে কলকাতা: দেবজিৎ, প্রবীর, অর্ণব (ডিকা), তিরি, রবার্ট, বোরহা, দ্যুতি, অবিনাশ (বিদ্যানন্দ), পিয়েরসন (ব্যালেনকোসে), লারা, হিউম।