Mohun Bagan

বসে থাকতে হচ্ছে জাতীয় দলের ফুটবলারদের, কঠিন হচ্ছে মোহনবাগানের প্রথম দলে ঢোকা

কারা খেলবেন প্রথম একাদশে? মোহনবাগান দলে জায়গা পেতে দলের মধ্যেই চলে এক অদৃশ্য লড়াই। পরিস্থিতি এমনই যে, সবুজ-মেরুনের বেঞ্চে এখন বসে থাকতে হচ্ছে জাতীয় দলের ফুটবলারদের।

Advertisement

দেবার্ক ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:৫০
Share:

মোহনবাগানের প্রথম একাদশ। ১১ জনের দলে ঢুকতে চলছে জোর লড়াই। ছবি: সমাজমাধ্যম।

তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে পালতোলা নৌকা। আইএসএলে টানা সাতটি ম্যাচে অপরাজিত মোহনবাগান। তার মধ্যে ছ’টি ম্যাচ জিতেছে তারা। কোনও এক জন বা দু’জনের দক্ষতায় নয়, বাগান জিতেছে দলগত খেলায়। যে ম্যাচে যে ১১ জনকে খেলানো দরকার তাঁদের খেলিয়েছেন কোচ হোসে মোলিনা। প্রথম একাদশ গোল করতে না পারলে পরিবর্ত খেলোয়াড়েরা দলকে জিতিয়েছেন। চোট বা কার্ড সমস্যা— কোনও কিছুই চাপে রাখতে পারেনি তাদের। সেই কারণেই ১০ ম্যাচ শেষে পয়েন্ট তালিকায় সকলের উপরে মোহনবাগান। তাদের পরিস্থিতি এখন এমনই যে, প্রথম একাদশে জায়গা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। আশিক কুরুনিয়ান, অনিরুদ্ধ থাপার মতো ভারতীয় দলে নিয়মিত খেলা ফুটবলার বাগানের বেঞ্চে বসে থাকছেন। বদলে দীপেন্দু বিশ্বাসের মতো তরুণ ফুটবলার নিয়মিত খেলছেন।

Advertisement

রক্ষণ

বাগানের রক্ষণ এখন জমাট। এ বারের আইএসএলে এখনও পর্যন্ত ১০টি ম্যাচ খেলেছে তারা। গোল খেয়েছে মাত্র ৮টি। ছ’টি ম্যাচে কোনও গোল খায়নি বাগানের রক্ষণ। মহমেডান স্পোর্টিং, ইস্টবেঙ্গল, জামশেদপুর, হায়দরাবাদ, চেন্নাইয়িন ও নর্থইস্ট তাদের জালে বল জড়াতে পারেনি। এর কৃতিত্ব যেমন গোলরক্ষক বিশাল কাইথের প্রাপ্য, তেমনটাই রক্ষণের। এ বার বাগানের রক্ষণে পুরনো মুখ অধিনায়ক শুভাশিস বসু ও আশিস রাই। বাকিরা নতুন। আলবের্তো রদ্রিগেস ও টম অলড্রেডের জুটি ধীরে ধীরে নিজেদের জায়গা পাকা করে নিয়েছে। তাঁদের বোঝাপড়া দারুণ।

Advertisement

তবে সেখানেও রয়েছে লড়াই। রবিবার নর্থইস্টের বিরুদ্ধেই কার্ড সমস্যায় খেলতে পারেননি রদ্রিগেস ও শুভাশিস। পরিবর্ত হিসাবে কারা খেলেন সে দিকে নজর ছিল। পরীক্ষিত দীপক টাংরিকে শুরু থেকে নামাতে পারতেন কোচ। কিন্তু খেলাননি। অনেক পরে নামিয়েছেন। পরিবর্তে এত দিন সাইড ব্যাকে খেলা দীপেন্দুকে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারের জায়গায় খেলিয়েছেন। দুই সাইড ব্যাকে খেলিয়েছেন আশিস ও আশিককে। দীপেন্দু ও আশিক দু’জনেই অনভ্যস্ত জায়গায় খেলেছেন। কিন্তু নিজের কাজ করেছেন। প্রতিপক্ষকে গোল করতে দেননি। মোলিনা জানতেন নর্থইস্টের আলাদিন আজারাইয়ের গতি আটকাতে আশিসকে দরকার। আশিস নিজের কাজ মন দিয়ে করেছেন। আশিক আবার রক্ষণের পাশাপাশি আক্রমণেও উঠেছেন।

বিশাল কাইথ। গোলরক্ষকের হাতে ছ’টি ম্যাচে গোল খায়নি মোহনবাগান। ছবি: সমাজমাধ্যম

বাগান কোচ মোলিনা জানিয়েছেন, পরিবর্ত ফুটবলারেরা সুযোগ পেয়ে যে খেলাটা খেলছেন তাতে বাকিদের উপর চাপ বাড়ছে। একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। এটাই তিনি চেয়েছিলেন। মোলিনা বলেন, “আমি দলে ১১ জন ফুটবলার চাই না। ২৬ জন ফুটবলার চাই। যে-ই মাঠে নামুক, তাকে লড়াই করতে হবে, ভাল খেলতে হবে। সেই জায়গাতেই ক্রমশ পৌঁছচ্ছি আমরা। এই ম্যাচে আশিক ও আশিস প্রমাণ করে দিয়েছে, ওরা কত ভাল খেলোয়াড়। এতে দলের মধ্যে প্রতিযোগিতাও আরও বাড়ল। এ বার প্রথম দলে জায়গা ধরে রাখার জন্য আলবের্তো, শুভাশিসদের আরও পরিশ্রম করতে হবে।” কোচের কথা থেকেই স্পষ্ট, বাগানে প্রথম একাদশে ঢোকার লড়াই কতটা কঠিন হচ্ছে।

মাঝমাঠ

রক্ষণের মতো মাঝমাঠেও লড়াই চলছে। অনিরুদ্ধ শুরুর দিকের কয়েকটি ম্যাচে খেললেও এখন আর প্রথম একাদশে শুরু করছেন না। বদলে নিজের জায়গা পাকা করেছেন সাহাল আব্দুল সামাদ। প্রতিটি ম্যাচে ভাল খেলছেন তিনি। আপুইয়াও ভরসা দিচ্ছেন কোচকে। দুই উইঙ্গার লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিংহ দুরন্ত ছন্দে রয়েছেন। গোলের সুযোগ তৈরি করার পাশাপাশি গোলও করছেন তাঁরা। নর্থইস্টের বিরুদ্ধে দু’জন দুর্দান্ত দু’টি গোল করে বাগানকে জিতিয়েছেন। ফরোয়ার্ডরা গোল না পেলেও তাই মোলিনার সমস্যা হচ্ছে না।

মাঝমাঠে লড়াই রয়েছে বাগানের দুই বিদেশি গ্রেগ স্টুয়ার্ট ও দিমিত্রি পেত্রাতোসের। দিমি দলের পুরনো অস্ত্র। স্টুয়ার্ট নতুন। মরসুমের শুরুতে চোট ছিলেন দিমি। ফলে প্রথম কয়েকটি ম্যাচে পরিবর্ত হিসাবে নামছিলেন তিনি। স্টুয়ার্ট শুরু থেকে খেলছিলেন। তিন ম্যাচ আগে স্টুয়ার্ট চোট পেয়েছেন। ফলে এখন দিমি শুরু করছেন। তবে স্টুয়ার্টকে যখন দরকার তখন খেলিয়ে নিয়েছেন কোচ। গত ম্যাচে অনেক চেষ্টা করেও চেন্নাইয়িনের বিরুদ্ধে গোল করতে পারছিল না মোহনবাগান। বাধ্য হয়ে শেষ দিকে স্টুয়ার্টকে নামান মোলিনা। প্রথম মিনিটেই তাঁর পাস থেকে গোল করেন জেসন কামিংস। আবার যে ম্যাচে তাঁকে দরকার নেই সেই ম্যাচে স্টুয়ার্টকে বিশ্রাম দিচ্ছেন মোলিনা।

গ্রেগ স্টুয়ার্ট। বাগানের মাঝমাঠকে চালান এই বিদেশি। ছবি: সমাজমাধ্যম।

আক্রমণ

মোহনবাগান এ বার গোলের জন্য কোনও এক জনের উপর নির্ভর করছে না। গত মরসুমে বাগানের গোলের দায়িত্ব ছিল তিন বিদেশি পেত্রাতোস, কামিংস ও আর্মান্দো সাদিকুর উপর। সাদিকু এ বার গোয়াতে। পরিবর্তে এসেছেন জেমি ম্যাকলারেন। অস্ট্রেলিয়ার এই ফরোয়ার্ড শুরু থেকেই নিজের জাত চেনাচ্ছেন। প্রথম কয়েকটি ম্যাচ পুরো না-খেললেও ধীরে ধীরে ফিট হয়ে উঠেছেন। গোল করছেন। যে ম্যাচে তিনি গোল করতে পারছেন না, সেই ম্যাচে পরিবর্ত হিসাবে নামছেন কামিংস। গোল করছেন। দলকে জেতাচ্ছেন। আবার, সেটপিস থেকে অলড্রেড, শুভাশিসরাও গোল করছেন।

জেসন কামিংস। যখনই সুযোগ পান কোচের ভরসার দাম দেন অস্ট্রেলীয় ফুটবলার। ছবি: সমাজমাধ্যম।

গত বছর মোহনবাগানের আইএসএল জয়ের নেপথ্যে কামিংসের সঙ্গে পেত্রাতোসের জুটির অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। দল যে ৪৭টি গোল করেছিল, তার মধ্যে এই দু’জনই করেছিলেন ২২টি। এ বার কামিংসকে প্রথম দলে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, দলে তৃতীয় অস্ট্রেলীয় ম্যাকলারেন এসে গিয়েছেন। তিনিই মূলত শুরু থেকে খেলছেন পেত্রাতোসের সঙ্গে। নতুন ভূমিকায় মানিয়ে নিতে তাঁর কোনও সমস্যা হচ্ছে না বলেই আনন্দবাজার অনলাইনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন পেত্রাতোস। তিনি বলেছিলেন, ‘‘তফাত অবশ্যই আছে। সেটাই স্বাভাবিক। নতুন কিছু হলে সেটা থিতু হতে সময় লাগে। যত খেলব, আমাদের বোঝাপড়া তত বাড়বে। আমরা দল হিসাবে খেলি। কে খেলল, কে খেলল না, সেটা আলাদা করে তফাত তৈরি করে দেয় না।’’ গত বার সামনে খেললেও এ বার একটু পিছন থেকে খেলছেন পেত্রাতোস। তাঁর কাজ খেলা। সেটাই করছেন তিনি। পেত্রাতোসের কথায়, ‘‘আমি ফুটবলার। যে কোনও জায়গায় খেলতে তৈরি। কোচ যদি পিছন থেকে খেলান, খেলাতে পারেন। আমার উইং বা মাঝমাঠে খেলতেও আপত্তি নেই। আমার কাজ হল শুধু খেলা।’’

দিমিত্রি পেত্রাতোস। জায়গা বদলালেও জাত বদলায়নি এই বিদেশির। ছবি: সমাজমাধ্যম।

যে ফুটবলার যখন সুযোগ পাচ্ছেন, নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কারণ, প্রত্যেকেই চাইছেন প্রথম একাদশে জায়গা করতে। এ বার বাগানের প্রথম একাদশে খেলেছেন মোট ১৭ জন ফুটবলার। তার থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কোনও এক জনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা চাইছেন না কোচ মোলিনা। তিনি চাইছেন, দলগত খেলার ফসল তুলতে। সেই কারণেই প্রথম একাদশে জায়গা পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়ছে।

মোলিনার লক্ষ্য আইএসএল লিগশিল্ড জেতা। তার জন্য প্রতিটি ম্যাচে জেতার লক্ষ্য নিয়েছেন মোলিনা। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য আরও ভাল ফুটবল খেলতে হবে বাগানকে। কোচের মতে, লড়াইয়ের জন্য ফুটবলারদের তৈরি থাকতে হবে। তিনি বলেন, “আমাদের সব বিভাগেই আরও উন্নতি করতে হবে। আক্রমণ, রক্ষণ, সেটপিস সব কিছুতেই দলকে আরও উন্নত করে তুলতে চাই আমি। প্রতি দিন প্রচণ্ড খাটলেও নিখুঁত হতে পারব না। কারণ, আমরা মানুষ। প্রতি দিনই উন্নতি করার চেষ্টা করতে হবে। তবে যেটুকু উন্নতি হয়েছে, তাতে আমি খুশি।”

রবিবার নর্থইস্ট ইউনাইটেডকে ২-০ গোলে হারিয়েছে মোহনবাগান। এই নর্থইস্টের বিরুদ্ধেই ডুরান্ড কাপের ফাইনালে হেরেছিল মোহনবাগান। আইএসএলের প্রথম ম্যাচেও ঘরের মাঠে নর্থইস্টের বিরুদ্ধে খেলেছিল তারা। পাহাড়ের এই ক্লাবের ফুটবলার আলাদিন আজারেই দুরন্ত ফর্মে রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন তিনি। কিন্তু রবিবার বাগানের রক্ষণে আটকে গিয়েছেন তিনি। মোলিনা জানিয়েছেন, শুধু আজারেই নন, সকলের জন্য আলাদা করে পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। বাগান কোচ বলেন, “আজারেই বড় ফুটবলার। কিন্তু কোনও এক জন ফুটবলারকে আটকানোর জন্য পরিকল্পনা করি না আমি। পুরো দলের জন্য পরিকল্পনা করি। আজারেই ছাড়াও ওদের গিলেরমো, নেস্টর, জিতিন সকলেই ভাল ফুটবলার। ওদের বিরুদ্ধে ডুরান্ড কাপের ফাইনালে হেরেছিলাম আমরা। লিগের প্রথম ম্যাচে ওরা আমাদের চাপে ফেলে দিয়েছিল। এই ম্যাচেও জিততে পেরে খুশি। এর মানে আমরা ঠিকই এগোচ্ছি। আমাদের পরিশ্রম সফল হচ্ছে।”

হোসে মোলিনা। তাঁর হাতেই এগিয়ে চলেছে মোহনবাগান। ছবি: সমাজমাধ্যম।

মনবীর সিংহ ও লিস্টন কোলাসোর দুরন্ত গোলে বাগান জিতলেও এই জয়ের নেপথ্যে বড় ভূমিকা রয়েছে গোলরক্ষক বিশাল কাইথের। বেশ কয়েকটি অবধারিত গোল বাঁচিয়েছেন তিনি। তাঁরও প্রশংসা করেছেন কোচ। মোলিনা বলেন, “বিশাল আজ দারুন খেলেছে। অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ও আমাদের বাঁচিয়েছে। শেষ মিনিটেও একটা সেভ করেছে। দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ওর। হয়তো আমরা আরও গোল পেতাম। তবে এই ফলে আমি খুশি। তিন পয়েন্ট পাওয়ায় খুশি। এ বার কেরল ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ম্যাচের জন্য ভাবনা শুরু করতে হবে।”

১৪ ডিসেম্বর, শনিবার মোহনবাগানের পরের ম্যাচ। ঘরের মাঠে কেরল ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে খেলতে নামবে তারা। এখন থেকেই সেই ম্যাচের পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছেন মোলিনা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement