ট্রেভিস হেডকে (বাঁ দিকে) আউট করে অঙ্গভঙ্গি করছেন মহম্মদ সিরাজ। পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছেন রোহিত, কোহলি। —ফাইল চিত্র।
কোনও রকম বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করতে চাইছে না আইসিসি। অ্যাডিলেডে দিন-রাতের টেস্টে বিবাদে জড়িয়েছেন মহম্মদ সিরাজ ও ট্রেভিস হেড। দুই ক্রিকেটারকেই সমান দোষী মনে করছে আইসিসি। শাস্তি হতে পারে তাঁদের। সোমবার আইসিসির শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বৈঠক রয়েছে। সেই বৈঠকের পরেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে তারা।
অ্যাডিলেডে টেস্টের দ্বিতীয় দিন ১৪০ রানের মাথায় হেডকে বোল্ড করেন সিরাজ। তার পরে উত্তেজিত অঙ্গভঙ্গি করেন তিনি। সিরাজের এই ব্যবহার পছন্দ হয়নি হেডের। তিনি সাজঘরে ফেরার সময় পাল্টা সিরাজকে কিছু বলেন। সেই ঘটনার রিপোর্ট ম্যাচ রেফারির কাছে জমা দিয়েছেন আম্পায়ারেরা। জানা গিয়েছে, শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির চোখে দুই ক্রিকেটারই সমান দোষী। তাই দু’জনকেই শাস্তি দেবেন তাঁরা। তবে তাঁদের নিলম্বিত করা হবে না বলেই জানা গিয়েছে। আর্থিক শাস্তির মুখে পড়তে হবে তাঁদের। অর্থাৎ, দুই ক্রিকেটারেরা ম্যাচ ফি কেটে নেওয়া হবে। মৌখিক ভাবে সতর্কও করা হবে সিরাজ ও হেডকে। ভবিষ্যতে আবার এই ধরনের ঘটনা হলে তখন আরও বড় শাস্তি পেতে হতে পারে তাঁদের।
সিরাজ-হেড বিতর্কের রেশ এখনও কমেনি। হেড দাবি করেছিলেন, তিনি সিরাজকে খারাপ কিছু বলেননি। বলেছিলেন, “ভাল বল করেছ।” কিন্তু সিরাজ তা বুঝতে পারেননি। তৃতীয় দিনের খেলা শুরুর আগে সেই বিতর্কে ঘি ঢালেন সিরাজ। হরভজন সিংহের সঙ্গে আলোচনার মাঝে ভারতীয় পেসার জানিয়ে দেন যে হেড অসত্য বলছেন। এই বিতর্কের মাঝে সিরাজের পাশে দাঁড়িয়েছেন রোহিত। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ক্রিকেটে এই ধরনের ঘটনা দেখা যায়। সিরাজ কাউকে অসম্মান করেননি। ফলে তাঁর দায়িত্ব সিরাজের পাশে থাকা। রোহিত বলেন, “সিরাজ লড়াই পছন্দ করে। এতে ও সফলও হয়। অধিনায়ক হিসাবে আমার কাজ ওর এই আগ্রাসনের পাশে থাকা। আগ্রাসন ও তা করতে গিয়ে কাউকে অসম্মানের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম রেখা থাকে। সেই রেখা সিরাজ টপকায়নি। খেলার মাঝে এই ধরনের ঘটনা ঘটেই থাকে।”
রোহিত আরও জানিয়েছেন, যত ক্ষণ না তাঁর দলের কেউ সেই রেখা টপকাচ্ছে, তত ক্ষণ তিনি সকলের পাশে থাকবেন। ভারত অধিনায়ক বলেন, “অধিনায়ক হিসাবে আমার কাজ এটা দেখা যে কেউ সেই রেখা টপকাচ্ছে কি না। তার আগে পর্যন্ত আমি আমার দলের ক্রিকেটারদের পাশেই থাকব। একটা-দুটো কথা কাটাকাটিতে এমন কিছু প্রভাব পড়ে না।”
বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছেন না ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার হরভজন। হায়দরাবাদ পুলিশে সাম্মানিক ডেপুটি সুপারের পদে রয়েছেন সিরাজ। তাই তাঁর সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি মজার ছলে সিরাজকে বলেন, “ডিএসপি সাহেব, এর পর যখন হেড হায়দরাবাদে যাবে তখন ওকে গ্রেফতার করে নিয়ো।” আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদেই খেলেন হেড। অর্থাৎ, সিরাজের ঘরের মাঠেই তাঁকে খেলতে হবে। এই বিতর্ক যদি আরও বাড়ে তা হলে আইপিএলে ঘরের মাঠেই বিদ্রুপের সামনে পড়তে হতে পারে হেডকে।
সিরাজকেও বিদ্রুপের মুখে পড়তে হয়েছে। অ্যাডিলেড হেডের ঘরের মাঠ। তাই সেখানে হেডের সঙ্গে কথা-কাটাকাটির পর দেখা যায়, সিরাজকে বিদ্রুপ করছেন দর্শকেরা। পরে বাউন্ডারিতে ফিল্ডিং করার সময়ও সিরাজকে বিদ্রুপের মুখে পড়তে হয়। যদিও তাতে সিরাজ পাল্টা কাউকে কিছু বলেননি। এই ঘটনা নিয়ে কোনও অভিযোগও করেননি তিনি।
অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা অবশ্য সিরাজের ব্যবহার ভাল ভাবে নিচ্ছেন না। তাঁদের মতে, সিরাজ ক্রিকেটকে অসম্মান করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক মার্ক টেলর বলেন, “আমি জানি না ও কেন এতটা উত্তেজিত হয়ে গেল। সিরাজ ভাল বোলার। কিন্তু আমি আগেও দেখেছি প্যাডে বল লাগলেই ও উল্লাস করতে শুরু করে। এক বারও দেখে না যে আম্পায়ার আউট দিয়েছে কি না। এতে ক্রিকেট খেলা ও আম্পায়ারকে অসন্মান করা হয়।”
টেলরের মতে, সেই পরিস্থিতিতে দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের উচিত ছিল সিরাজকে বোঝানো। কারণ, এই ঘটনার রেশ বজায় থাকলে পরের টেস্টগুলিতেও তার প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তিনি। টেলর বলেন, “আমার মনে হয়, রোহিত বা বিরাটের মধ্যে কারও উচিত ছিল সিরাজকে গিয়ে বিষয়টা বোঝানো। আগ্রাসন ভাল। কিন্তু তাই বলে কাউকে অসম্মান করা উচিত নয়। সিরাজের কেরিয়ার এখনও খুব লম্বা হয়নি। দীর্ঘ দিন ক্রিকেট খেলতে হলে এটা ওকে বুঝতে হবে।”
অস্ট্রেলিয়ার আর এক অধিনায়ক রিকি পন্টিং আবার মনে করেন, আম্পায়ারদের উচিত ছিল সিরাজকে সতর্ক করা। ভারতীয় পেসারের শাস্তি হতে পারে বলেই মনে করেন তিনি। পন্টিং বলেন, “আমরা আগে এই ধরনের উল্লাস দেখতাম। এখন নিয়ম অনেক কড়া। মাঠে কেউ আগ্রাসন দেখালে আম্পায়ারেরা সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে তাকে সতর্ক করে। কিন্তু সিরাজের ঘটনার পর তেমন কিছু দেখলাম না। তবে আমার মনে হয় আম্পায়ারেরা সব কিছু নজরে রেখেছে। ও শাস্তি পেতে পারে।”
এই বিতর্ক যখন বাড়ছে তখন হেড দাবি করেছেন যে সিরাজের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে ফেলেছেন তিনি। তৃতীয় দিন সিরাজ ব্যাট করতে নামার সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁদের। বিতর্ক জিইয়ে রাখতে চান না তাঁরা। হেড বলেন, “সিরাজ ব্যাট করতে নামার সময় আমাদের কথা হয়েছে। ও বলেছে, ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। আমাদের সব ভুলে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আমিও তাতে রাজি হয়েছি। ও অবশ্য বলেছে, আমি গালাগাল কেন করেছি। জবাবে আমি বলেছি, প্রথমে আমি কিছু বলিনি। কিন্তু ওর ওই আগ্রাসন দেখে মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলাম। মাঠে এ সব হতেই পারে। আমরা দু’জনেই মিটিয়ে নিয়েছি।”
হেডের দাবি আগেই খারিজ করে দিয়েছেন সিরাজ। শনিবার খেলার শেষে হেড বলেছিলেন, তিনি সিরাজকে খারাপ কিছু বলেননি। কিন্তু সিরাজ তা বুঝতে পারেননি। হেড বলেন, “আমি ওকে বলি, ভাল বল করেছ। কিন্তু সিরাজ ভাবে আমি খারাপ কিছু বলেছি। তা-ও সিরাজ ও রকম অঙ্গভঙ্গি করে। আমিও পাল্টা জবাব দিয়েছি। ও যেটা করেছে সেটা আমার খারাপ লেগেছে। তবে ও যদি ভাবে এ ভাবেই খেলবে, তা হলে আমার কোনও সমস্যা নেই।” অসি ব্যাটারের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন সিরাজ। তৃতীয় দিনের খেলা শুরুর আগে হরভজন সিংহকে সিরাজ বলেছেন, ‘‘হেড আমাকে কখনওই বলেনি, ‘ভাল বল করেছ।’ সাংবাদিক বৈঠকে হেড যা বলেছে, তা সত্যি নয়। আমি অসম্মানজনক কোনও মন্তব্য করিনি। উইকেট পেয়ে উৎসব করছিলাম। আমরা পরস্পরকে সম্মান করি। তার মানে এই নয় প্রতিপক্ষের সব কিছু মেনে নিতে হবে। ক্রিকেট খেলাটা ভদ্র লোকের। ওর মন্তব্য আমার ভাল লাগেনি। আমরা ইতিবাচক মানসিকতা নিয়েই খেলছি।’’ হেডের নতুন দাবি নিয়ে সিরাজ এখনও কিছু বলেননি। ফলে বিতর্ক সত্যিই মিটেছে, না হেড মেটানোর চেষ্টা করছেন তা পরিষ্কার নয়। তার মাঝেই এ বার শাস্তির খাঁড়া নেমে আসতে পারে দুই ক্রিকেটারের উপর।