প্রহরী: বাংলার ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা সনৎ শেঠ। ফাইল চিত্র।
সনৎ শেঠ ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা নয়, শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক বলে মনে করি আমি। তাই ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে ভারতীয় দলে ওর জায়গা না পাওয়ার খবর শুনে আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। কেঁদে ফেলেছিলাম। সনৎ ছিল আমার ছোট ভাইয়ের মতো। শুক্রবার সকালে ওর মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই অস্থির লাগছে।
মেলবোর্ন রওনা হওয়ার আগে দীর্ঘ দিন ধরে তিন পর্বে ট্রায়াল হয়েছিল আমাদের। প্রথমে কেরলে সন্তোষ ট্রফি থেকে প্রাথমিক দল বেছে নেওয়া হয়েছিল। তার পরে মাদ্রাজে (এখন চেন্নাই) অনুশীলন হয়েছিল। আমাদের কোচ ছিলেন কিংবদন্তি রহিম সাহেব (সৈয়দ আব্দুল রহিম)। শেষ পর্বের শিবির হয়েছিল কলকাতায়। চূড়ান্ত দল নির্বাচন হয়েছিল ধর্মতলার কাছে একটি হোটেলে। জানতাম, আমি দলে থাকবই। তবুও মনের মধ্যে উথাল-পাথাল হচ্ছিল। হোটেলের বাইরে গাড়ির মধ্যে বসেছিলাম। রাত তখন প্রায় ন’টা। হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেন রহিম সাহেব। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আমাকে বললেন, ‘‘তুমি শুধু দলে জায়গা পাওনি, অধিনায়কও নির্বাচিত হয়েছ।’’ একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আর কারা রয়েছে দলে? রহিম সাহেব প্রদীপ (পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়), বলরাম (তুলসীদাস), থঙ্গরাজ (পিটার), কিট্টু (কৃষ্ণ) থেকে নুর মহম্মদ— গড়গড় করে নামগুলি বলে থামলেন। আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, আপনি সনতের নামটাই বলতে ভুলে গেলেন! নিচু স্বরে রহিম সাহেব বললেন, ‘‘সনৎ নির্বাচিত হয়নি।’’ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হল যেন মাথায় বাজ পড়ল। সনতের মতো গোলরক্ষককে ছাড়া কী করে অলিম্পিক্সের মতো প্রতিযোগিতায় খেলবে ভারতীয় দল?
অধিনায়ক হওয়ার আনন্দ ততক্ষণে মন থেকে উবে গিয়েছে। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল তখন। ভাবছিলাম, কী ভাবে সনতের মুখোমুখি হব? কী করে ওকে বলব মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে তোর খেলা হবে না? রাস্তায় দাঁড়িয়েই কেঁদে ফেলেছিলাম সেই রাতে। কারণ, কয়েক বছরের ছোট হলেও সনৎ ছিল আমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। গত কয়েক মাস ধরে আমরা সকলেই ট্রায়ালে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিলাম। অসাধারণ খেলেছিল সনৎ-ও। সব সময়ই ওকে আমার বিপক্ষ দলে খেলাতেন রহিম সাহেব।
অবিশ্বাস্য নমনীয় ছিল ওর শরীর। শূন্যে উড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে যে ভাবে বল ধরত, তাতে সনতের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘বাজপাখি’। ওর ক্ষিপ্রতা ছিল ভয়ঙ্কর।সনৎকে গোল দেওয়া রীতিমতো কঠিন কাজ। মনে আছে, ও প্রথম পোস্টের কাছে ছিল। সেটা দেখেই দ্বিতীয় পোস্টে বল মেরেছিলাম। একেবারে কোণ দিয়ে বলটা গোলে ঢুকছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম গোল হবেই। হঠাৎ দেখলাম, সনৎ কোথা থেকে উড়ে এসে বলটা ধরে নিল। অবিশ্বাস্য! আরও একটা বড় গুণ ছিল, এগিয়ে এসে বিপক্ষের পা বা মাথার উপর থেকে বল কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা। বাড়তি ডিফেন্ডারের কাজ ও-ই করে দিত।
রহিম সাহেবও খুব পছন্দ করতেন সনৎ-কে।তা হলে কেন বাদ পড়েছিল? আসলে সনৎ ছিল প্রচণ্ড সৎ। কখনও কারও তাঁবেদারি করেনি। এটাই ওর কাল হয়েছিল। রাজনীতির শিকার হয়ে শেষ মুহূর্তে অলিম্পিক্সগামী ভারতীয় ফুটবল দল থেকে বাদ পড়েছিল। পরে শুনেছিলাম, ইস্টবেঙ্গলের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে এরিয়ানে থেকে গিয়েছিল ও। লাল-হলুদ কর্তাদের আপত্তিতেই নাকি অলিম্পিক্স ট্রায়ালের আগে জাতীয় প্রতিযোগিতার একটা ম্যাচেও খেলার সুযোগ পায়নি। সেটাই নাকি জাতীয় দলে নির্বাচিত না হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল। সনৎ নিজেও তা মনে করত। আমার কাছে সবচেয়ে কঠিন ছিল ওকে দল থেকে বাদ পড়ার খবরটা দেওয়া। বুঝতেই পারছিলাম না, কী করে বলব। মনে অনেক জোর এনে রাতে আড্ডার আসরে মাথা নিচু করে সনৎকে দুঃসংবাদটা দিলাম। ক্ষমাও চাইলাম। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘‘তোমার জন্য গর্বিত।’’ অলিম্পিক্স থেকে ফেরার পরে বহু বার আমাদের দেখা হয়েছে। কিন্তু ও এই প্রসঙ্গে আলোচনাই করতে চাইত না।
সেই অভিমান বুকে নিয়েই চিরবিদায় নিল সনৎ।