দিমিত্রি পেত্রাতোসের গোলের পর মোহনবাগানের গ্যালারি। ছবি: টুইটার।
মোহনবাগান ১ (দিমিত্রি পেত্রাতোস)
ইস্টবেঙ্গল ০
বদলা নিল মোহনবাগান!
ডুরান্ড কাপের শুরুতে গ্রুপ পর্বের ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গলের কাছে হেরে গিয়েছিল তারা। ফাইনালে সেই লাল-হলুদকেই হারিয়ে ১৭ বারের জন্যে এই ট্রফি ঘরে তুলল তারা। এত দিন ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে যৌথ ভাবে ১৬ বার ডুরান্ড কাপ জিতেছিল মোহনবাগান। এ বার লাল-হলুদকে টপকে তারাই সবচেয়ে বেশি ডুরান্ড জিতল। রবিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে মোহনবাগানের হয়ে একমাত্র গোল করলেন দিমিত্রি পেত্রাতোস। ম্যাচের শেষ আধ ঘণ্টা দশ জনে খেলে মোহনবাগান শুধু জিতলই না, গোলও করল। টানা আটটি ডার্বি জেতার পরে হেরে গিয়েছিল তারা। আবার ইস্টবেঙ্গলকে হারাল সবুজ-মেরুন।
তবে ম্যাচ যে একতরফা হয়েছে তা কোনও ভাবেই বলা যাবে না। গোটা ম্যাচ জুড়েই দু’দলের আক্রমণ এবং প্রতি আক্রমণ লক্ষ্য করা গিয়েছে। ইস্টবেঙ্গল বেশ কিছু সুযোগ পেয়েছে। কাজে লাগাতে পারলে এই ম্য়াচ তারাই জিততে পারব। মোহনবাগানের চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছেন ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা। অতীতে যে ভাবে ডার্বি হলেই একপেশে জিতত মোহনবাগান, তা এ দিন হয়নি।
এই ডার্বি বুঝিয়ে দিয়েছে ইস্টবেঙ্গলে এখনও গোল করার লোকের অভাব রয়েছে। ক্লেটন সিলভাকে নামানো হয় দ্বিতীয়ার্ধে। স্ট্রাইকার হিসাবে যাঁকে রাখা হয়েছিল, সেই জেভিয়ার সিভেরিয়োকে গোটা ম্যাচে খুঁজেই পাওয়া গেল না। অন্য দিকে, তিন জন শক্তিশালী স্ট্রাইকার থাকা সত্ত্বেও মোহনবাগান বার বার খেই হারাল ফাইনাল থার্ডে এসে। পেত্রাতোসের একক প্রয়াস বাদে তাঁরা প্রচুর গোলের মুখ খুলেছে এমন বলা যাবে না।
প্রথম ডার্বির মতোই মোহনবাগান কোচ জুয়ান ফেরান্দো এ দিনও প্রথম একাদশে রাখেননি বিশ্বকাপার জেসন কামিংসকে। আক্রমণভাগে ছিলেন দিমিত্রি পেত্রাতোস এবং আর্মান্দো সাদিকু। একটু পিছন থেকে খেলছিলেন হুগো বুমোস। সঙ্গে ছিলেন অনিরুদ্ধ থাপা এবং সাহাল সামাদ। অন্য দিকে, ইস্টবেঙ্গলের কোচও প্রথম একাদশে রাখেননি ক্লেটন সিলভাকে। ডান দিকে উইং সচল রাখার কারণে নিশু কুমারের জায়গায় খেলান মহম্মদ রাকিপকে।
আগের ডার্বিতে যে দাপুটে ইস্টবেঙ্গলকে দেখা গিয়েছিল, রবিবারও তার ব্যতিক্রম নেই। মোহনবাগানও ছেড়ে কথা বলছিল না। ফলে শুরু থেকেই চলছিল আক্রমণ এবং প্রতি আক্রমণের খেলা। মোহনবাগান মাঝে একটা সময় টানা আক্রমণ করে যাচ্ছিল। কিন্তু গোলের রাস্তা খুলতে পারছিল না। অন্য দিকে, ইস্টবেঙ্গলের ভরসা ছিল প্রতি আক্রমণেই। বল পেলেই নিজেদের মধ্যে পাস দেওয়া নেওয়া করে উঠে যাচ্ছিল মোহনবাগানের অর্ধে।
ম্যাচের প্রথম ভাল সুযোগ আসে মোহনবাগানের কাছেই। ইস্টবেঙ্গলের বক্সের ভিতরে ঢুকে ডান দিক থেকে বল ভাসিয়েছিলেন আশিস রাই। বাঁ দিকে দাঁড়ানো সাহাল সামাদ মাটিতে ড্রপ খাওয়ানো শটে গোল করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বল গোলের অনেকটাই পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
এর পর দুই দলই অন্তত দুটো ভাল সুযোগ পেয়েছিল। চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে অহেতুক পাস খেলতে গিয়ে ভুল করছিল ইস্টবেঙ্গল। যে কারণে আক্রমণ করলেও কাজের কাজ হচ্ছিল না। অন্য দিকে, মোহনবাগানের ফুটবলারদের মধ্যে দেখা যাচ্ছিল ফিনিশিংয়ে ব্যর্থতা। বুমোসের পরিচিত পাস দেখা যাচ্ছিল না। বার বার আটকে যাচ্ছিলেন আশিক কুরুনিয়ান। মোহনবাগানের বেশিরভাগ আক্রমণ হচ্ছিল বাঁ প্রান্ত দিয়ে, যে দিকে খেলছিলেন আশিক। বল নিয়ে ইস্টবেঙ্গলের বক্সের কাছাকাছি এগোলেও তাঁকে আটকাতে বিশেষ বেগ পেতে হচ্ছিল না রাকিপকে।
প্রথমার্ধ শেষের মিনিট কয়েক আগে একটা ভাল সুযোগ পেয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। ডান প্রান্ত ধরে তৈরি হওয়া আক্রমণ থেকে বল পেয়েছিলেন বোরহা হেরেরা। বক্সে তাঁর ভাসানো ক্রস আনোয়ার আলি হেড করে ক্লিয়ার করেন। ফিরতি বলে নন্দকুমারের শট অল্পের জন্যে বারের উপর দিয়ে উড়ে যায়।
এর পরেই ম্যাচে তুমুল উত্তেজনা। ইস্টবেঙ্গলের কর্নারের পর বল গিয়েছিল বোরহার পায়ে। কিন্তু বল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি তিনি। প্রতি আক্রমণে উঠছিলেন সাদিকু। তাঁর সামনে কেউই ছিলেন না। কিন্তু গোল আটকানোর চেষ্টায় বোরহা টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেন আলবেনিয়ার ফুটবলারকে। এর পরেই শুরু হয় ঝামেলা। বোরহাকে এসে ঠেলা মারেন বুমোস। ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারদের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায় পেত্রাতোসের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার পর বোরহা এবং বুমোসকে হলুদ কার্ড দেখান রেফারি রাহুল গুপ্তা।
উত্তেজনা তখনও থামেনি। পরের মুহূর্তেই একটি বল আটকাতে গিয়ে অনিরুদ্ধ খারাপ ট্যাকল করেন। তাঁকেও হলুদ কার্ড দেখানো হয়। প্রথমার্ধের ইনজুরি টাইমের খেলা চলাকালীন পেত্রাতোসের একটি শট অল্পের জন্যে পোস্টের উপর দিয়ে উড়ে যায়। এরপরে প্রথমার্ধে আর গোলের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
দ্বিতীয়ার্ধেও দুই দল একই ভঙ্গিতে খেলা শুরু করে। ইস্টবেঙ্গল যেমন ভরসা করছিল প্রতি আক্রমণে, তেমন মোহনবাগানের ছন্দবদ্ধ আক্রমণ দেখা যাচ্ছিল। ৫৭ মিনিটের মাথায় বুমোস একটি সহজ সুযোগ নষ্ট করেন। ডান দিক থেকে মনবীর সিংহের পাস পেয়েছিলেন। বল রিসিভ করে শট মারার সময় ছিল। কিন্তু চলতি বলে তাঁর মারা শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
৬০ মিনিটের মাথায় লাল কার্ড দেখেন অনিরুদ্ধ। সিভেরিয়ো একটি বল হেড করতে গিয়েছিলেন। আচমকা তাঁর মুখে পা চালিয়ে দেন অনিরুদ্ধ। মোটেই ইচ্ছাকৃত ছিল না। কিন্তু বল ছাড়া এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে সরাসরি লাল কার্ড দেখানো হয়। রেফারি অনিরুদ্ধকে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড তথা লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। স্বাভাবিক ভাবেই হতাশ মুখে মাঠ ছাড়েন মোহনবাগানের মিডফিল্ডার।
মোহনবাগান দশ জনে হয়ে যাওয়ার পরেও আক্রমণের রাস্তা থেকে সরে আসতে চাননি ফেরান্দো। কোনও ডিফেন্ডার নামানোর বদলে তিনি বুমোসের বদলে নামান কামিংসকে। বাঁ দিকে আশিকের বদলে নামেন লিস্টন কোলাসো। সেই সিদ্ধান্তের সুফল মেলে সঙ্গে সঙ্গে।
৭০ মিনিটেই এগিয়ে যায় মোহনবাগান। ডান দিকে বল নিয়ে এগোতে থাকেন পেত্রাতোস। তাঁকে আটকানোর কোনও চেষ্টাই করেননি ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা। বল নিয়ে এগিয়ে আসতে দিলেন। বুমোস সামান্য কাট করে বাঁ পায়ে নিখুঁত শট রাখেন। ইস্টবেঙ্গলের গোলকিপার প্রভসুখন গিলের কিছু করার ছিল না।
এর পর আক্রমণ করার বদলে মোহনবাগান নিজেদের কিছুটা গুটিয়ে নেয়। গোল ধরে রাখার লক্ষ্যে রক্ষণাত্মক খেলতে শুরু করে তারা। ফেরান্দো রক্ষণে নামিয়ে দেন ব্রেন্ডন হ্যামিলকে। এই সময় একের পর এক সুযোগ তৈরি করছিল ইস্টবেঙ্গল। কিছু মোহনবাগানের রক্ষণ ভেদ করতে পারেনি তারা। শেষ ৩০ মিনিট দশ জনে খেলেও গোল ধরে রাখে সবুজ-মেরুন।