গোলের পর জেমি ম্যাকলারেন। ছবি: সমাজমাধ্যম।
ইস্টবেঙ্গল ০
মোহনবাগান ২ (ম্যাকলারেন, পেত্রাতোস)
শনিবার কলকাতা ডার্বি শুরু হওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যা ৭.৩০টায়। তার অনেক আগে, সকাল ১০টাতেই মেট্রোয় এক সমর্থক ইস্টবেঙ্গলের জার্সি পরে উঠে পড়েছিলেন। জিজ্ঞাসা করায় জানালেন, ডার্বির জন্য সারা দিন কোনও কাজ করবেন না। যাদবপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে মাংস-ভাত খেয়ে খেলা দেখতে যাবেন। তিনি শেষ পর্যন্ত যুবভারতীতে এসেছিলেন কি না জানা নেই। এলে বাকি ২০ হাজার লাল-হলুদ সমর্থকের মতো আবারও আশাহত হয়ে ফিরতে হবে তাঁকে। কলকাতা ডার্বি আবার জিতল মোহনবাগান। শনিবার জেমি-দিমি জুটিতে ইস্টবেঙ্গলকে ২-০ হারাল তারা। আইএসএলে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে প্রথম জয় অধরাই থাকল ইস্টবেঙ্গলের। ন’বারের সাক্ষাতে হার আট বার, ড্র এক বার।
জয়ের ফলে আইএসএলের পয়েন্ট তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে এল মোহনবাগান। পাঁচ ম্যাচে দশ পয়েন্ট হল তাঁদের। পাঁচ ম্যাচের পাঁচটিই হেরে শূন্য পয়েন্ট নিয়ে ইস্টবেঙ্গল রয়ে গেল সবার শেষেই। ম্যাচের শেষে যখন মোহনবাগান দল গ্যালারির কাছে গিয়ে সমর্থকদের অভিবাদন গ্রহণ করছে, তখন ইস্টবেঙ্গলের ডাগআউটে নিবিড় আলোচনা করতে দেখা গেল ইস্টবেঙ্গলের কোচ অস্কার ব্রুজ়ো এবং সহকারী বিনো জর্জকে। পরের সাক্ষাতে মোহনবাগানকে হারানোর সঙ্কল্পই কি নিলেন তাঁরা?
যে ফর্মে মোহনবাগান ছিল তাতে তাদের হারাতে গেলে যে নিজেদের ছাপিয়ে যেতে হবে এটা ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা জানতেন। কিন্তু দু’-একজন বাদে মাঠে কারও মধ্যে সেই চেষ্টা দেখা গেল না। সেই পুরনো রোগেই বার বার ভুগল ইস্টবেঙ্গল। ব্রুজ়োর হাতে পড়ে এই দল বদলে যেতে পারে হয়তো। তবে অনেক খাটতে হবে স্পেনীয় কোচকে। সবচেয়ে বড় কথা, দলের মানসিকতার আমূল বদল দরকার।
ইস্টবেঙ্গলের দুর্বল সাইডব্যাক
আধুনিক ফুটবলে দুই সাইডব্যাকের গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁরা যেমন দুই প্রান্ত দিয়ে আক্রমণ করতে সাহায্য করেন তেমনই রক্ষণে এসে বিপক্ষের আক্রমণও সামলান। শনিবার ইস্টবেঙ্গল রক্ষণের দুই প্রান্তেই দুর্বলতা লক্ষ করা গিয়েছে। মহম্মদ রাকিপ এবং প্রভাত লাকরা ছিলেন সাইডব্যাক। এঁদের মধ্যে লাকরার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। তাঁর প্রান্ত দিয়ে বার বার আক্রমণ হল। এমনকি ম্যাচের প্রথম গোলটিও তাঁর দিক থেকেই। মোহনবাগানের মনবীর সিংহ গতি এবং দক্ষতায় বার বার হারিয়ে দিলেন লাকরাকে। ডান দিক থেকে মনবীরের পাসে যখন ম্যাকলারেন গোল করলেন তখন লাকরা ধারেকাছেই নেই। উল্টো দিকে রাকিপও বলার মতো কিছু করতে পারেননি।
ইস্টবেঙ্গলকে বল নিয়ন্ত্রণ করতে না দেওয়া
লাল-হলুদের নতুন কোচ অস্কার ব্রুজ়ো চান তাঁর দল পায়ে বল রেখে খেলুক। শনিবার মোহনবাগান সেটাই করতে দেয়নি। ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা বল ধরতে এলেই চারদিক থেকে ছুটে আসছিলেন মোহনবাগানের ফুটবলারেরা। ছোঁ মেরে বল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ফলে নিজেদের স্বাভাবিক খেলাই খেলতে পারলেন না ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা। নিজেদের মধ্যে তিন-চারটি পাস খেলতে গিয়েও গলদঘর্ম হতে হয়। তুলনায় মোহনবাগানের ফুটবলারেরা অনেক বেশি পাস খেললেন।
অফসাইডে গোল বাতিল
ম্যাকলারেন গোল করার আগেই এগিয়ে যেতে পারত মোহনবাগান। বাঁ দিকে তোলা লিস্টন কোলাসোর ক্রসে জোরালো হেডে গোল করে ফেলেছিলেন মনবীর। তবে লাইন্সম্যান অফসাইড দেন। মনবীর বিশ্বাসই করতে পারেননি। রিপ্লে-তে দেখা যায়, একা মনবীর নন, অফসাইডে ছিলেন টম অলড্রেডও। তাঁর সঙ্গে বলের সংযোগই হয়নি। যে সমান্তরাল রেখা দিয়ে অফসাইড মাপা হয় সেখানে মনবীরের কাঁধ বেরিয়ে ছিল।
প্রতিভা বোঝালেন ম্যাকলারেন
১২ কোটি টাকা খরচ করে বিস্তর টালবাহানার পর নেওয়া হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার ‘এ লিগে’র ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা ম্যাকলারেনকে। মহমেডানের পর ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে নিজের খেলায় ম্যাকলারেন বুঝিয়ে দিলেন, টাকা নষ্ট করেনি মোহনবাগান ম্যানেজমেন্ট। যে কোনও স্ট্রাইকারের গুণ বোঝা যায় তাঁর পজিশনিংয়ে। সে দিক থেকে জেসন কামিংস এবং দিমিত্রি পেত্রাতোসকে টেক্কা দেবেন অসি ফুটবলার। প্রথমার্ধে মোহনবাগান বার বার ডান দিক থেকে যখন আক্রমণ করছিল প্রতি বারই সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছিলেন তিনি। ১৮ মিনিটের মাথায় মনবীরের পাসে শট নিয়েছিলেন ম্যাকলারেন। তা সরাসরি বিপক্ষ গোলকিপার প্রভসুখন গিলের হাতে জমা পড়ে। তার কিছু ক্ষণ পরে বাঁ পায়ের শট অল্পের জন্য বাইরে যায়। কাঙ্ক্ষিত গোল পান ৪১ মিনিটে। এ বারও সেই ডান দিক থেকে মনবীর বল রেখেছিলেন। তবে যে ভাবে আনোয়ার এবং হেক্টর ইয়ুস্তের মাঝখান থেকে ঢুকে পড়ে প্রথম টাচেই বল ডালে জড়ালেন ম্যাকলারেন, তা গোলসন্ধানী জাত স্ট্রাইকারের পক্ষেই সম্ভব।
নায়ক ও খলনায়ক প্রভসুখন
আগের ম্যাচে দেবজিৎ মজুমদারকে খেলানো হয়েছিলেন গোলকিপার হিসাবে। ডাগআউটে ছিলেন প্রভসুখন। ডার্বিতে তাঁকে ফেরানো হয় প্রথম একাদশে। দিনের শেষে নায়ক এবং খলনায়ক দুই বিশেষণই বসানো যায় তাঁর নামের পাশে। নায়ক কারণ প্রথমার্ধে তিনি নিশ্চিত দু’বার গোল বাঁচিয়েছেন তিনি। প্রথম বার ম্যাকলারেনের শট বাঁচান। যদিও সে ক্ষেত্রে অনেকটাই সহায় হয়েছে ভাগ্য। দ্বিতীয় বার তিনি মনবীরের হেড ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচান। পরে তা রক্ষণ ক্লিয়ার করে। তেমনই খলনায়ক হয়ে গিয়েছেন প্রথম বার দিয়ে গোল হজম করে। দক্ষ গোলকিপার কখনওই প্রথম বার দিয়ে গোল খাবেন না। অনুমান কাজে লাগিয়ে আগেই বাঁ দিক ঘেঁষে দাঁড়ানো উচিত ছিল ম্যাকলারেনের।
লাল-হলুদ জার্সিতে উজ্জ্বল তালাল
কলকাতা ডার্বি থেকে ইস্টবেঙ্গলের সবচেয়ে বড় পাওয়া নিঃসন্দেহে মাদিহ তালাল। প্রথম তিনটি ম্যাচে নিষ্প্রভ থাকার পর জামশেদপুরের বিরুদ্ধে ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে যতটুকু ইস্টবেঙ্গল আক্রমণ করল সবই এল তালালের পা থেকেই। বিপক্ষের থেকে বল কাড়া হোক বা সঠিক ফুটবলারকে বল বাড়ানো, সব কাজই একার হাতে করলেন তিনি। দ্বিতীয়ার্ধে একটু নিষ্প্রভ লেগেছে।
ডার্বির সঙ্গে সমার্থক পেত্রাতোস
ডার্বিতে গোল করে নায়ক হওয়া অভ্যাস করে ফেলেছেন দিমিত্রি পেত্রাতোস। চোটের কারণে এ দিন তাঁকে প্রথম থেকে নামাননি কোচ হোসে মোলিনা। দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হওয়ারও বেশ কিছুটা পরে নামালেন। কিন্তু ডার্বিতে গোল করা যিনি অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন তাঁকে আটকানো যাবে কী করে? ম্যাচের শেষ দিকে পেনাল্টি পেল মোহনবাগান। পেত্রাতোসই তা আদায় করলেন। বক্সের মধ্যে পেত্রাতোসের পায়ে বল থাকার সময় প্রভসুখন হাত দিয়ে বাধা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। পেনাল্টি নিয়ে কোনও সন্দেহই থাকার কথা নয়। জোরালো শটে গোল করে পরিচিত ভঙ্গিতে উচ্ছ্বাস করলেন অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকার।