রুদ্ধশ্বাস ফাইনালের শেষে লিয়োনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ। ছবি: রয়টার্স।
কী অবিশ্বাস্য এক ফাইনাল! এ জন্যই তো ফুটবল তুমি এত সুন্দর!
নাটকীয়, রুদ্ধশ্বাস ফাইনালের শেষে লিয়োনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ। এই রাতটায় আপনি যদি ফরাসি না হন, তা হলে নিশ্চয়ই খুশিই হবেন। বাকি দুনিয়া তো এই দৃশ্যটাই দেখতে চেয়েছিল। আমার তো মনে হচ্ছে, ফরাসিদের অনেকেও হয়তো খুব দুঃখ পাবেন না মেসির হাতে কাপ দেখে।
অবশ্যই ফাইনালে কাপ জয়ের এত কাছাকাছি এসে স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার যন্ত্রণা তাড়া করবে ফরাসিদের। কিন্তু মেসি এমন জাদুকর, যে জিতলে ফুটবলও খুশি হয়। তাই আজ আক্ষেপ বা দুঃখের দিন নয়। সকলে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানানোর দিন।
ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা দ্বৈরথ ঘিরে গোটা ফুটবল পৃথিবী আলোড়িত হয়। আজ কিন্তু আর্জেন্টিনাকে অভিনন্দন জানানোর দিন। মেসির স্বপ্নপূরণে খুশি হওয়ার দিন। আমার ভাল লাগছে এটা ভেবে যে, বাকি জীবন চাপমুক্ত হয়ে কাটাতে পারবে ও। না হলে বিশ্বকাপ না পাওয়ার যন্ত্রণা কী, সে তো আমি বুঝি। একটাই কথা বলতে চাই মেসিকে— এই মুহূর্তটা তোমার প্রাপ্য। উপভোগ করো।
মেসিকে বরাবরই তুলনা করা হয়েছে মারাদোনার সঙ্গে। এক জন বিশ্বকাপ দিয়েছে, অন্য জন এত কাল পারেনি। তাই সব সময়ই যেন মেসির উপর সীমাহীন চাপ ছিল, কাপ জেতার। আমি জানি, এই চাপ কতটা প্রাণান্তকর হতে পারে। ব্রাজিলে আমরা বড়ই হই এই প্রত্যাশার মধ্যে। সারা দেশ আশা করে, বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছ মানেই কাপ নিয়ে ফিরবে। তাই মেসির উপরে কতটা চাপ ছিল, তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশে বসা এই অগ্রজ বুঝতে পারছিল।
ফুটবলার হিসেবে আমি খুশি মেসির জন্য। সারা পৃথিবীর মানুষকে যে এত আনন্দ দিয়েছে তার অবিশ্বাস্য ফুটবল দিয়ে, তার হাতে এই কাপ শোভা পায়। মারাদোনার প্রজন্মের ফুটবলার আমি। মনে করি, আমাদের প্রজন্মে দিয়েগোই সেরা ছিল। তবে মেসি কারও থেকে পিছিয়ে থাকবে না। এত কাল ক্লাবের জার্সিতে সব কিছুই জেতা ছিল ওর। বিশ্বকাপ ছিল না। এ বার সেটাও এসে গেল। তাই আর কোনও সংশয়ের জায়গা নেই। আমি তুলনায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু বুঝতেই পারছি, আমি না চাইলে কী হবে, আর্জেন্টিনার ভক্তরা আজ মারাদোনার পাশেই মেসিকে বসিয়ে দেবে।
মনে হয়, উপর থেকে দেখে দিয়েগোও খুশি হবে। বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছ বন্ধু, আজ তোমার খুশির দিন।
আনন্দবাজারে শুরুর দিকের কলামেই যে লিখেছিলাম কিলিয়ান এমবাপে এই মুহূর্তে সেরা, সেটা যে ঠিকই লিখেছিলাম এখন নিশ্চয়ই সকলে একমত হবেন। ফাইনালে ০-২ পিছিয়ে পড়া দলকে এমবাপে ম্যাচে ফেরাল। ভলি থেকে যে গোলটা করল, তা এই বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা। ০-২ থেকে ২-২ করা এক জিনিস। তারপর একস্ট্রা টাইমে মেসি এগিয়ে দিল আর্জেন্টিনাকে। তখনও নিঃশেষ হয়নি এমবাপে। পেনাল্টি থেকে আবার গোল করে ৩-৩ করে দিল। এমবাপে জিতে নিল গোল্ডেন বুট। কিন্তু সর্বোচ্চ গোলদাতা কে হল, সেই হিসাব ব্যক্তিগত মাইলস্টোনের জন্য ঠিক আছে। এক জনের হাতেই বিশ্বকাপ উঠতে পারত। আর তা শোভা পাচ্ছে মেসির হাতেই। তবে এই কাপের স্বপ্নপূরণের জন্য ওর সতীর্থদের অনেককেও কৃতিত্ব দিতে হবে। সব চেয়ে বেশি করে বলতে হবে গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেসের কথা। নেদারল্যান্ডস ম্যাচ টাইব্রেকারে জেতানোর পরে ফাইনালটাও জিতিয়ে দিল। দি’মারিয়া শুরু থেকে দারুণ ঝড় তুলেছিল। ওর গতি আর উইং থেকে আক্রমণ কিন্তু ফরাসি রণনীতি নষ্ট করে দিয়ে গেল।
সারা দুনিয়া তাকিয়ে ছিল এই দু’জনের দ্বৈরথের দিকে। মেসি বনাম এমবাপে। দু’জনে দেখাল, কেন এই মুহূর্তে বিশ্বের দুই সেরা ফুটবলার ওরা। মেসি এই বিশ্বকাপের পরে বিদায় নিচ্ছে। সেই মঞ্চেই ফের নিজের প্রতিভা দেখাল এমবাপে। দুই প্রজন্মের মধ্যে ব্যাটন বদলও হয়ে গেল রবিবার কাতারের মাঠে। মেসির যুগ শেষ হল, এর পর জ্বলজ্বল করবে এমবাপের যুগ। মেসি বলে দিয়েছে, এটাই শেষ বিশ্বকাপ। ওর বয়স ৩৫। এমবাপে ২৩। মেসিকে আর দেখা যাবে না। কিন্তু এমবাপে ফিরবে। ২০২৬ বিশ্বকাপে ওর বয়স হবে ২৭। তখনও বিশ্বকাপ জিততে পারে। এমবাপে যথেষ্ট ফিট, যথেষ্ট পরিশ্রমী আর খুবই যে ক্ষুধার্ত, তা-ও তো ফের দেখা গেল ফাইনালে। আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরবে ও।
আপাতত মঞ্চটা অবশ্য এক জনেরই। লিয়োনেল মেসির। ও আগে বলেছিল, এটাই শেষ বিশ্বকাপ। জানি না, এর পরে সত্যিই সেটা হবে কি না। বিশ্বকাপ হাতে ধরে চুম্বন— ছোটবেলা থেকে তোমার সব লড়াই আজ সার্থক, লিয়ো। আর কেউ বলবে না, মেসির গলায় বিশ্বকাপ মেডেল নেই!