সুনীল ছেত্রী। —ফাইল চিত্র।
ভারতীয় ফুটবল দাঁড়িয়ে আশ্চর্য সন্ধিক্ষণের সামনে। এক দিকে আগামী ৬ জুন যুবভারতীতে কুয়েতকে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের তৃতীয় পর্যায়ে খেলার হাতছানি। অন্য দিকে জাতীয় দলের জার্সিতে সুনীল ছেত্রীর শেষ ম্যাচ। বিদায় বেলায় ভারত অধিনায়ক নিজেও কি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন? লোকসভা নির্বাচনের সপ্তম ও শেষ দফার জন্য শনিবার অনুশীলন বন্ধ থাকায় একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজারকে।
প্রশ্ন: ভারতের হয়ে শেষ ম্যাচের আগের প্রতিটি মুহূর্ত কী ভাবে কাটাচ্ছেন? কোনও বিশেষ অনুভূতি কি হচ্ছে?
সুনীল ছেত্রী: কুয়েতের বিরুদ্ধে জাতীয় দলের হয়ে যে শেষ ম্যাচ খেলব, এটাই না ভাবার চেষ্টা করছি। যখনই সময় পাচ্ছি নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি। স্ত্রী ও ছেলে ধ্রুব আমার সঙ্গেই রয়েছে। ওদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি। পাশাপাশি কুয়েত ম্যাচের প্রস্তুতিও চলছে। তাই শেষ ম্যাচে কী হবে? আমি কী করব? এই ভাবনাগুলো মনের মধ্যে ঢুকতে দিতে চাইছি না।
প্র: অনুশীলনে আপনি লালিয়ানজ়ুয়ালা ছাংতে, ডেভিড লালহানসাঙ্গার মতো অনুজদের গতিতে পরাস্ত করছেন। কখনও কি মনে হচ্ছে, আরও কিছু দিন অনায়াসে আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেলা চালিয়ে যেতে পারতেন?
সুনীল (হাসি): ছাংতেকে গতিতে হারানো সহজ নয়। আমি ওর সঙ্গেই দৌড়চ্ছি। একটা ব্যাপার আরও একবার স্পষ্ট করে দিতে চাই, শারীরিক কারণে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত আমি নিইনি। আমার সৌভাগ্য যে, নিজেকে এখনও ফিট রাখতে পেরেছি। বয়স ৪০ হোক অথবা ২০— জাতীয় দলে সকলকে একই ধরনের অনুশীলন ও পরিশ্রম করতে হয়। শারীরিক সক্ষমতার তুঙ্গে থাকতে হয়। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। অনেক ভেবে-চিন্তেই অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে দু’টো ম্যাচ খেলার পরেই মনে হয়েছে, এ বার থামা উচিত।
প্র: অবসরের জন্য কুয়েত ম্যাচকেই বেছে নেওয়ার বিশেষ কোনও কারণ?
সুনীল: দীর্ঘ দিন খেলার পরে কোনও ক্রীড়াবিদ যখন শেষ বারের জন্য মাঠে নামেন, পরিবেশ অনেকটা প্রদর্শনী ম্যাচের মতো হয়ে ওঠে। আমি সবসময়ই চেয়েছিলাম, জাতীয় দলের জার্সিতে শেষ ম্যাচটা যেন গুরুত্বপূর্ণ হয়। মাঠে নেমে আমার যেন কখনও মনে না হয়, প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে নামছি। আমার বিদায়টাই প্রধান আকর্ষণ যেন হয়ে না ওঠে। যুবভারতীতে কুয়েতকে হারিয়ে বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের তৃতীয় পর্যায়ে প্রথমবার খেলা নিশ্চিত করা আমাদের একমাত্র লক্ষ্য থাকবে। সতীর্থদের বলেছি, অন্য কোনও কিছু নিয়ে না ভেবে, শুধুমাত্র কুয়েত ম্যাচে মনোনিবেশ করতে।
প্র: প্রস্তুতি কেমন চলছে?
সুনীল: আফগানিস্তানের কাছে হারের পরে নিজেদের খেলার বিশ্লেষণ করেছি। অসংখ্যবার ওই ম্যাচের ভিডিয়ো দেখেছি। প্রত্যেকেই উপলব্ধি করেছি, সে দিন নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী খেলতে পারিনি। আমাদের ওই ম্যাচটা জেতা উচিত ছিল। এ বার সামনে কুয়েত। ইতিবাচক দিক হল, নিজেদের ভাগ্য এখন আমাদের হাতেই রয়েছে। ঘরের মাঠে খেলার সুবিধে আমরা পাব। পুরো যুবভারতীর সমর্থন আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমাদের জেতার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তাই অতীত ভুলে সামনের দিকে তাকাচ্ছি আমরা। প্রচুর পরিশ্রম করছি জেতার জন্য। ভারতীয় দলের অনেক ফুটবলারই আইএসএলের সেমিফাইনাল ও ফাইনাল খেলেছিল। এই ম্যাচের আগে সকলের একসঙ্গে অনুশীলন করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। গত ১৫-২০ দিন ধরে আমরা তা করতে পেরেছি বলেই এখন একটা দল হয়ে উঠছি।
প্র: ফিফা ক্রমতালিকায় ভারতের (১২১) চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা কুয়েত (১৩৯) দল হিসেবে কেমন?
সুনীল: কুয়েত দারুণ শক্তিশালী দল। রক্ষণ থেকে আক্রমণ— বল ধরে খেলায় দুর্দান্ত। সাম্প্রতিককালে কুয়েতের বিরুদ্ধে তিনটি ম্যাচ খেলেছিলাম। বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে কুয়েতকে ওদের দেশে হারিয়েছি। তাই আমরা যেমন ওদের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, ওদের কাছেও প্রচুর তথ্য রয়েছে ভারতীয় দল সম্পর্কে। পুরোপুরি তৈরি হয়েই ওরা কলকাতায় আসছে।
প্র: ধ্রুব একটু বড় হলে নিজের ফুটবলজীবনের কী কী স্মরণীয় মুহূর্তের কাহিনি শোনাতে চান?
সুনীল: ধ্রুব যদি শুনতে চায়, তা হলেই বলব। এই প্রজন্মের শিশুরা একেবারেই আলাদা। নিজে থেকে কখনও ফুটবলজীবনের কাহিনি শোনানোর চেষ্টা করলে ওর হয়তো ভাল না-ও লাগতে পারে। বড় হয়ে ধ্রুব নিজে যদি আগ্রহ দেখায়, তখনই আলোচনা করব, আমার খেলার ভিডিয়ো দেখাব।
প্র: ভারতের জার্সিতে আপনার শেষ ম্যাচে ধ্রুবকে কি যুবভারতীতে নিয়ে আসবেন?
সুনীল: সন্ধে সাড়ে সাতটার মধ্যে ও ঘুমিয়ে পড়ে। যুবভারতীতে ধ্রুব থাকবে কি না, পুরোটাই নির্ভর করছে ওর মায়ের উপরে (হাসি)।
প্র: ফুটবলার সুনীলের সঙ্গে বাবা সুনীলের কী পার্থক্য?
সুনীল: এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন। আশা করছি, সব কিছুই ভালভাবে করতে পারছি। দুর্ভাগ্যবশত আমি ও ধ্রুব একসঙ্গে যতটা সময় কাটাতে চাই, তা পারছি না। ওর জন্মের সময় প্রচণ্ড ব্যস্ত ছিলাম দেশ ও ক্লাবের হয়ে খেলতে। তাই বাবা হিসেবে কতটা সফল, তা নিজে বিচার করতে পারব না। যতটুকু সময় আমি ধ্রুবর সঙ্গে কাটাই, দারুণ উপভোগ করি। ওর বয়স এখন মাত্র ন’মাস। সব কিছুই সামলাচ্ছে আমার স্ত্রী। আমি চেষ্টা করি যতটা সম্ভব ওকে সাহায্য করার।
প্র: জাতীয় দলের হয়ে গোল করার নিরিখে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, লিয়োনেল মেসির সঙ্গে তুলনা কি কখনও আপনার উপরে চাপ সৃষ্টি করেছে?
সুনীল: একেবারেই না। রোনাল্ডো, মেসির সঙ্গে আমার কোনও তুলনাই হতে পারে না। আমার মতো হাজার-হাজার ফুটবলার রয়েছে। তাই আমি কখনও চাপ অনুভব করিনি। দেশের হয়ে ৯৪ গোল করতে পেরেছি বলে আমি অবশ্যই খুশি।
প্র: আই এম বিজয়ন উত্তরসূরি বেছে নিয়েছিলেন ভাইচুং ভুটিয়াকে। তিনি আবার ব্যাটন তুলে দিয়েছিলেন আপনার হাতে। সুনীল ছেত্রীও কি তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন করে ফেলেছেন?
সুনীল: ভারতীয় দলের ২৬ জন ফুটবলারেরই যোগ্যতা রয়েছে আমার উত্তরসূরি হওয়ার। বিশেষ করে গুরপ্রীত সিংহ সাঁধু, সন্দেশ জিঙ্ঘন, অমরিন্দর সিংহ, রাহুল ভেকে-র মতো অভিজ্ঞদের অধিনায়ক হওয়ার দক্ষতা ও যোগ্যতা রয়েছে। দলকে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে ওদের প্রত্যেকেরই আলাদা পদ্ধতি রয়েছে। তা ছাড়া মনবীর সিংহ, লিস্টন কোলাসো, অনিরুদ্ধ থাপা, শুভাশিস বসুও দেশের হয়ে প্রচুর ম্যাচ খেলেছে। সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল আমাদের দলটা এখন তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রত্যেকেই নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন।
প্র: কুয়েত ম্যাচের তিন দিন পরেই আমেরিকায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত বনাম পাকিস্তান। বন্ধু বিরাট কোহলিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন?
সুনীল: শুধু বিরাট নয়, পুরো ভারতীয় দলকেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছি পাকিস্তান ম্যাচের জন্য। যাঁরা নিয়মিত ক্রিকেট দেখেন না, তাঁরাও এই দ্বৈরথ নিয়ে উত্তেজিত থাকেন। বিশ্বকাপের মঞ্চে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় দল বরবারই সফল। আশা করছি, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সেই ধারা বজায় খাকবে।
প্র: ভারত-পাক দ্বৈরথ দেখবেন?
সুনীল: ভারত বনাম পাকিস্তান দ্বৈরথ তো দেখবই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাকি ম্যাচগুলোও দেখার চেষ্টা করব।
প্র: বিদায়ী ম্যাচে বিশেষ কাউকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন?
সুনীল: না, যুবভারতীতে যাঁরা খেলা দেখতে আসতে চান, তাঁদের সকলকে স্বাগত। যাঁরা টেলিভিশনে ম্যাচ দেখতে চান, তাঁদেরও ধন্যবাদ। তবে ৬ জুন যুবভারতীতে আমার ঘনিষ্ঠরা সকলেই উপস্থিত থাকবেন।