রবিবারের ম্যাচের একটি মুহূর্ত।
আল আমনার মতো ভারত-কাঁপানো ফুটবলার শনিবার রাতে বলেছিলেন, ‘‘এ তো স্প্যানিশ ডার্বি।’’ ভুল কিছু বলেননি ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন ফুটবলার। ইস্ট-মোহনের কোচ স্পেনের। বিদেশিরাও দাভিদ ভিয়া-আন্দ্রেজ ইনিয়েস্তার দেশের। শেষমেশ মরশুমের প্রথম ডার্বি ঢলে পড়ল ড্রয়ের কোলে। না জিতল ইস্টবেঙ্গল, না জিতল মোহনবাগান। দেখা গেল না চোখধাঁধানো ফুটবল। কারোর খেলাতেই দেখা গেল না ব্যক্তিগত স্কিলের ঝলকানি। অথচ মরশুমের প্রথম ডার্বির জন্য তো তৈরিই ছিল যুবভারতী। ভরা স্টেডিয়াম। দু’ দলের ভক্তদের গগনভেদী চিৎকার। সবই ছিল। তবুও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারলেন কোথায় সমর্থকরা! আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ম্যাচে তো সবই ছিল। স্প্যানিশ ফুটবলের ঝলকানিও ছিল। ছোট ছোট পাসে আক্রমণ তৈরি হয়েছে। কিন্তু, গভীর ভাবে দেখলে কার্যকারিতা কম।
অতীতে বাঙালির চিরআবেগের বড় ম্যাচে ব্যক্তিগত স্কিলের বিচ্ছুরণ দেখা গিয়েছে অসংখ্য বার। মজিদ বাসকর, চিমা ওকোরি, কৃশানু দে, হোসে রামিরেজ ব্যারেটো, ওডাফা ওকোলি বা হালফিলের সনি নর্দের পা বহু বড় ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিয়েছিল। গতবারের কলকাতা লিগের বড় ম্যাচে চার-চারটি গোল হয়েছিল। দু’ গোলে পিছিয়ে থেকে দারুণ ভাবে ম্যাচে ফিরে এসেছিল ইস্টবেঙ্গল। এ দিন সেই নাটকীয়তা কোথায়! অবশ্য এক বছর আগের পরিস্থিতি আর আজকের পরিস্থিতি এক নয়। তবুও তো ফুটবলপ্রেমীরা ভাল ম্যাচ দেখার আশায় থাকেন।
রবিবারের বড় ম্যাচে দেখা গেল না একটাও ডিফেন্স চেরা পাস। নেই একটাও দুরন্ত শট বা দুরন্ত হেড। সুযোগ সে রকম তৈরি হল না। মাত্র এক বারই গোল করার মতো জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন মোহনবাগানের ভিপি সুহের। ইস্টবঙ্গলের জালে বল জড়ানোর পরিবর্তে তিনি তা তুলে দেন লাল-হলুদ গোলকিপার রালতের হাতে। সেই সুযোগ সুহের কাজে লাগাতে পারলে এ দিন স্কোরলাইন অন্যরকম হতেও পারত। বাগান কোচ কিবু ভিকুনা প্রথমবার ডার্বিতে নেমে জয়ের স্বাদ পেতেন। তাঁর অগ্রজ আলেয়ান্দ্রো মেনেন্দেজ আগেই ডার্বি জিতেছেন। এ বার জিতলে তিনি ডার্বি জয়ের হ্যাটট্রিক করতে পারতেন। ইস্টবঙ্গল কোচ এই ম্যাচের আবেগ জানেন। তিনি খুব ভালই জানেন, এই ধরনের ম্যাচ নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল। ঠিক ফুটবলারকে ঠিক জায়গায় ব্যবহার করায় তিনি সিদ্ধহস্ত। তাই তো জবি জাস্টিন বলেন, ‘‘আলেয়ান্দ্রোর কোচিংয়ে খেলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম।’’ জবির থেকে সেরাটা বের করে এনেছিলেন আলেয়ান্দ্রো।
আরও পড়ুন: মরশুমের প্রথম ডার্বি গোলশূন্য ড্র
এ দিন আলেয়ান্দ্রোর প্রথম একাদশ দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়ে যান। প্রথম একাদশে তিনি রাখেননি হাইমে স্যান্টোস কোলাডোকে। তার পিছনে হয়তো কোনও কারণ ছিল বিচক্ষণ কোচের। লালরিনডিকা রালতেকে ব্যবহার করলেন স্টপারের ঠিক উপরে। এরকম পজিশনে ট্রেভর জেমস মর্গ্যান অতীতে ব্যবহার করেছিলেন মেহতাব হোসেনকে। ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন ১৪ নম্বর জার্সিধারী দু’ জন স্টপারের সামনে দুলতে দুলতে লম্বা বল বাড়াতেন দুটো উইংয়ে। মেহতাবের মতো প্লেয়ার নন রালতে। লালরিনডিকা দূরপাল্লার শটে দক্ষ। ডার্বিতে দূরপাল্লার শটে গোলও ছিল। মর্গ্যান তাঁকে ব্যবহার করতেন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে। আজ রালতের পা থেকে বেরোল না একটাও মিসাইল। অবশ্য বেরোবেই বা কীভাবে! তাঁকে তো ব্যবহারই করা হয়েছে অনেক পিছন থেকে। নিশ্চয় আলেয়ান্দ্রো অন্য কিছু ভেবেছিলেন। সেই কারণেই পিছন থেকে ব্যবহার করেছিলেন রালতেকে।
কোলাডো ৭০ মিনিটে মাঠে নামেন। তত ক্ষণে যা দেরি হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এই কোলাডোই কিন্তু গত বছর স্পেন থেকে কলকাতায় পা রেখে নেমে পড়েছিলেন ডার্বিতে। প্রথম ম্যাচেই নজর কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। বাকিটা তো ইতিহাস। ডার্বিতে নামার আগে তিনি ফুল ফোটাচ্ছিলেন। সেই কোলাডো এ দিন যখন নামেন, তখন তাঁর আর কিছু করার ছিল না। গোড়াতেই তাঁকে কড়া ট্যাকল করেন বাগানের স্টপার ফ্রান মোরান্তে।
প্রথমার্ধে নিজেদের মধ্যে অসংখ্য পাস খেলছিলেন বেইতিয়া-ফ্রান গনজালেজরা। মাঝমাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন তাঁরা। মাটি ঘেঁষা পাসে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খেলা ঘুরেছে। কিন্তু গোল তো হয় মাঝখান দিয়েই। সেটাই দেখা গেল না। কিবু আরেকটু সাহসী হতে পারতেন। তাঁর হাতে ছিলেন লম্বা স্ট্রাইকার চামোরো। গোল পাওয়ার জন্য তাঁকেও ব্যবহার করতে পারতেন কিবু। সেই রাস্তা নিলেন না তিনি। তাই ডার্বির পারদ চড়লেও দিনান্তে কিন্তু হতাশই করল মরশুমের প্রথম ডার্বি। গোল তো হলই না। পাওয়া গেল না দারুণ কিছু মুহূর্ত। গোল দেখার জন্যই তো মাঠে যান সমর্থকরা। এশিয়ান অল স্টার খ্যাত গোলকিপার অতনু ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘‘ দু’ দলের গোলকিপার ছাড়া একজনও নজর কাড়তে পারল না গোটা ম্যাচে। কারওর নামে যে জয়ধ্বনি করবেন সমর্থকরা, সে রকম কাউকে পাওয়াই গেল না আজকের ম্যাচে।’’