কুলদীপকে পরামর্শ মুস্তাক আহমেদের।
সাক্ষাৎকার দিতে বসে প্রথমেই একটা শর্ত দিয়ে বসলেন তিনি। বলে উঠলেন, ‘‘কোনও বিতর্কিত প্রশ্ন করবেন না তো?’’ তাঁকে আশ্বস্ত করার পরে শনিবার আবু ধাবির টিম হোটেলে বসে আনন্দবাজারের প্রশ্নের উত্তর দিলেন পাকিস্তানের এক সময়কার অন্যতম সেরা লেগস্পিনার মুস্তাক আহমেদ। যিনি টি-টেন লিগে ডেকান গ্ল্যাডিয়েটর্সের নতুন কোচ। যেখানে ক্রিকেটের পাশাপাশি প্রশ্ন হয়েছিল ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়েও।
প্রশ্ন: ৫০ ওভার থেকে ২০ ওভার আর এখন ১০ ওভারের ক্রিকেট। বোলারদের তো বধ্যভূমি হয়ে উঠবে বাইশ গজ।
মুস্তাক: এটা ঠিক কথা, যে বোলারদের সামনে চ্যালেঞ্জটা এখন যথেষ্ট কঠিন হয়ে উঠবে। কিন্তু দু’বছর আগে প্রথম টি-টেন লিগে খেলে একটা জিনিস বুঝেছি।
প্র: কী সেটা?
মুস্তাক: এই ক্রিকেট এক জন বোলারের মানসিকতাকে অনেক শক্ত করে তুলবে। কারণ এখানে প্রতিটা বলে ব্যাটসম্যান আপনাকে ছয় মারার চেষ্টা করবে। আপনার কাজ হবে, সেটা সামলে উইকেট তোলা। দশ ওভারের এই ক্রিকেট খেললে এক জন বোলারের খুব পরিষ্কার ধারণা হয়ে যাবে পরের বলে কী করতে হবে। আর এক বার টি-টেনের মতো প্রতিযোগিতায় ভাল করলে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট জলভাত হয়ে যাবে।
প্র:এক জন স্পিনারের কথাই ধরুন। এই ধরনের ক্রিকেটে স্পিনাররা কি আর ফ্লাইট করাবে?
মুস্তাক: করাবে না। এক দমই করানো উচিত হবে না।
প্র:তা হলে স্পিনার উঠবে কী করে? ফ্লাইটই যদি করানো ভুলে যায়...
মুস্তাক (থামিয়ে দিয়ে): ফ্লাইট করানো যাবে না, কিন্তু স্পিন করাতে হবে। বুঝিয়ে বলছি। স্পিন করানো বলতে আমি বোঝাতে চাইছি জোরের উপরে স্পিন। আমি সব সময় বলি দু’রকমের ডেলিভারি থাকে স্পিনারদের হাতে। এক, স্পিন। দুই, টার্ন। স্পিন সেই ডেলিভারি, যেটা শূন্যে ঘুরবে। আর টার্ন হল বল পিচে পড়ার পরে ঘুরবে। টার্নটা জোরের উপরে করানোই যায়। আর এই ধরনের ক্রিকেটে সেটা খুবই দরকার। স্পিন নয়, টার্ন করাতে হবে বোলারদের।
প্র: এখন তো দেখা যায় স্পিনাররা সবাই রহস্য বল করার চেষ্টা করছে। এতে করে কি ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না?
মুস্তাক: ক্রিকেট এখন যে ভাবে বদলে যাচ্ছে, তাতে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বোলারকেও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিতে হবে। বোলারের তূণে এমন কোনও বল থাকা দরকার, যা ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করবে। এটাকে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও বলা যেতে পারে। ব্যাটসম্যানের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে, এই বোলারের হাতে এমন কিছু আছে যা বোঝা যায় না। তা হলেই অর্ধেক কাজ হয়ে যাবে। তাই আমি বলব, স্পিনারদের হাতে একটা না একটা রহস্য বল থাকতেই হবে। আর তা হলেই সাফল্য আসবে।
প্র:ভারতের সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দু’জন রিস্টস্পিনার কিছু দিন আগেও ছড়ি ঘোরাত। চায়নাম্যান বোলার কুলদীপ যাদব এবং লেগস্পিনার যুজবেন্দ্র চহাল। এর মধ্যে কুলদীপ ইদানীং দাগ কাটতে পারছেন না। ওঁর রহস্য কি ব্যাটসম্যানরা বুঝে গিয়েছে?
মুস্তাক: হ্যাঁ, একটা সময়ের পরে কিন্তু ব্যাটসম্যানেরা বুঝে যায় বোলার কী করতে চাইছে। এখন এত সব সাপোর্ট স্টাফ। প্রত্যেক বোলারের অ্যাকশন কাটাছেঁড়া করা হচ্ছে ভিডিয়োয়। তাই রহস্য ধরে রাখা কঠিন।
প্র: তা হলে কুলদীপের মতো স্পিনারের কী করা উচিত?
মুস্কাক: উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিতে হবে। নতুন বল ভেবে বার করতে হবে যাতে ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করা যায়। না হলে কিন্তু টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। একটা উদাহরণ দিই। শ্রীলঙ্কার রহস্য স্পিনার অজন্তা মেন্ডিস। প্রথম ছ’মাস-এক বছর তো কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। সব উইকেট তুলে নিচ্ছে। কিন্তু তার পরে কী হল? হারিয়েই গেল একেবারে। সে জন্যই বলছি, ব্যাটসম্যানের থেকে এক ধাপ এগিয়ে না থাকলে বোলারদের টিকে থাকা কঠিন।
প্র: কুলদীপের মতো তরুণদের তা হলে কী করা উচিত?
মুস্তাক: একটা কথা বলব। বল হাতে তিন রকমেরই থাক, ক্ষতি নেই। কিন্তু বিভিন্ন কোন থেকে বলটা ফেলতে শেখো। পপিং ক্রিজটাকে ব্যবহার করতে শেখো। ফিল্ডারদের কোন জায়গায় রাখলে কাজ দেবে, সেটা বোঝার চেষ্টা করো। পিচের চরিত্র বোঝো। তার পর সেই অনুযায়ী গতির হেরফের করো। এগুলো মাথায় রেখে বল করো, দেখবে সাফল্য আসবে।
প্র: বাবর আজ়ম আর বিরাট কোহালির মধ্যে খুব তুলনা হচ্ছে। আপনি কী বলবেন?
মুস্তাক: দু’জনের ব্যাটিং দেখলে মনে হয় যেন কবিতা। আপনি বিপক্ষেই থাকুন বা একই দলে, কোহালি বা বাবরের মতো ব্যাটসম্যানকে ব্যাট করতে দেখলে মজা এসে যায়। আর কোহালির পরিসংখ্যাই তো বলে দিচ্ছে ও কত বড় ব্যাটসম্যান।
প্র: দশ বছর পরে আবার পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট ক্রিকেট হচ্ছে। এ বার কি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেও টেস্ট ক্রিকেট শুরু হওয়া উচিত?
মুস্তাক: অবশ্যই হওয়া উচিত। দু’দেশের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক খারাপ হলে কিন্তু খেলার মাধ্যমেই তা ভাল হতে পারে। খেলা তো ভালবাসা নিয়ে আসে, খুশি নিয়ে আসে। দু’দেশের পক্ষেই জরুরি নিজেদের মধ্যে খেলাটা শুরু করা। মানুষ তো ভারত-পাকিস্তানের মহান ক্রিকেটারদের দেখতে চায় মাঠে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট তো অ্যাশেজের চেয়েও আকর্ষণীয়। তাই অবশ্যই দু’দেশের মধ্যে খেলা হওয়া উচিত। দু’দেশের রাজনীতিবিদদেরও সামনে সুযোগ আসবে মুখোমুখি বসে সমস্যার সমাধান করার।
প্র: কী ভাবে সেটা হবে? এখন তো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ইমরান খান। এ বার কোন দিকে এগোতে পারে ব্যাপারটা?
মুস্তাক: ইমরান ভাই কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফোন করেছিল। বলেছিল, এই নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। আলোচনা টেবিলে বসে কথা বলতে হবে। এখন তো একটা ইতিবাচক দিকও দেখা যাচ্ছে।
প্র: কী রকম?
মুস্তাক: এই তো দু’দেশের মধ্যে ‘কর্তারপুর করিডোর’ খুলে গিয়েছে। এটা কিন্তু একটা খুবই ভাল দিক। দু’দেশের সরকারের পক্ষেই। ওরা পাঠিয়েছে, এরা স্বাগত জানিয়েছে। এ রকম দরজা একটা খুললে আরও অনেক খুলবে। আমি তো বলব, সমস্যা যা-ই থাকুক না কেন, নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে তা মেটানো উচিত। আর দু’দেশের মধ্যে সেতুবন্ধনের ক্ষেত্রে খেলাধুলোটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
প্র: এটাই তা হলে ঠিক সময় দু’দেশের মধ্যে সমঝোতা হওয়ার।
মুস্তাক: আমি তো সেই প্রার্থনাই করি। দু’দেশ যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে মিলে যায়, নিজেদের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে, তা হলে মানুষের রোজগার বাড়বে, গরিবের উপকার হবে। আর দু’দেশ হাত মেলালে পৃথিবীর এই অংশটা খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠবে, দুর্বল থাকবে না। তাই দু’দেশের পক্ষেই খুব জরুরি যে নিজেদের মধ্যে ক্রিকেটটা যেন চালু হয়।
প্র: আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ১৬ বছরের এক ভারতীয় কিশোরের আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছিল পাকিস্তানের মাটিতেই। এক দিন আগেই সচিন তেন্ডুলকরের সেই ক্রিকেট যাত্রার তিরিশ বছর পূর্ণ হয়েছে। কী বলবেন সচিন সম্পর্কে?
মুস্তাক: সচিন মহান ক্রিকেটার, সবার কাছে এক জন আদর্শ। কিন্তু সেটা যে শুধু ক্রিকেট মাঠে হাজার হাজার রান করেছে বলে, তা নয়। মানুষ হিসেবে সচিন সবার কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছে। আমি তো মানুষ সচিনকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করি।