উৎসব: ‘স্পাইডারম্যান’ মুখোশে ব্রেন্ডন। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
কলকাতা প্রিমিয়ার লিগ
ইস্টবেঙ্গল ৩ টালিগঞ্জ ০
ইস্টবেঙ্গল রিজার্ভ বেঞ্চে যে স্পাইডারম্যানের মুখোশ মজুত থাকে সেটা জানা যেত না, যদি না গোলের পর ব্রেন্ডন ভ্যানলালরেমডিকা দৌড়ে এসে সেটা নিয়ে মুখ ঢাকতেন। ম্যাচের সেরা মিজোরাম মিডিও বলছিলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই সুপার হিরোর এই চরিত্র আমার খুব প্রিয়। ওঁর অবিশ্বাস্য কাজগুলো দেখতে ভাল লাগে।’’
মনোবিদরা বলেন, অবিশ্বাস্য জিনিস দেখতে দেখতে মানুষের মনের উপর তার একটা প্রভাব পড়ে। ছোট ছোট ছেলেরা সেটা নকল করার চেষ্টাও করে। ছোট্টখাট্টো চেহারার ছটফটে পাহাড়ি ছেলের উপর সেই প্রভাব পড়েছে হয়তো, না হলে বৃহস্পতিবার বিকেলে ব্রেন্ডন অসামান্য ক্ষিপ্রতায় ও রকম একটা গোল করলেন কী করে? মেহতাব সিংহের ক্রস টালিগঞ্জ অগ্রগামীর বক্সে এক বার ড্রপ খেয়ে তাঁর কাছে যেতেই দুর্দান্ত শটে যে গোলটা তিনি করলেন, তার বর্ণচ্ছটা লাল-হলুদ গ্যালারিতে রং ছড়াল।
ব্রেন্ডনের গোলটা কি জবি জাস্টিনকে তাতিয়েছিল? ম্যাচের পর যাঁকে দেখা গেল কৌটো হাতে তাঁর রাজ্য কেরলের বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ তুলতে, সেই স্ট্রাইকারের গোলেও তো কম রং ছিল না! ডান দিক থেকে লালডানমাওয়াইয়া রালতের তোলা বলে জবির সাইড ভলিটা মনে করাল, তাঁর ‘গডফাদার’ আই এম বিজয়নকে।
কুড়ি মিনিটের মধ্যে জোড়া গোল। এবং দুটো গোলের সময় দেখা গেল টালিগঞ্জ রক্ষণে টলিউডের চলতি ধর্মঘটের ছোঁয়া। চার ব্যাকের সবাই স্থবির। কর্মহীন ছিলেন এই সময়। টালিগঞ্জের কোচ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য একসময় দেশের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার ছিলেন। তারকা স্ট্রাইকারকে আটকেছেন অসামান্য দক্ষতায়। তাঁর দলের রক্ষণের কী দশা! ম্যাচ শেষে মনোরঞ্জন যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, মুখটা কালো। মাথা নিচু। ফুটবলার জীবনে এ ভাবে নতমস্তকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, কখনও দেখেনি ময়দান। চার ম্যাচ খেলে সব ক’টিতেই হার—অবনমনের মুখে পড়ে গেল টালিগঞ্জ।
ময়দানে রাতের আলোয় ফুটবল ফিরে আসায় এমনিতেই গ্যালারি মোহময়। গান, মশাল, ফানুস, স্মোক বম্ব, ভাইকিং ক্ল্যাপ, ঘুড়ি, নানা রঙের জার্সি— এ সব এ দিনও ছিল। তবে যেটা চোখ টানল তা হল জোড়া গোলের পর গ্যালারি থেকে উড়িয়ে দেওয়া জোড়া লাল-হলুদ বেলুন। আসলে বহু দিন পর সুভাষ ভৌমিকের দলও তো উড়ল। ইস্টবেঙ্গল ছুটল রাজধানী এক্সপ্রেসের মতো। উইং দিয়ে বিপক্ষকে ছিন্নভিন্ন করার দৌড়, কম্পাস মাপা পাস, মাঝমাঠে আল আমনা আর কাশিম আইদারার যুগলবন্দীর দৌরাত্ম—প্রথমার্ধের ইস্টবেঙ্গলকে দেখে মনে হচ্ছিল সত্যিই এটা মশালবাহিনী। যে বাহিনীকে গতি দিয়ে চার পাহাড়ি ছেলে বারুদ জুগিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। উইংয়ের এক দিকে ব্রেন্ডন-চুলোভা জুড়ি, অন্য দিকে সামাদ আলির সঙ্গে রালতের মেলবন্ধন। তাতেই টালিগঞ্জ শেষ। মুর অ্যাভিনিউয়ের ক্লাবের শোকযাত্রার জন্য তাদের গোলকিপার শুভম রায়ও দায়ী। সামাদের একটা নিরীহ শটে তিনি গোল খেলেন। বিরতির আগেই তিন গোল, দ্বিতীয়ার্ধে হতে পারত আরও কয়েকটি। সেটা হয়নি। ষাট মিনিটের পরই আমনা আর কাশিমকে ক্লান্ত দেখাল। দু’জনেই হাঁফাচ্ছিলেন। এমনিতে ভ্যাপসা গরম। বাতাসে আর্দ্রতাও ভয়ঙ্কর। বয়স হয়ে যাওয়া আমনারা তো গতি হারাবেনই।
কিন্তু সেই সুযোগটা পেয়েও তো টালিগঞ্জ জাগল না। কলকাতার পরিচিত কামো বায়োকে সামনে রেখে ৪-৫-১ এ শুরুতে দল সাজিয়েছিলেন মনোরঞ্জন। পরে ফর্মেশন বদলে কামোর সঙ্গে জুড়ে দেন আর এক বিদেশি লোগো ডোগবো বায়িকে। তাতে অবশ্য লাভ হয়নি। চচ্চড়ির মশলা দিয়ে তো আর বিরিয়ানি রান্না করা যায় না। তা রাঁধুনি যতই ভাল হোন। মরসুমের প্রথম ডার্বি দরজায় কড়া নাড়ছে। সে দিকে তাকিয়ে সবাই। কলকাতা লিগ পেলেও বহু দিন ডার্বি জেতেনি ইস্টবেঙ্গল। বিশ্বকাপার জনি আগোস্তা এসে গিয়েছেন। ছাড়পত্র এসে গেলেই সই করবেন। আর এক স্প্যানিশ ডিফেন্ডার বোর্জা গোমেস পেরেসও পরতে চলেছেন লাল-হলুদ জার্সি। এক জন স্ট্রাইকার আনারও চেষ্টা চলছে। ডার্বিতে হয়তো এঁদের খেলানো হবে। আবাহনের এই খবরের পাশে অবশ্য শোনা যাচ্ছে, বিদায়ের ঘণ্টাও। এ রকম মসৃণ ম্যাচ জেতার পরেও যে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর সুভাষ ভৌমিকের মুখে হাসি নেই। কলকাতা লিগের পর তাঁর ভবিষ্যৎ ঠিক হতে পারে।
ইস্টবেঙ্গল: রাকেশ দাগার (উবেইদ), সামাদ আলি মল্লিক, মেহতাব সিংহ, কিংশুক দেবনাথ, লালরাম চুলোভা, কমলপ্রীত সিংহ, কাশিম আইদারা, লালডানমাওয়াইয়া রালতে (বিদ্যাসাগর সিংহ), মহম্মদ আল আমনা (লালরিন্দিকা রালতে), জবি জাস্টিন।