কীর্তিমান: আকাশের দিকে দু’হাত তুলে উৎসব কোসির। নিজস্ব চিত্র
মহমেডান ৬ • ভারতীয় নৌসেনা ২
হেডে পঞ্চম গোলটা করে কলকাতা ফুটবলে নতুন ইতিহাস গড়ার পরে আর্থার কোসি দুটো হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন মাঠে। তারপর হাত দুটো আশীর্বাদ নেওয়ার ভঙ্গী করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তত ক্ষণে পুরো মহমেডান দল তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ‘‘আগে অনেক গোল করেছি। কিন্তু একাই পাঁচ গোল করব, স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার জীবনের স্মরণীয় দিন,’’ ম্যাচের পর বলছিলেন ময়দানের ‘নতুন বিস্ময়’ এই বিদেশি।
বিরতি পর্যন্ত খেলা গোলশূন্য। সেই ম্যাচেই পরের অর্ধে ৫৫ থেকে ৯২ মিনিট— ডুরান্ড কাপের গ্রুপ লিগে এই সময়ের মধ্যেই মহমেডান শনিবার হাফ ডজন গোল দিল ভারতীয় নৌসেনাদের। তার মধ্যে আইভরি কোস্টের কোসির-ই গোল পাঁচটি। তীব্র চাপের মুখে গোলের শুরুটা তাঁর পা দিয়েই, শেষটা হেডে। ময়দানে অসংখ্য বিদেশি ফুটবলার খেলে গিয়েছেন। ওকোরি চিমা থেকে ওডাফা ওকোলি, এডে চিডি থেকে দিপান্দা ডিকা—অনেক ফুটবলারেরই এক ম্যাচে চার গোলের গৌরব গাঁথা লেখা ছিল এতদিন। কিন্তু স্বাধীনতার পর ময়দানে কোনও বিদেশি এ রকম কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। পাঁচের দশকে ভারতীয় ফুটবলারদের মধ্যে সাহু মেওয়ালাল এবং আপ্পালারাজু কলকাতা লিগে যথাক্রমে ছয় ও পাঁচ গোল করেছিলেন। কিন্তু বিদেশি? কোসি ছাড়া কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত তাঁর সেই কৃতিত্বকে কুর্নিশ জানাতেই প্রবল বৃষ্টির পর গোধুলি সন্ধ্যার মুখে মোহনবাগান মাঠের আকাশে ফুটে উঠল রামধনু।
অথচ এই কোসিই গত বছর ভারতে এসে খেলার সুযোগ না পেয়ে দেশে ফিরেছিলেন। কেরলের গোকুলম এফসি-তে সই করেছিলেন ছয় ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতার স্ট্রাইকার। মানিয়ে নিতে না পারায় ফিরে যান। সে খবর জানতে পেরে গত বার আই লিগের দ্বিতীয় ডিভিশনের খেলা চলার মাঝপথে কোসিকে সই করান মহমেডান কর্তারা। ছয় ম্যাচে পাঁচ গোল করে গতবার চমকে দিয়েছিলেন তিনি। জয়েও ফিরেছিল মহমেডান। এ বার ফের সাদা-কালো জার্সিতে সুব্রত ভট্টাচার্যের দলের আক্রমণভাগের সেরা অস্ত্র হয়ে উঠেছেন তিনি।
বাবা ক্রীড়া শিক্ষক। মা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এমন আবহে ছোট বেলা থেকেই স্কুলে ফুটবল খেলতে শুরু করার পরে আইভরি কোস্টের জাতীয় যুব দলের কোচের নজরে পড়েন। কোসি বলছিলেন, ‘‘জাতীয় যুব দলের দুটি বয়সভিত্তিক বিভাগে আফ্রিকান নেশনস কাপে খেলেছি। প্রচুর গোল করেছি। মালয়েশিয়ান প্রিমিয়ার লিগের দল সাবা এফসি-র হয়ে ১২ ম্যাচে ১০ গোল আছে। গোল করাটা আমার নেশার মতো। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর মতো গোল করার চেষ্টা করি।’’ জানিয়ে দিলেন, পাঁচটি গোলের মধ্যে শেষের গোলটিই সেরা। তীর্থঙ্কর সরকারের তোলা বলে হেডে গোল করছিলেন কোসি। আকাশের দিকে হাত তুলে কি বলছিলেন বিড়বিড় করে? কোসির জবাব, ‘‘ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলাম।’’ স্বীকার করলেন, বৃষ্টি না হলে হয়তো এত গোল পেতেন না।
হাফ ডজন গোল খেলেও ভারতীয় নৌসেনারা কিন্তু যথেষ্ট শক্তিশালী দলই নামিয়েছিল। গতবার মোহনবাগানে খেলা ব্রিটো পি, দলরাজ সিংহ এবং ভাস্কর রায়ের মতো আই লিগ খেলা ফুটবলার ছিল সেনাদের দলে। প্রচণ্ড ফিট এই দলটি ৫৫ মিনিট পর্যন্ত কার্যত নাকানি চোবানি খাইয়েছে সুব্রত ভট্টাচার্যের দলকে। ওই সময় ব্রিটোরা সহজ সুযোগ নষ্ট না করলে মহমেডান পিছিয়ে পড়তই। কিন্তু বিরতির পরে প্রবল বৃষ্টি নামার পরে বদলে গেলেন কোসিরা। এবং তা কোচ সুব্রতর নিখুঁত স্ট্র্যাটেজিতে। ছোট পাস না খেলে উইং এবং মাঝমাঠ থেকে বিপক্ষের বক্সে বল তোলার জন্য কাজে লাগালেন তীর্থঙ্কর, সামসেদ আলিদের। তারপরই গোলের বন্যা শুরু। ৭০ মিনিটে ম্যাচ ২-১ করেও তাই দাঁড়াতে পারেনি সেনারা। নিজের উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে কোসি গোলের পর গোল করে গেলেন, যাঁর মধ্যে একটি অবশ্য পেনাল্টি থেকে। মাঝে একটা গোল শুধু করলেন মুদে মুসা। ব্রিটো ৬-২ করলেন অতিরিক্ত সময়ে।
৫৫ থেকে ৯৪, মাঝের ৩৯ মিনিটে আট গোল, এটাও তো শোনা যাচ্ছে কলকাতা ফুটবলে কোনও প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে হয়নি। সেটাই যদি হয়, তা হলে জোড়া ইতিহাস হল এ দিন। কিন্তু তাতেও সুব্রতর দল সেমিফাইনালে যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই গেল। কারণ মোহনবাগান ছয় পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ শীর্ষে আছে। মহমেডানের এখন চার। দুই প্রধানের শেষ ম্যাচের পরে ঠিক হবে, কে যাবে শেষ চারে।