অভিনব: আতঙ্ক দূরে সরিয়ে ফাঁকা মাঠে শুরু হল বুন্দেশলিগা। শালকের বিরুদ্ধে গোল করে দূরত্ব মেনে উৎসব বরুসিয়ার ফুটবলারদের। শনিবার ডর্টমুন্ডে। টুইটার
বরুসিয়া ৪ • শালকে ০
জার্মানিতে ফুটবলের প্রত্যাবর্তনের দিনে টেলিভিশনে দর্শকশূন্য সিগন্যাল ইদুনা পার্ক দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে আশি হাজার দর্শকে ভর্তি বরুসিয়া ডর্টমুন্ড স্টেডিয়ামের সেই উন্মাদনার ছবিটা। সে দিন মনে হয়েছিল যেন সর্ষে ক্ষেতের মধ্যে বসে রয়েছি। সর্বত্র হলুদ ফুল ফুটে রয়েছে।
আমি তখন টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমির ছাত্র। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে জার্মানিতে ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলাম। আমরা থাকতাম কোলন শহরে। বরুসিয়া ডর্টমুন্ড বনাম এফসি কোলন ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম সিগন্যাল ইদুনা পার্কে। সমর্থকদের উন্মাদনা ও আবেগ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কয়েকটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচও আমরা খেলেছিলাম ওদের জুনিয়র দলের বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচ দেখতেও বরুসিয়ার হলুদ-কালো জার্সি পরে হাতে স্কার্ফ নিয়ে স্টেডিয়ামে ভিড় করেছিলেন সমর্থকেরা।
ফুটবলারেরা এ রকম পরিবেশেই খেলতে পছন্দ করে সব সময়। মাঠে নামার সঙ্গে সঙ্গে গ্যালারি থেকে দর্শকদের চিৎকার কানে পৌঁছনো মাত্র অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার তাগিদটা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সপ্তাহখানেক আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় ফুটবল শুরু হওয়ার ম্যাচে স্টেডিয়ামের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে বাজানো হয়েছিল দর্শকদের চিৎকারের শব্দ। কারণ, ফাঁকা স্টেডিয়ামে খেলা ফুটবলারদের কাছে অভিশাপ ছাড়া কিছু নয়।
শনিবার সিগন্যাল ইদুনা পার্ক স্টেডিয়ামে এই প্রথম হয়তো একটা খেলা হল, যেখানে সারা মাঠে দর্শকদের চিৎকার নেই। নিঃস্তব্ধ স্টেডিয়ামে শোনা যাচ্ছে শুধু রেফারির বাঁশির আওয়াজ। চারটে গোলের পরে চার বার লম্বা বাঁশির শব্দ যেন ঘোষণা করছিল— জার্মানিতে ফুটবল ফিরল মূলস্রোতে।
বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতা লিগে মোহনবাগান বনাম মহমেডান ম্যাচ হয়েছিল ফাঁকা মাঠে। সম্ভবত বারাসত স্টেডিয়ামে খেলাটা ছিল। আমি তখন মহমেডানের হয়ে খেলছি। কোনও একটা কারণে পুলিশ পাওয়া যায়নি। ফলে আমাদের দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে খেলতে হয়েছিল। সে দিন কিছুতেই মনঃসংযোগ করতে পারছিলাম না খেলায়। আমার মনে হয়, এর্লিং হালান্ড, মাটস হুমেলসরাও শনিবার মাঠে নেমে হতাশ হয়েছিলেন। অবশ্য করোনা সংক্রমণ রুখতে দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে খেলা ছাড়া উপায়ও নেই। এই মুহূর্তে মানুষের জীবনের চেয়ে কোনও কিছুই মূল্যবান নয়।
ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে ফুটবলারেরা কেউ কারও সঙ্গে হাত মেলালেন না, একসঙ্গে ছবি তুললেন না। দু’দলের এগারো জন ফুটবলার ও রেফারি ছাড়া বাকিরা সকলেই মুখাবরণ পরে সারাক্ষণ শারীরিক দূরত্ব রেখে চললেন। সকলের আগ্রহ ছিল, গোল হওয়ার পরে ফুটবলারেরা কী করেন তা নিয়ে। উত্তেজনা ও আনন্দে বিধিনিষেধ মানতে ভুলে যেতেই পারেন তাঁরা। দক্ষিণ কোরিয়ায় ফুটবল ফেরার দিন সেটাই দেখেছিলাম। জার্মানি সব সময়ই ব্যতিক্রম। অসম্ভব শৃঙ্খলাপরায়ণ। ২৯ মিনিটে হালান্ড গোল করে বরুসিয়াকে এগিয়ে দেওয়ার পরে ফুটবলারেরা উল্লাস করলেন শারীরিক দূরত্ব রেখেই। একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখলাম ৪৫ ও ৬৩ মিনিটে রাফায়েল গুয়েইরোর এবং এডেন অ্যাজ়ারের ভাই তোহগান অ্যাজ়ারের অসাধারণ গোলের পরে।
শনিবার বুন্দেশলিগা ডার্বিতে দেখলাম, পরিবর্ত নামানোর সময়ে ফুটবলার মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই সঙ্গে-সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীরা জলের বোতলের সঙ্গে মুখাবরণও এগিয়ে দিচ্ছেন। ফুটবলারেরা গিয়ে বসছেন রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে অনেক দূরে। খেলা শেষ হওয়ার পরের দৃশ্যটাও মুগ্ধ করার মতো। ফাঁকা গ্যালারির সামনে গিয়ে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালেন বিজয়ী বরুসিয়ার মারিয়ো গোৎজ়ে, ম্যাটস হুমেলসরা। আশি হাজার দর্শক ভর্তি স্টেডিয়ামে যে ভাবে দু’হাত তুলে অভিবাদন গ্রহণ করতেন, ঠিক সেই ছবি।
ফাঁকা স্টেডিয়ামে খেলার যন্ত্রণা যেন এ ভাবেই ভোলার চেষ্টা করলেন বরুসিয়ার ফুটবলারেরা। করোনা-উত্তর ফুটবল। সারা পৃথিবীতেই নতুন নিয়ম আর নতুন অভ্যাসে মানিয়ে নেওয়ার সময় উপস্থিত!