রোববার সন্ধের ইন্টারন্যাশনাল কল-এ অভিষেক ডালমিয়া বলছিলেন, ‘‘বাবা এখন অনেক ভাল আছেন। দুটো স্টেন্ট বসেছে। আগামী দু-তিন দিনে বাড়ি নিয়ে যেতে পারব। তবে ডাক্তার যা বলবে, সতর্কতা হিসেবে তার চেয়ে হয়তো আমরা চব্বিশ ঘণ্টা বেশিই রেখে দেব।’’ অনেক টেনশনহীন শোনাচ্ছিল অভিষেকের গলা। ‘‘বাবাকে পুরোটা বলিনি। সুস্থ হলে বলব, কী হয়েছিল।’’
ডালমিয়া-পুত্রের সঙ্গে কথোপকথন ব্রেকফাস্ট লাউঞ্জে বসা দিলীপ বেঙ্গসরকরকে জানানো মাত্র তিনি লাফিয়ে উঠলেন। ‘‘তার মানে বাইপাস দরকার হচ্ছে না। উনি বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরের টার্মটাও চালাতে পারবেন।’’ একটু দূরে অজিত ওয়াড়েকর। সস্ত্রীক লাঞ্চে বেরোচ্ছেন। রাতে তাঁর একাত্তরের সোনার টিমকে নিয়ে এখানকার সান মারিনো ক্লাবে অনুষ্ঠান। ওয়াড়েকরও হার্টের রোগী। ডালমিয়ার কুশল জিজ্ঞেস করে বললেন, ‘‘জগুদা হলেন ক্রিকেট প্রশাসকদের গাওস্কর। এত সহজে ওঁকে আউট করা যাবে না।’’
জগমোহন ডালমিয়া
জন্ম ৩০ মে, ১৯৪০
মৃত্যু ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫
কলকাতার মারোয়াড়ি পরিবারের সন্তান। খেলেন স্কটিশ চার্চের কলেজ ক্রিকেট টিমে। ক্লাব ক্রিকেটে শুরুটা উইকেটরক্ষক হিসাবে। ক্লাব পর্যায়ে ডাবল সেঞ্চুরি আছে। ষাটের দশকে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিয়ে খেলা থেকে সরে যান। ক্রিকেট প্রশাসনে হাতেখড়ি এক দশকের মধ্যেই।
১৯৭৯ ভারতীয় বোর্ডে যোগ।
১৯৮৩ বোর্ডের কোষাধ্যক্ষ।
ইন্দ্রজিৎ সিংহ বিন্দ্রা ও ডালমিয়ার চেষ্টায় ১৯৮৭ ও ১৯৯৬ বিশ্বকাপ উপমহাদেশ।
১৯৯৬ ম্যালকম গ্রেকে ২৩-১৩ হারান। দুই তৃতীয়াংশ ভোট না পেয়ে আইসিসি চেয়ারম্যান হতে ব্যর্থ।
১৯৯৭ সর্বসম্মতিক্রমে আইসিসি প্রেসিডেন্ট। ২০০০ টিভি রাইটস বিবাদে আইসিসি ছাড়েন।
২০০১ ভারতীয় বোর্ড প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত।
২০০৪ বোর্ড নির্বাচনে ডালমিয়ার কাস্টিং ভোটে রণবীর সিংহ মহেন্দ্রের বিতর্কিত জয়।
২০০৫ কলকাতায় বোর্ড নির্বাচনে শরদ পওয়ারের কাছে ডালমিয়া গোষ্ঠীর পরাজয়।
২০০৬ তহবিল তছরুপের অভিযোগে বোর্ড থেকে বহিষ্কৃত। সিএবি-ও ছাড়তে হয়।
২০০৭ কোর্টে নির্দোষ প্রমাণিত। ২০০৮ ফের সিএবি প্রেসিডেন্ট। ২০১৩ স্পট ফিক্সিংয়ের জেরে এন শ্রীনিবাসন সরে দাঁড়ালে বোর্ডের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানের দায়িত্বে।
২ মার্চ, ২০১৫ ভারতীয় বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত। ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি।
পরের কুড়ি মিনিটের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রয় শহরে হিল্টন এমব্যাসি স্যুইটসের লাউঞ্জের ভিডিও তোলা হলে মনে হতো, ওটাও বুঝি ছোট কেওড়াতলা! একটা সময় প্রচার করা হতো, ডালমিয়া হলেন ক্রিকেটারদের শত্রু। সেটা আশির দশকের শেষ দিক। ডালমিয়া নিজেও সেটা জানতেন বলে নিরন্তর প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, তিনি হলেন ক্রিকেটারদের কর্মকর্তা, কর্মকর্তাদের কর্মকর্তা নন। এ দিন লাউঞ্জে আট প্রাক্তন ক্রিকেটারের মুহ্যমান ছবিটা যদি ৭৫-এ ইনিংস শেষ করা ডালমিয়া দেখতেন, তা হলে হয়তো শান্তি পেতেন এই যুদ্ধটাও জিতেছেন বলে।
ওয়াড়েকর বলছিলেন, ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসকদের গাওস্কর! একই সঙ্গে গাওস্কর ও কপিলদেব বললেও হয়তো বাড়িয়ে বলা হতো না। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় ক্রিকেটে এই রকম বিস্তৃত প্রভাব জীবিত বা মৃত কোনও কর্মকর্তার নেই। মাঝে নির্বাসনের ক’বছর বাদ দিলে ভারতীয় ক্রিকেটের একচ্ছত্র মুকুট রাখা থাকত ডালমিয়ার আলিপুরের বাড়িতে। দশ নম্বর আলিপুর রোডকে বলা হতো ভারতীয় ক্রিকেটের দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট। ক্রিকেটারদের মধ্যে গাওস্কর ও প্রশাসকদের মধ্যে তিনি— এই যুগলবন্দি তিন দশক রাজ করে গিয়েছে।
সিএবি-র দোতলায় বাঁ দিকে কোনার যে ঘরে তিনি বসতেন, ওটা পরবর্তী কালে ক্রিকেট-রসিকের অদৃশ্য সংগ্রহশালা হওয়া উচিত। ওই ঘরটা থেকেই যে বিশ্ব ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ করেছেন অনায়াসে। ফেসবুক-টুইটার-ল্যাপটপের পৃথিবী অচেনা ছিল তাঁর কাছে। বরং আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে কিছু ডালমিয়া জোক রয়েছে ময়দানে। এবং এখানেই হয়তো তাঁর নৈপুণ্য। তিনি রাজ করেছেন এমন ক্রিকেট পৃথিবীতে, যা ইন্টারনেট-পূর্ব। ঘরের কোনায় ওই ফোনটা— নম্বরটা যত দূর মনে পড়ছে ২২৪৮-১১৪৪। সেই টেলিফোন থেকেই আবর্তিত হয়েছে গোটা বিশ্ব ক্রিকেট। ওই ফোন ঘোরানো ম্যান ম্যানেজমেন্টের নৈপুণ্যেই বলতে গেলে আইসিসি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নির্বাসন ওঠার পর দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রথম ইডেনে খেলিয়েছেন। সম্ভাবনার কঠিনত্ব বিচারে যা পেলে-র কসমস টিম নিয়ে ইডেনে নামার আগে থাকবে।
জীবনে কখনও ডেল কার্নেগি পড়েননি। ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপ্ল’ নামটা জানার প্রশ্নই নেই। কিন্তু যে কোনও লোককে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার অসম্ভব ক্ষমতা ছিল। নীতি আর বুদ্ধিতে অসাধারণ। গাওস্কর শোকগাথায় ঠিকই বলেছেন, ‘‘প্রচুর কঠিন পরিস্থিতি তিনি সামলেছেন। যাকে ক্রিকেটের ভাষায় বলে ব্যাড উইকেট সিচুয়েশন।’’
শেষ টেস্টে ওঁর ভূমিকা সারাজীবন মনে রাখব: সচিন
তিনি আর এক কালের বন্ধু বিন্দ্রা বিদেশি স্যাটেলাইট টিভিকে ক্রিকেটে এনেছেন দুরদর্শনকে বাতিল করে। সবচেয়ে বড় কীর্তি লর্ডসে বসে সাহেবদের উপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন। তখন বিন্দ্রা পাশে নেই তিনি একা। ব্রিটিশ প্রেস যা ইচ্ছে তাই লিখেছে। পরোয়াই করেননি। বরঞ্চ বিশ্ব ক্রিকেটে শ্বেতাঙ্গ দেশদের করে দিয়েছেন অপাংক্তেয়। যে মডেল আজও সফল ভাবে ব্যবহার করে যাচ্ছেন শ্রীনিবাসনরা।
ডালমিয়াই সম্ভবত একমাত্র ক্রিকেট শাসক যিনি কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লড়ে কোর্টে জিতেছেন। আর তার চেয়েও বড় কৃতিত্ব কলকাতাকে তুলে এনেছেন বিশ্ব ক্রিকেট মানচিত্রে। স্রেফ একক চেষ্টায়। ইডেনে বিশ্বকাপ ফাইনাল থেকে শুরু করে বড় বড় সব ম্যাচ এনেছেন। আগামী এপ্রিলে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালও তো তাঁরই আনা।
বাঙালি ক্রিকেট রসিকের কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়েছেন ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা। এমনই বজ্রআঁটুনি ছিল সেই নিরাপত্তা যে সৌরভের সমালোচকেরা বলতেন, ওকে ঘাঁটানো যাবে না। কিছু হলেই তো গাঙ্গুলি ০৩৩ ডায়াল করবে। অর্থাৎ কলকাতার কোড। আরও পরিস্কার ভাবে বলা ভাল ডালমিয়া না থাকলে ভারতীয় ক্রিকেট বেহালাবাসী সর্বকালের সেরা অধিনায়ককে পেতই না।
একই সঙ্গে রাজ্য, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তিন রকম ক্রিকেট মানচিত্রে এমন দাপট ভারতীয় ক্রিকেট কখনও দেখেনি। নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন একমাত্র নমুনা। কিন্তু তিনি বিতর্কে বিতর্কে অনেক বেশি কলঙ্কিত।
ডালমিয়া বিশ্লেষকদের অবশ্য পরবর্তীকালে মনে হতে পারে তিনি ক্ষমতায় থাকতে যত উৎসাহী ছিলেন আদর্শগত যুদ্ধে সওয়ার হতে ততটা ছিলেন না। ক্রিকেট প্রশাসনে তাঁর গুরু বিশ্বনাথ দত্তও বরাবর বিশ্বাস করে এসেছেন কর্মকর্তাকেও প্লেয়ারের মতো টপ ফর্মে সরে যেতে হয়। অশীতিপর বিশুবাবু সরে যান সেই কবে— আজ থেকে ২৬ বছর আগে। ডালমিয়া এই দর্শনে বিশ্বাসের কারণই দেখেননি।
চিরবিদায়ের পর উঠে এল প্রশ্ন
শেষ দেড় দু’বছর তিনি যে পুরনো ডালমিয়া ছিলেন না, গোটা ভারতীয় ক্রিকেট জগৎ জানে। সেই অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তি। সেই পরিশ্রম ক্ষমতা। সেই ক্ষুরধার বুদ্ধি। স্বাস্থ্যজনিত কারণে যে অন্তর্হিত হয়ে বারবার তাঁকে সমস্যায় ফেলছিল ভালই বুঝতেন। কিন্তু তিনি মোট রানে বিশ্বাসী ছিলেন স্টাইলে নন। তাই গায়ে বল লাগছে কি না, আগের চেয়ে সহজ ডেলিভারিতে আউট হচ্ছেন কি না, এসব চিন্তায় মনকে ভারাক্রান্ত হতে দেননি। নিজের দর্শন অক্ষুণ্ণ রেখেই ডালমিয়া বিদায় নিলেন। যতক্ষণ রাজা, ততদিনই রাজত্ব। এসব নিয়ে ভাবালুতার কোনও ব্যাপার নেই।
ভাবি ক্রিকেট ইতিহাস হয়তো এই প্রশ্নও করবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রশাসক হিসেবে তুঙ্গস্পর্শী সাফল্যের মই ধরতে গিয়ে তাঁর নেতৃত্বে কোথাও কি স্থানীয় ক্রিকেট প্রশাসন অবহেলিত হয়েছিল? প্রশাসনে গ্যারি সোবার্সোচিত পারফরম্যান্সের পরেও আজও তো সিএবি-র নিজস্ব কোনও স্টেডিয়াম নেই। কলকাতায় তাদের কোনও আকাদেমি নেই। নিজস্ব সাঁতারের পুল নেই। কোনও সিইও নিযুক্ত হননি। প্রশাসনে ডালমিয়াতুল্য আধুনিকতা আসেনি।
এটাও তো ঠিক হল না যে, বঙ্গজ ক্রিকেট প্রশাসনে তাঁর বংশধর কে। ধুরন্ধর প্রশাসকেরও নিকটতম কোনও কর্মকর্তা থাকে। ভবিষ্যৎ তাকে মেনে নিক বা না নিক প্রশাসকেরা কাউকে চিহ্নিত করেননি। ডালমিয়া তেমন কোনও ক্রিকেট-উইল সচেতন ভাবেই করেননি। তাই জানার কোনও উপায় নেই যে পরবর্তী সিএবি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কাকে ভেবে রেখেছিলেন? ভারতীয় বোর্ডেই বা কলকাতা থেকে তাঁর উত্তরাধিকার কে?
জীবদ্দশায় এমন কাউকে তৈরি করছিলেন না কেন জিজ্ঞেস করায় এই সাংবাদিককে বলেছিলেন, আমি ওটায় বিশ্বাস করি না। গণতন্ত্রে আপনা থেকেই বিকল্প তৈরি হয়ে যায়। ইন্দিরা গান্ধী মারা যাওয়ার পর কি দেশ চলেনি?
অপ্রীতিকর এই প্রশ্নগুলোর অবশ্য স্বল্পকালীনভাবে ডানা ঝাপটানোর কোনও অবকাশ নেই। আপাতত চূড়ান্ত হাহাকার ও শূণ্যতা গ্রাস করবে বাংলা ক্রিকেটকে। গোটা ভারতীয় ক্রিকেট এই অঞ্চলের একটামাত্র লোককে সমীহ করত। সেই লোকটাই কি না চলে গেল কোনও বিকল্প তৈরি না করে!
বাংলা ক্রিকেট ডালমিয়ার উত্থানের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে যে মর্যাদার জৌলুস নিয়ে ঘুরত। সেটাও এখন ভয় হচ্ছে তাঁর সঙ্গে চুল্লিতে চলে গেল। ডালমিয়া চলে গেলেন। বাংলা ক্রিকেটেকেও হয়তো নিয়ে গেলেন নিজের সঙ্গে!