এককাট্টা: অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে কেপ টাউন টেস্টের অনুশীলনে ভারতীয় দল। জিতলেই সিরিজ় দখল করে নজির গড়বে ভারত। বিসিসিআই
কেপ টাউন! শুনলেই প্রথমে চোখের সামনে ভেসে উঠবে টেবল মাউন্টেনের সারি। নিউল্যান্ডস মাঠের গা বেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মনে হবে, ক্রিকেট মাঠ নয়, শিল্পীর তুলির টানে আঁকা কোনও অপরূপ ছবি দেখছি।
রবিবারও বিরাট কোহলিরা কেপ টাউনে প্রস্তুতি শুরু করতেই বোর্ডের টুইটারে যে ছবি তুলে দেওয়া হল, মন্ত্রমুগ্ধ করে দেওয়ার মতো! টেবল মাউন্টেনের অপরূপ সৌন্দর্যকে সাক্ষী রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ‘হাডল’ করছে ভারতীয় দল। সিরিজ় ১-১। ঐতিহাসিক জয় ছিনিয়ে নেওয়ার শপথগ্রহণের জন্য এর চেয়ে আদর্শ পরিবেশ আর কী হতে পারে!
কেপ টাউন মানে ক্রিকেটের পাশাপাশি ট্যুরিস্টদের স্বর্গ। টেবল মাউন্টেনের অপূর্ব শোভা তো আছেই। সঙ্গে রোপওয়ে চড়ো, বোটানিক্যাল গার্ডেন্স, ওয়াটারফ্রন্ট— যা সব চেয়ে জমজমাট থাকে ৩১ ডিসেম্বর রাতে। দশ বছর আগে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির দলের সঙ্গে সফরে গিয়ে যেমন দেখা গিয়েছিল, নিউ ইয়ার পালন করতে চলে এসেছেন কিম কার্দাশিয়ান। রবেন আইল্যান্ড অবশ্যই ঘুরে আসতে হবে। যেখানকার কারাগারে ১৮ বছর বন্দি ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। ওয়ান্ডারার্সে ডিন এলগারদের হাতে বন্দি ভারতীয় দলের জন্য সেরা অনুপ্রেরণা হতে পারে ‘মাডিবা’র লড়াই। কী ভাবে একটা অন্ধকার ঘুপচি ঘরে বছরের পর বছর আটকে থেকেও দেশকে বর্ণবৈষম্যের অভিশাপমুক্ত করার অদম্য জেদ ধরে রাখা যায়! আছে ‘কেপ অব গুড হোপ’— আশার প্রতীক, শুভলক্ষণ বলে ধরা হয়।
যদিও কোভিড আর ওমিক্রন-বিধ্বস্ত পৃথিবীতে বিরুষ্কার পক্ষে ‘কেপ অব গুড হোপ’-এর শোভা দেখতে দেখতে রোম্যান্টিক রেস্তরাঁয় বসে ক্যাপুচ্চিনোয় চুমুক দেওয়ার উপায় নেই। কোভিডের দুনিয়ায় ক্রিকেটারেরা এখন অনেকটা সার্কাসের বাঘ, সিংহের মতো। জৈব সুরক্ষা বলয় নামক খাঁচার ভিতরে থাকো, যখন খেলা দেখানোর সময় বার করা হবে, খেলা দেখিয়ে আবার খাঁচায় ঢুকে পড়ো, বেরোবে যখন ফের খেলা দেখানোর সময় হবে।
একাগ্র: নেটে ব্যাটিং মহড়ায় বিরাট। রবিবার।
আর সুন্দর কেপ টাউন থাকলে ভয়ঙ্কর কেপ টাউনও যে আছে! বিশেষ করে অতিথি দলের ব্যাটসম্যানদের জন্য। ডেল স্টেন ও ভার্নন ফিল্যান্ডারের অসাধারণ সব সাফল্য রয়েছে। নিউল্যান্ডস মাঠে স্টেন নিয়েছেন ৭৪ উইকেট, ফিল্যান্ডারের ঝুলিতে ৫৩ শিকার। শন পোলকের রয়েছে ৫১ উইকেট, অ্যালান ডোনাল্ডের ৩০ এবং বর্তমান দলের প্রধান পেসার কাগিসো রাবাডার ৩৫ উইকেট। সেই রাবাডা, যিনি ওয়ান্ডারার্সে এক আগুনে স্পেলে চেতেশ্বর পুজারা ও অজিঙ্ক রাহানেকে তুলে নিয়ে কার্যত টেস্টের ভাগ্যই গড়ে দিয়ে চলে যান।
কোহলির মতো ডাকাবুকো ক্রিকেটারের কাছে একই সঙ্গে চাপ ও সুযোগ যে, চোট সারিয়ে কেপ টাউনেই ফেরার শপথ নিতে হচ্ছে। চাপ কারণ, গতির আগুনকে পাল্টা আগুন দিয়ে মোকাবিলা করার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। বিশেষ করে যখন রাবাডা টপ গিয়ারে, বাঁ হাতি মার্কো জ্যানসেনও টগবগে হয়ে ফুটছেন। আর তিনি সে রকম রানের মধ্যে নেই। দু’বছর ধরে অধরা সেঞ্চুরির খোঁজে। অধিনায়কত্ব-বিতর্কে বিদ্ধ, বিষণ্ণ, বিধ্বস্তও দেখাচ্ছে। রবিবারও যেমন চর্চা চলল চোট সারিয়ে তাঁর ফেরা নিয়ে তেমনই কৌতূহল— সোমবার সাংবাদিক সম্মেলনে কি অধিনায়ক আসবেন? এলে কি ফের স্ফুলিঙ্গ উড়বে? চেতন শর্মার বিবৃতির জবাব দেবেন? আবার কোহলির সামনে কেপ টাউন টেস্ট বড় সুযোগও কারণ তাঁর মতো চ্যাম্পিয়নরা এমনই মঞ্চ খোঁজেন। মহম্মদ আলি যেমন বলেছিলেন, ‘‘হচ্ছে না বলে হাল ছেড়ে দিয়ে চলে যেও না। পড়ে থাকো, লড়াই করো, শরীরের আঘাত নাও, কড়া ট্রেনিংয়ে নিজেকে ডুবিয়ে দাও। এখন অত্যাচার, যন্ত্রণা সহ্য করো। তা হলে বাকি জীবন কাটাতে পারবে চ্যাম্পিয়নের মতো।’’
কেপ টাউন হল সেই স্টেশন, যেখান থেকে অধিনায়ক কোহলির বিদেশ-অভিযানের স্বপ্ন দেখা শুরু। চার বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে এসে এখানেই প্রথম টেস্টের আগে তিনি টিমের সামনে উত্তেজিত বক্তব্য রেখেছিলেন যে, ‘‘চলো, হোম আর অ্যাওয়ের কাঁটাতার উপড়ে ফেলে দেখাই আমরা। মুম্বই, দিল্লিতে যা পারি, কেপ টাউনে পারব না কেন?’’ দক্ষিণ আফ্রিকাকে বাগে পেয়েও সেই টেস্ট হেরে যায় কোহলির দল। চতুর্থ ইনিংসে ২০৮ রানের টার্গেটের সামনে ১৩৫ রানে ভেঙে পড়ে ব্যাটিং। সিরিজ়ও হারে। কিন্তু শেষ টেস্টে জোহানেসবার্গের বিপজ্জনক পিচে জিতে বিশ্বাস তৈরি হয় ড্রেসিংরুমে যে, ‘‘আমরাও পারি।’’ সেই বিশ্বাসের ভিতের উপরেই তৈরি হয় অ্যাডিলেড, মেলবোর্ন, ব্রিসবেন, লর্ডস, ওভাল জয়ের ইমারত। এখানেই যশপ্রীত বুমরার লাল বলের বোলার হিসেবে আবির্ভাব। চার বছর পরে সেই মাঠে ফিরছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা পেসার হিসেবে। কেপ টাউনে রাবাডা বাহিনী বনাম বুমরা-শামিদের দ্বৈরথ জেমস বন্ড ফিল্মের টানটান উত্তেজনা আর রুদ্ধশ্বাস নাটক নিয়ে উপস্থিত হতে যাচ্ছে। নৈপুণ্যের চেয়েও ব্যাটসম্যানদের এখানে বেশি করে লাগবে মেরুদণ্ড।
কেপ টাউনে কখনও টেস্ট জেতেনি ভারত। তবে অদৃশ্য জাদুঘর ধরে হাঁটলে কিছু মণিমুক্তোর সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন ১৯৯৭-এ সচিনের সঙ্গে জুটিতে মহম্মদ আজ়হারউদ্দিনের সেই অবিশ্বাস্য কাউন্টার অ্যাটাক। ডোনাল্ড, পোলক, ক্লুজ়নারদের বিরুদ্ধে ১১০ বলে ১১৫ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন আজ়হার। ৫৮-৫ থেকে ২২২ রান যোগ করেন তাঁরা। গ্যারি কার্স্টেন পরে বলেছিলেন, এমন টেস্ট ইনিংস কখনও দেখেননি। ২০১১-তে সচিন তেন্ডুলকরের একান্নতম ও শেষ টেস্ট সেঞ্চুরি এখানে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কেউ কেউ মনে করেন, পার্থে ঝাঁকড়া চুলের বিস্ময় বালকের মার্ভ হিউজ়দের শাসনের পরে কেপ টাউনের সেঞ্চুরিই সচিনের জীবনের সেরা। সেই সফরে টেস্টে তাঁর পঞ্চাশ এবং একান্নতম সেঞ্চুরি করেছিলেন সচিন। কিন্তু তাঁর সেরা স্ট্রোক ছিল সেঞ্চুরিয়নে প্রথম টেস্টে হারার পরে দলকে ডেকে বলা যে, ‘‘এখন কেউ হোটেলে ফিরব না। পরাভূত রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে প্রস্তুতি নেব। শপথ নেব সিরিজ়ে ফিরে আসার।’’ হেরে যাওয়া বাইশ গজেই ফের নেমে পড়ে ভারতীয় দল। সেই অধ্যবসায়ের ফল পাওয়া গিয়েছিল হাতেনাতে। ডারবানেই পরের টেস্ট জিতে সিরিজ় ১-১ করে ফেলে ভারত। এমনই সবুজ পিচ বানিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা যে, হরভজন সিংহ মাঠে এসে বলেছিলেন, ‘‘এখানে কি ক্রিকেট ম্যাচ হবে নাকি গরু-ছাগল ছেড়ে দেবে ঘাস খাওয়ার জন্য?’’ পাশ থেকে জাহির খানের মন্তব্য ছিল, ‘‘এই ঘাসই ওদের ব্যুমেরাং হবে।’’ ঠিক তা-ই হয়েছিল।
বুমরার টেস্ট অভিষেকে তীরে এসে তরী ডোবার স্মৃতি নিশ্চয়ই ভোলেননি কোহলি। আশা জাগিয়েও সে দিন অদৃশ্য হয়ে যায় ‘কেপ অব গুড হোপ’। চার বছর পরে সেখানেই তিনি টস করতে নামবেন ‘লাস্ট ফ্রন্টিয়ার’ বা শেষ সীমান্ত জয় করার লক্ষ্য নিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম ভারত অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট সিরিজ় জেতার লক্ষ্য নিয়ে। ভয়ঙ্কর-সুন্দর কেপ টাউন— যা এখনও জয় করা হয়নি!