ইংল্যান্ডের জিম লেকার প্রথম বোলার হিসেবে টেস্টের এক ইনিংসে দশ উইকেট নিয়েছিলেন। ফাইল চিত্র।
টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৪ বছরের ইতিহাসে অজাজ় পটেলের মতো কৃতিত্ব কেউ অর্জন করতে পারেনি। অজাজ়ই বিশ্বের একমাত্র বোলার যে কি না টেস্টের প্রথম ইনিংসে দশ উইকেটের দশটাই পেয়েছে।
১৯৮৮-তে মুম্বইয়ে (তখন বম্বে) জন্ম অজাজ়ের। নিউজ়িল্যান্ডে পাড়ি দিলেও সেখান থেকে জন্মস্থানে ফিরল ওয়াংখেড়েতে ইতিহাস সৃষ্টির জন্য। ক্রিকেট ইতিহাসের তৃতীয় বোলার হিসেবে এক ইনিংসে দশ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব অর্জন করল ভারতীয় বংশোদ্ভুত স্পিনার।
১৯৫৬-তে ম্যাঞ্চেস্টারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের জিম লেকার প্রথম বোলার হিসেবে টেস্টের এক ইনিংসে দশ উইকেট নিয়েছিলেন। ১৯৭৭-তে টেস্ট ক্রিকেট চালু হওয়ার পরে সেই প্রথম এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা কেউ বাস্তবে করে দেখালেন। এর পরে ১৯৯৯-তে দিল্লির ফিরোজ শা কোটলায় অনিল কুম্বলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই অভিনব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। দু’টি ক্ষেত্রেই কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে এই কীর্তি গড়েছিলেন লেকার ও কুম্বলে।
কিন্তু লেকারের কীর্তি বোধ হয় এখনও কল্পনা করাও কঠিন। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের সেই টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে মোট ১৯ উইকেট নিয়েছিলেন লেকার। যা আজও বিস্ময়ের চোখে ফিরে দেখি আমরা। সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে মাত্র ২৭ রানে ৯ উইকেট নিয়েছিলেন লেকার। একটি টেস্টে ১৯টি উইকেট নেওয়ার এই কীর্তি হয়তো সারাজীবন অক্ষতই থেকে যাবে। ঘটনা হচ্ছে, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের টেস্টেই প্রথম নয়। এর কয়েক দিন আগে সে বছরেই ওভালে সারের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচে এক ইনিংসে দশ উইকেট নেন তিনি। যে তিন জন ইনিংসে দশ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করলেন, তাদের মধ্যে মিল-অমিল দুই’ই আছে। যেমন তিন জনেই স্পিনার। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের স্পিন শিল্পের প্রতিনিধি। লেকার ছিলেন অফস্পিনার, কুম্বলে লেগস্পিনার, এ বার বাঁ হাতি স্পিনার অজাজ় পটেল সেই ক্লাবে ঢুকে পড়ল। লেকার এবং কুম্বলে তাঁদের ঘরের মাঠে দশ উইকেট নেওয়ার কীর্তি অর্জন করেছিলেন, অজাজ় ইতিহাস সৃষ্টি করল বিদেশের মাঠে। তবে তার ক্ষেত্রে একপ্রকার ঘরের মাঠে ফেরার আবেগও যুক্ত থাকল, যে-হেতু মুম্বইয়েই জন্মেছে এবং সেখানে শুরুর দিকে ক্রিকেটও খেলেছে। লেকার ও কুম্বলের কীর্তি তাঁদের দলকে জিতিয়েছিল। অজাজ়ের দশ উইকেটের পরেও নিউজ়িল্যান্ড খুব বড় ব্যবধান হেরে গেল। তবু হেরে গেলেও জন্মগ্রহণের শহরে এসে দশ উইকেটের রূপকথা অজাজ়কে রাতারাতি নায়কের
আসনে বসিয়েছে।
যতই এই তিন জনের কীর্তির দিকে তাকাচ্ছি, একটা কথা মনে হচ্ছে। হয়তো দশ উইকেট তাঁর পরেও দু’জনে পেয়েছে। কিন্তু জিম লেকারের এক টেস্টে ১৯ উইকেটের রেকর্ড কেউ ভেঙে দিতে পারবে বলে কল্পনা করতে পারছি না। অফস্পিনারদের কাছে আদর্শ ছিলেন লেকার। সুন্দর, সহজ অ্যাকশন। ধীরস্থির মনোভাব, ঠান্ডা মাথায় কাজ সারতেন। একদম নিষ্প্রাণ পিচেও তিনি এক হাত করে বল ঘোরাতে পারতেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮— দারুণ সফল কেরিয়ার ছিল তাঁর। জর্জ হেডলি, ক্লাইড ওয়ালকট, বিনু মাঁকড়, নীল হার্ভিদের মতো ব্যাটারকে সমস্যায় ফেলেছেন অহরহ। অবিশ্বাস্য বোলিং নৈপুণ্যে যে কোনও ক্রিকেট ম্যাচের রং একার হাতে পাল্টে দেওয়ার বিরল ক্ষমতা ছিল তাঁর। ১৯৫০ সালে এক বার ইংল্যান্ডের একটি ট্রায়াল ম্যাচ হচ্ছিল। লেকার মাত্র ২ রান দিয়ে ৮ উইকেট নিয়েছিলেন।
এত সব কীর্তি গড়েও যে সম্মান তাঁর প্রাপ্য ছিল, তা কখনও পাননি লেকার। পণ্ডিতরা অনেকেই মনে করতেন, তিনি বিশ্বের সেরা অফস্পিনার ছিলেন। সারের হয়ে খেললেও তাঁর মনোভাব বলেই দিত, ইয়র্কশায়ারে তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। শান্ত প্রকৃতির হলেও সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে কখনও ভয় পেতেন না। সেই কারণে প্রতিষ্ঠানের খুব প্রিয় হতে পারেননি কখনও। তবে পরে বিবিসি-র দারুণ ধারাভাষ্যকার হয়ে উঠেছিলেন। স্যর ডন ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়ের মতোই জিম লেকারের এক টেস্টে ১৯ উইকেট হয়তো সারাজীবন ক্রিকেটের অমর সৃষ্টি হয়ে
থেকে যাবে।