মহড়া: মোহালিতে ভারতের অনুশীলনে কোচ দ্রাবিড়ের সঙ্গে আলোচনা অধিনায়ক রোহিতের। ছবি: পিটিআই।
ঈশান কিষানদের আড়াল করতে কেউ না কেউ যে আসরে নামবে জানাই ছিল। কারও কারও ধারণা ছিল, আইপিএলের রমরমার যুগে তাঁর ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি হয়তো হা রে রে করে তেড়ে আসবে। ক্রিকেট মহলের জানা ছিল না, তিনি রাহুল দ্রাবিড়—এতকালের ক্রিকেট সংস্কার, দীক্ষা, অনুশাসন জলাঞ্জলি দিয়ে বখাটে ছাত্রদের বাঁচাতে ঢাল হয়ে এগিয়ে আসবেন।
ঈশান কিষান ও শ্রেয়স আয়ারের মনোভাব নিয়ে যে জাতীয় নির্বাচকেরা ক্ষুব্ধ, সেই এক্সক্লুসিভ খবর প্রথম প্রকাশিত হয়ে আনন্দবাজারে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজ় থেকে তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তা লেখা হয় সেই প্রতিবেদনে। বুধবার সেই খবর সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে পুনঃপ্রচারিত হতে থাকে। যার আঁচ পৌঁছয় মোহালিতে থাকা ভারতীয় দলের মধ্যেও। রাহুল দ্রাবিড় সাংবাদিক সম্মেলনে এলে তাঁকে একাধিক প্রশ্ন করা হয় এই খবর নিয়ে।
দুই তরুণের শৃঙ্খলা নিয়ে যে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে, তা অস্বীকার করতে গেলে এটাও মানতে হয় যে, গ্রেগ চ্যাপেল কখনও সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে সরাতে চাননি। অথচ, ভারতীয় দলের কোচ ঠিক সেটাই করে গেলেন। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজ়ের প্রথম ম্যাচের আগে দ্রাবিড় দাবি করলেন, ঈশান এবং শ্রেয়স আয়ারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের প্রশ্ন ওঠেনি। তাঁদের বাদ যাওয়ার কারণ তা হলে কী? শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে গেলেন দ্রাবিড়, ‘‘ওদের ঠিক জায়গা হল না দলে।’’
বুঝুন। শ্রেয়স আয়ার সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বকাপে রান করেছেন। দুটো শতরান ছিল। ঈশানকে ধোনি-পরবর্তী যুগে সাদা বলে অন্তত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান ধরা হচ্ছিল। তা হলে আচমকা তাঁদের জায়গা হবে না কেন? বিশেষ করে যখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে এটাই একমাত্র কুড়ি ওভারের সিরিজ়। কয়েক দিন আগেও কেউ ভাবতে পেরেছিল, এই দু’জনকে ছাড়া টি-টোয়েন্টি দল গড়া হবে? তা হলে ‘জায়গা হল না’ কী ভাবে?
শুধু তাই নয়, এর পর দ্রাবিড় যা বলেছেন, তা আরও হাস্যকর। তাঁর দাবি, ঈশান নাকি বিরতি চেয়েছেন ক্রিকেট থেকে। তার পর এখনও জানাননি যে, তিনি ভারতের জার্সিতে ফিরতে চান। তাই নাকি তাঁকে বিশ্রামেই রাখা হয়েছে। ‘‘না, না একদমই কোনও শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা ঘটেনি। ঈশান দক্ষিণ আফ্রিকাতে থাকাকালীনই বিশ্রাম চেয়েছিল। আমরা সেটা মঞ্জুর করেছিলাম। তার পর আর জানায়নি, ও খেলবে কি না। তাই এই সিরিজ়ে ওকে পাওয়া যাবে না, তাই ও নেই।’’
মানেটা কী? কখন তিনি ভারতীয় দলের হয়ে খেলবেন, তা ঈশান কিষান নিজেই ঠিক করে নেবেন! কখন তাঁর গা ম্যাজম্যাজ ঠিক হবে আর অন্য কাউকে সেলাম ঠুকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। জাতীয় দলের টুপিকে এমন হাস্যকর পর্যায়ে আর কখনও নামানো হয়েছে? সবচেয়ে আশ্চর্যের যে, দ্রাবিড়ের মুখ থেকে এমন সব বাক্য বেরোচ্ছে। যে রাহুল দ্রাবিড় মানে ভারতীয় দলের নীল টুপি পরা গর্বিত, নির্ভীক যোদ্ধার চোয়াল শক্ত করা ছবি সকলের মনে গেঁথে রয়েছে। দ্রাবিড়ের আরও দাবি, জাতীয় নির্বাচকদের সঙ্গে নাকি দুই তরুণের মনোভাব নিয়ে কথা হয়নি। একদম বাজে কথা। প্রথমত, এত দিন ধরে ভারতীয় দলের হয়ে খেলেছেন দ্রাবিড়। অধিনায়ক থেকেছেন। ভারতীয় ক্রিকেটে দল গঠন সংক্রান্ত যে কোনও বড় সিদ্ধান্তের নেপথ্যে যে বোর্ডের সায় থাকে, তা বিলক্ষণ জানেন দ্রাবিড়। নির্বাচকদের সঙ্গে তাঁর আলোচনা না হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বোর্ড ও নির্বাচকমণ্ডলীর অবশ্যই কথোপকথন হয়েছে। না হলে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত হয় না।
আর দ্রাবিড় কাদের রক্ষা করার চেষ্টা করছেন? ঈশান কিষান দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে টেস্ট সিরিজ়ে ফিরে আসেন বোর্ডকে ভুল বুঝিয়ে। তিনি জানান, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবেন বলে ছুটি নিতে চান। মানসিক ভাবে নাকি ক্লান্তবোধ করছেন, ভারাক্রান্ত লাগছে। বোর্ড থেকে ছুটি মঞ্জুর করে দেওয়া হয়। দল পরিচালন সমিতি, যার অন্যতম প্রধান অঙ্গ কোচ রাহুল দ্রাবিড় তিনি যদি তখন ‘হ্যাঁ’ না বলতেন, বোর্ডের তরফে ছুটি মঞ্জুর করা সম্ভবই হত না। পরে দেখা যায় কী, না, ঈশান বাড়িতে মোটেও ফেরেননি। দুবাইয়ে ধোনির সঙ্গে অনুষ্ঠান করছেন। কেবিসি-তে বসে অমিতাভ বচ্চনের প্রশ্নের উত্তরে জানাচ্ছেন, শুভমন গিলের সঙ্গে তাঁর এত বন্ধুত্ব কী করে, কখন থেকে হল? বোর্ড এবং নির্বাচকেরা তখন ধরতে পারেন যে, টেস্ট সিরিজ়ে খেলানো হবে না বলে বাবু দ্বিতীয় উইকেটকিপার হিসেবে বিদেশে বসে থাকতে চাননি। তার চেয়ে টিভিতে বিনোদন শো-তে মুখ দেখানোকে বেশি জরুরি মনে করেছেন। এটা যদি শৃঙ্খলাভঙ্গ না হয়, তা হলে কোনটা শৃঙ্খলাভঙ্গ, মাননীয় কোচ দয়া করে ব্যাখ্যা দেবেন কি?
শ্রেয়স আয়ারকেও বোঝানো হয়েছে যে, তুমি বিরাট কিছু হরিদাস পাল হয়ে যাওনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট সিরিজ় শেষ হয়ে গিয়েছে। খেলতে তো হয়েছে মাত্র দেড় দিন। ফিরে এসে রঞ্জি ট্রফিতে মুম্বইয়ের হয়ে নামবেন না কেন? দ্রাবিড় সম্ভবত জানেন না, বোর্ডের অন্দরমহলে কী ধরনের আলোচনা হয়েছে ঈশান ও শ্রেয়সকে নিয়ে। পুরনো কেউ কেউ উদাহরণ টেনে বলেছেন, সুনীল গাওস্কর ওভালে দ্বিশতরান করার পরে দেশে ফিরে মুম্বইয়ের হয়ে রঞ্জি খেলতে নেমেছিলেন। বাকিরা তখন বলেন, অত পিছনে যাচ্ছ কেন? সচিন, সৌরভরা কত বার রাজ্য দলের হয়ে ব্যাট ধরেছেন বিদেশ সফর থেকে ফিরতে না ফিরতেই। নির্বাচকমণ্ডলী ও বোর্ডের কঠোর বার্তা যে সঠিক জায়গায় পৌঁছেছে, তা তো
বোঝাই যাচ্ছে।
শ্রেয়স তড়িঘড়ি ছুটেছেন মুম্বইয়ের হয়ে রঞ্জি খেলতে। কিন্তু দেরি করে ফেললেন কি না, সেটাই এখন দেখার। কোচ যতই প্রশ্রয় দিন না কেন, নির্বাচকেরা এককাট্টা যে, টেস্ট ক্রিকেট বা রঞ্জিকে সম্মান না করলে বাইরে বসে থাকো। তা সে তুমি যত বড় প্রতিভাই হও না কেন। শ্রেয়সকে তা-ও ক্ষমার চোখে দেখা হতে পারে যদি তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে মন লাগিয়ে খেলতে থাকেন। ঈশান কোণে ঘন কালো মেঘ জমে থাকল। এমনিতেই ঋষভ পন্থ ফিট হয়ে গেলে, তাঁর জন্য উপেক্ষার চাবুক অপেক্ষা করে থাকবে। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজ়ে সঞ্জু স্যামসন ভাল কিছু করে দিলে আগামী জুনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উড়ানেও তিনি ঘোর অনিশ্চিত হয়ে পড়বেন। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল— এই নীতি আপাতত কিছু দিন ভারতীয় ক্রিকেটে চলবে। যে কারণে রিঙ্কু সিংহের মতো জাতীয় দলের প্রতি দায়বদ্ধ, পরিশ্রমী, জাতীয় দলের টুপিকে শ্রদ্ধা করা তরুণ বেশি প্রাধান্য পাবেন। ভালই হবে। ক্রিকেট ও জীবনের পথে কৃচ্ছ্রসাধন করে চলার পুরস্কার পাবেন রিঙ্কুরা।
তিনি রাহুল দ্রাবিড়, ঢাল হয়ে দেশকে প্রচুর টেস্ট ম্যাচে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু মনে হয় না শৃঙ্খলাভঙ্গের আওতায় পড়া দুই তরুণকে বাঁচাতে পারবেন বলে। হ্যাঁ, শৃঙ্খলাভঙ্গই। দ্রাবিড়, আপনি যা-ই দাবি করুন না কেন!