স্ত্রী দীপিকা পাল্লিকালের সঙ্গে দীনেশ কার্তিক। ছবি: টুইটার
দীনেশ কার্তিককে নতুন ভাবে উপস্থাপিত করেছে আইপিএল। বুধবারই তিনি পূর্ণ করলেন ৩৬ বছর। এই বয়সে অনেক ক্রিকেটার অবসরের কথা ভাবতে শুরু করেন। কার্তিক ব্যতিক্রম। তিনি ভারতীয় দলে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্নপূরণ করেছেন।
প্রায় ৩৪ মাস পর ভারতীয় দলে ফিরেছেন কার্তিক। আইপিএলে ব্যাট হাতে দুরন্ত পারফরম্যান্সের পর জাতীয় দলে ফেরা প্রত্যাশিতই ছিল। এই প্রত্যাশার আড়ালে রয়েছে এক অন্য লড়াইয়ের গল্প। জীবন সংগ্রামের গল্প। যে গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ভারতের সেরা মহিলা স্কোয়াশ খেলোয়াড় দীপিকা পাল্লিকাল।
কার্তিকের প্রথম সন্তান বড় হচ্ছে তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুরলি বিজয়ের বাড়িতে। ভারতীয় দলের প্রাক্তন ওপেনারের স্ত্রী নিকিতাই কার্তিকের প্রথম স্ত্রী। কার্তিক এবং নিকিতার বাবা ছিলেন দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সূত্রে ছোট থেকেই বন্ধুত্ব দু’জনের। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম এবং বিয়ে। ২০০৭ সালে চার হাত এক হওয়ার পর ভালই চলছিল। সুখের সংসারে ঘুন ঘরতে শুরু করে ২০১১ থেকে। নিকিতা তখন বিজয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন। তামিলনাড়ুর হয়ে ছোট থেকে একসঙ্গে খেলার সুবাদে বিজয় এবং কার্তিক ছিলেন হরিহর আত্মা। কার্তিকের বাড়িতে প্রায়ই আসতেন বিজয়। নিখাদ আড্ডার আসরেই মন দেওয়া-নেওয়া সেরে ফেলেছিলেন নিকিতা এবং বিজয়। কার্তিকের থেকে মানসিক ভাবে দূরে সরে যেতে শুরু করেন নিকিতা। সম্পর্ক জোড়া লাগানোর অনেক চেষ্টা করেও একটা সময় হাল ছেড়ে দেন কার্তিক। শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে দু’জনের সম্মতিতে বিবাহ বিচ্ছেদ। কিন্তু সে সময় নিকিতা ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। বিয়ে করেন নিকিতাকে। কার্তিকের সন্তানের বাবা হয়ে যান বিজয়!
যমজ পুত্রদের নিয়ে কার্তিক ও দীপিকা।
প্রথম প্রথম মেনে নিতে পারতেন না কার্তিক। নিকিতা এবং বিজয় দু’জনেই যে ছিলেন তাঁর ছেলেবেলার প্রিয় বন্ধু। দুই বন্ধুর ভাল লাগা, ভালবাসাকে সম্মান দিতে নিজেকে সরিয়ে নেন। নতুন করে বাঁচতে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেন ক্রিকেটকে। হেলমেটের আড়ালে চোখের জল লুকিয়ে রাখতেন।রঞ্জি দলে তারপরেও খেলেছেন বিজয়ের সঙ্গে।বন্ধুতের সম্পর্ক ভেঙে না গেলেও চিড় ধরেছে ততদিনে।
ব্যক্তিগত জীবনের ধাক্কা প্রভাব ফেলেছিল কার্তিকের ২২ গজের পারফরম্যান্সেও। নিজেকে আরও বেশি করে ডুবিয়ে দেন অনুশীলনে। মাঠে, জিমে আরও বেশি সময় দিতে শুরু করেন। সেই জিমেই প্রথম দেখা দীপিকার সঙ্গে। একসঙ্গে ট্রেনিং করলেও আলাপ ছিল না। ক্রিকেটে আগ্রহ ছিল দীপিকার। তাঁর মা সুসান পাল্লিকাল ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের প্রাক্তন সদস্যা। যদিও দীপিকা শুরুতে তেমন পাত্তা দিতেন না কার্তিককে। কিন্তু কার্তিকের চোখে নতুন জীবনের স্বপ্ন।
দলগত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য দীপিকা তখন বাড়তি সময় দিতেন জিমে। তাঁকে বেশিক্ষণ দেখার জন্য বেশ সময় জিমে কাটাতেন কার্তিকও। রিফ্লেক্স বৃদ্ধির জন্য দীপিকা যে সব ট্রেনিং করতেন, সেগুলো করতেন কার্তিকও। কিছুটা অপ্রয়োজনেই করতেন। সেই অপ্রয়োজনীয় অনুশীলনই ফিরিয়ে এনেছিল উইকেটরক্ষকের হারানো ক্ষিপ্রতা।
তখনও ভালবাসা এক তরফা। দীপিকার সঙ্গে পরিচয়, কিছুটা বন্ধুত্ব হলেও কার্তিকের দস্তানায় ধরা দিচ্ছিল না ভালবাসা। তাই লম্বা ঝাঁপ। কার্তিক উঠে পড়লেন লন্ডনের বিমানে। উদ্দেশ্য এক, দীপিকার খেলা দেখা। উদ্দেশ্য দুই, কোনও কাউন্টি দলের সঙ্গে অনুশীলন। দ্বিতীয়টায় সফল না হলেও প্রথম ক্যাচটা আর হাতছাড়া হয়নি কার্তিকের। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের দর্শকাসনের প্রথম সারিতে কার্তিককে দেখে চমকে যান দীপিকাও। কিন্তু বুঝে যান শুধু স্কোয়াশ নিয়ে থাকলে আর হবে না। ক্রিকেটও জানতে হবে।
দীপিকা সে বার দুরন্ত ছন্দে ছিলেন। ক্রমতালিকায় এগিয়ে থাকা একের পর এক খেলোয়াড়কে হারিয়েছিলেন। কিন্তু দলগত প্রতিযোগিতায় পদকহীনই থাকতে হয় দশম বাছাই ভারতকে। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া দীপিকাকে উৎসাহ দেন কার্তিক। ২০১৩ সলে শুরু হয় নতুন পথ চলা। ব্যাট-র্যাকেটের প্রেম পরিণতি পায় ২০১৫’র অগাস্টে। প্রথমে খ্রিস্টান মতে, পরে হিন্দু আচার মেনে।
কার্তিক-দীপিকার ঘরে এসেছে যমজ সন্তান। ঘর সামলেই তাঁরা এগোচ্ছেন। পরস্পরকে উৎসাহ দিচ্ছেন। অনুশীলন করছেন। নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করছেন। এ বছরেই দীপিকা প্রথম বার স্কোয়াশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেছেন সোনা। ডাবলস এবং মিক্সড ডাবলসে। তাঁর জোড়া সোনা জয়ের পরেই আইপিএলে সোনার ছন্দে কার্তিক। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের সোনালী হেলমেটের আড়ালে এখন আর চোখের জল নেই। রয়েছে শক্ত চোয়াল। সেই চোয়ালে সওয়ার হয়েই আবার ভারতীয় দলে অভিজ্ঞ উইকেটরক্ষক-ব্যাটার। শুভ জন্মদিন ডিকে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।