ম্যাচ শেষে সব কৃতিত্ব দলকে দিয়ে চলে গেলেন এলগার। ছবি: এএফপি
তৃতীয় দিনের শেষে মহম্মদ শামির বলটা এগিয়ে এসে মাটিতে বসিয়ে দিয়েই সাজঘরের দিকে হনহন করে হাঁটতে শুরু দিলেন ডিন এলগার। শরীরী ভাষায় কাঠিন্য স্পষ্ট। তাঁর হেঁটে যাওয়া বলছে যে কাজ শেষ হয়নি তিনি জানেন। সেই জন্যই তাড়াতাড়ি যাচ্ছেন পরের দিনের জন্য তৈরি হতে।
জোহানেসবার্গের আকাশ বাধ না সাধলে হয়তো চতুর্থ দিন মধ্যাহ্নভোজের আগেই খেলা শেষ করে দিতেন এলগার। যখন দিনের খেলা শুরু হল, তখন দুটো সেশন বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বাকি সময়টায় ৩৪ ওভার খেলা হওয়ার কথা। মেপে ঝুপে এগিয়ে চললেন এলগার। আগের দিনের মতো তাঁর মাথা, কাঁধ, চোয়াল লক্ষ্য করে লাল গোলাটা আছড়াতে থাকলেন শামি, বুমরা, শার্দূল ও সিরাজ। কিন্তু তিনি লক্ষ্যে অবিচল। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই তাঁর দল জিতছে নাকি হারছে।
বোঝা গেল যখন অশ্বিনের বলটা ফ্লিক করে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে ডান হাতটা মুঠো করে ব্যাটের উপর মারলেন। গত চারদিনের সমস্ত আঘাতের উত্তর ছিল ওখানে। ওই ঘুষিতে। ভারতীয় পেস আক্রমণের মুখেই যেন মারলেন সেই ঘুষি। সিরিজে সমতা ফেরালেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক। ম্যাচের সেরাও হলেন তিনি।
মাথা, কাঁধ, চোয়ালে আছড়ে পড়ল লাল বলটা। ছবি: এএফপি
দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র চার রানের জন্য শতরান এল না এলগারের। তার জন্য আক্ষেপ করবেন তিনি। এরকম অনেক না পাওয়া পার করেই তো আজ তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা দলের টেস্ট অধিনায়ক। ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অভিষেক ম্যাচে দুই ইনিংসেই শূন্য করেছিলেন। সেই শূন্য দিয়ে শুরু। টি-টোয়েন্টি যুগে তিনি খেললেও সেই প্রলোভনে পা দেননি। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়েও আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটিও টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেননি তিনি। লাল বলের খেলাতেই যে তাঁর আনন্দ। বাঁহাতি খেলোয়াড়দের ব্যাটিং সৌন্দর্যও নেই তাঁর। আছে শুধু লড়াইয়ের মন্ত্র।
টেস্ট সিরিজে সমতা ফিরিয়েও সেই লড়াইয়ের মন্ত্রই শোনা গেল তাঁর মুখে। ম্যাচের সেরা এলগার বললেন, “প্রথম ম্যাচে আমাদের গোড়ায় গলদ ছিল। ক্রিকেটে ব্যাটিং, বোলিংটা সব ধরনের খেলাতেই এক রকম, আমরা সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। এখানে সহজ ছিল না লড়াইটা। গোটা ব্যাটিংয়ের উপর চাপ ছিল। ভারতীয় দলের বোলিং বিভাগ আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল। আমাদের বোলিং আক্রমণকে সম্মান জানাই। ওরা নিজেদের চরিত্রটা তুলে ধরল।”
দল, দল আর দল। ম্যাচে নিজে দুর্ধর্ষ ব্যাটিং করেও মুখে শুধু দলের কথা। প্রশ্নকর্তা বাধ্য হয়ে আলাদা করে তাঁর খেলা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। এলগার বললেন, “দেশের হয়ে খেলা সব সময়ই সম্মানের। এই ইনিংস আমাকে পরের ইনিংসটা খেলতে আত্মবিশ্বাস দেবে। কেউ বলবে এটা বোকামি, কেউ বলবে খুব সাহসী। কিন্তু আসল হচ্ছে আমাদের জয়। ধারাবাহিক ব্যাটিং অর্ডার খুঁজে পেতে সময় লাগছে আমাদের। কিন্তু ধৈর্য ধরতে হবে। যারা পারবে মনে হয়েছে, আমরা তাদেরই দলে নিয়েছি। তারা পেরেছে।” অর্থাৎ সেই দলের কথাই উঠে এল অধিনায়কের মুখে। মাঠে যে অধিনায়ক সমস্ত আঘাত প্রায় একা সামলে দলকে জেতালেন, তিনিই ম্যাচ শেষে সব কৃতিত্ব দলকে দিয়ে চলে গেলেন।
কিন্তু মাঠে কম কিছু সামলাতে হয়নি তাঁকে। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ককে আউট করতে না পেরে স্লেজিং শুরু করেন রাহুলরা। ঘটনাটি ঘটে ম্যাচের তৃতীয় দিনে। কিগান পিটারসেন আউট হন অশ্বিনের বলে। এলবিডব্লিউ হন তিনি। এলগার তাঁকে রিভিউ নিতে না করেন। সেই সুযোগটাই নেন ভারতীয় ক্রিকেটাররা। স্টাম্প মাইকে এক ভারতীয় ক্রিকেটারকে বলতে শোনা যায়, “দারুণ অধিনায়ক, দারুণ অধিনায়ক। শুধু নিজের কথাই ভাবে।”
শুধু নিজের কথা ভেবে এমন ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়লে দক্ষিণ আফ্রিকাও বলবে তাঁকে নিজের কথা ভাবতে। লড়াই যে এখনও শেষ হয়নি। পরের টেস্ট কেপ টাউনে। ভারতীয় দলে ফিরতে পারেন বিরাট কোহলী। সেই লড়াইয়ের জন্য এখন থেকে তৈরি হচ্ছেন এলগার। ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বললেন, “সিরিজ ১-১। ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার লড়াই। আমার মনে হয় না এর থেকে ভাল চিত্রনাট্য লেখা সম্ভব ছিল।”