একান্ত আলাপচারিতায় ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি: সচিনের একশো শতরানের রেকর্ড ধরা কঠিন
Brian Lara

শুভমন গিল ভেঙে দেবে আমার ৪০০, ৫০১ রানের বিশ্বরেকর্ড, কলকাতায় বললেন ব্রায়ান লারা

ব্রায়ান লারাকে হাতের সামনে পেলে রেকর্ড সংক্রান্ত আর একটি অবধারিত প্রশ্ন করতেই হয়। যা নিয়ে এই মুহূর্তে জনতার আগ্রহ তুঙ্গে। সচিন তেন্ডুলকরের একশো শতরানের রেকর্ড কি বিরাট কোহলি ভেঙে দেবেন?

Advertisement

সুমিত ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১১:০৫
Share:

নায়ক:ক্রিকেটকে বিদায় জানালেও ক্যারিবিয়ান রাজপুত্র এখনও ভক্তদের চোখের মণি।  ছবি: প্রদীপ সান্যাল।

সচিন তেন্ডুলকর ১০০। বিরাট কোহলি ৮০। পারবেন কি কোহলি আরও কুড়িটা শতরান করে তাঁর আদর্শকে ধরে ফেলতে?

Advertisement

ক্রিকেট বিশ্ব যখন এই তর্কে ব্যস্ত, তখন ব্যাটিংয়ের অন্য দুই কোহিনুর নিয়ে চর্চাই নেই। ধরেই নেওয়া হয়েছে, ওই রেকর্ড দুটি ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারও পক্ষেই তা আর স্পর্শ করা সম্ভব নয়।

৫০১ নট আউট।

Advertisement

৪০০ নট আউট।

একটার বয়স ২৯ বছর। অন্যটার ১৯ বছর। এক-এক সময় মনে হয়, আরব্য রজনীর গল্পের মতো কেউ যেন দুই রত্নসম্ভার লুকিয়ে রেখে সাঙ্কেতিক চিহ্ন লিখে দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ জানে না দরজা খুলতে হলে চিচিং ফাঁক বলতে হবে।

কী আশ্চর্য। জনতা এমন ভাবলেও অমর দুই রেকর্ডের মালিক নিজেই মনে করেন না, আজীবন এই রত্নসম্ভার লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। এই ক্রিকেট গ্রহেই এমন এক জন এসে গিয়েছেন, যাঁর কাছে সেই সাঙ্কেতিক চিহ্নের সন্ধান রয়েছে। চিচিং ফাঁক বলে একদিন নাকি তিনিই খুলে ফেলবেন আটকে থাকা ৫০১ ও ৪০০-র দরজা।

তিনি ব্রায়ান চার্লস লারা বলে দিচ্ছেন তাঁর নাম— শুভমন গিল। বলে দিচ্ছেন, ‘‘শুভমন গিল। ও পারবে আমার দু’টো রেকর্ডই ভেঙে দিতে।’’ ভোর রাতের বাইপাসের ধারের পাঁচতারা হোটেল। এবিপি সংস্থার দুটি অনুষ্ঠান নিয়ে সারাদিন চরম ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটিয়েছেন। তার পরেও চোখের দু’পাতা এক করেননি। কিছু ক্ষণের মধ্যেই আবার উড়ান ধরতে ছুটবেন। নিজের ঘরে বসে মোবাইলে ‘ফানিয়েস্ট ক্রিকেট ভিডিয়োজ়’ দেখতে ব্যস্ত ক্যারিবিয়ান যুবরাজ। মজাদার ভিডিয়োর স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে এমন মন্তব্য করে ফেললেন নাকি?

একেবারেই না। কারণ লারা এ বার সোফা থেকে উঠে পড়েছেন। বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাঁকে। ‘‘শুনুন, শুভমন গিল হচ্ছে নতুন প্রজন্মের সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান। নতুন প্রজন্মের ক্রিকেট শাসন করবে ও। আমি মনে করি, ক্রিকেটের অনেক বড় বড় রেকর্ড ভেঙে দেবে ও।’’ তা বলে ৫০১ ও ৪০০? এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল। ধারেকাছেও তো কেউ আসতে পারছে না। ‘‘শুভমন পারবে,’’ আবার বললেন বাঁ হাতি জাদুকর, ‘‘আমি তাই বিশ্বাস করি। ও ভেঙে দেবে আমার রেকর্ড।’’

বেশ, শুভমন গিল খুব প্রতিশ্রুতিমান মানা গেল। তা হলে বিশ্বকাপ জেতাতে পারলেন না কেন? আহামরি কী আর করলেন? একটা শতরানও তো নেই। এ বার লারার জবাব, ‘‘সেঞ্চুরি হয়তো করেনি। কিন্তু ছেলেটা কী সব ইনিংস খেলেছে ইতিমধ্যেই সেগুলো দেখুন। টেস্ট, ওয়ান ডে-তে ডাবল সেঞ্চুরি রয়েছে। আইপিএলে দুর্ধর্ষ সব ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলেছে। নানা ফর্ম্যাটে অনেক বিশ্বকাপও জেতাবে শুভমন।’’ না থেমে বলে চললেন, ‘‘ওর ব্যাটিং ভঙ্গি আর শটের বাহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। নিজের উপরে অগাধ বিশ্বাস। পেসারকে ক্রিজ় ছেড়ে হেঁটে বেরিয়ে এসে কেমন ভাবে পেটায় দেখেছেন? অবিশ্বাস্য!’’ খুব কম ব্যাটসম্যানই আছেন যাঁকে দেখে ৫০১ ও ৪০০ রানের মালিকের মুখ দিয়ে এমন বিস্ময়সূচক শব্দ বেরিয়ে আসতে পারে। শুভমন গিল ক্রিকেট আকাশের সেই ব্যতিক্রমী তারা।

কিন্তু আজকের শুভমন গিল-রা যে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেনই না। কাউন্টি খেলার সেই চলও নেই। তা হলে আপনার রেকর্ড ভাঙবেন কী করে? লারার জবাব, ‘‘আমি বলতে চাইছি, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট বা কাউন্টিতে খেললে শুভমন আমার ৫০১ নট আউট ভেঙে দেবে। টেস্টে আমার ৪০০ তো ভেঙে দিতেই পারে।’’ ফের পাল্টা সওয়াল করতে হল। টেস্ট ক্রিকেটে তেমন ভাবে ব্যক্তিগত বড় স্কোর আজকাল কোথায় হচ্ছে? তার পরেও এতটা নিশ্চিত হয়ে কী করে বলছেন? লারা নিজের বক্তব্যে অনড়। ‘‘ক্রিকেট অনেক পাল্টে গিয়েছে। বিশেষ করে ব্যাটিং। দুনিয়া জুড়ে টি-টোয়েন্টি লিগ, বিশেষ করে আইপিএলের জন্যই এই পরিবর্তন। অনেক দ্রুত রান করছে এখনকার ছেলেরা। তাই বড় রান হতেই থাকবে। শুভমন অনেক বড় স্কোর করবে, মিলিয়ে নেবেন আমার কথা।’’

ব্রায়ান লারাকে হাতের সামনে পেলে রেকর্ড সংক্রান্ত আর একটি অবধারিত প্রশ্ন করতেই হয়। যা নিয়ে এই মুহূর্তে জনতার আগ্রহ তুঙ্গে। সচিন তেন্ডুলকরের একশো শতরানের রেকর্ড কি বিরাট কোহলি ভেঙে দেবেন? একটু আগে নিজের রেকর্ড ভেঙে যাবে বলে যিনি এত সহজ ভাবে বলে দিলেন, এ বার তাঁকেই দোটানায় দেখাল। পাল্টা জেনে নিতে চান, ‘‘কোহলির বয়স কত এখন? পঁয়ত্রিশ তো?’’ বলা গেল, হ্যাঁ। এ বার চোখ বন্ধ করে যেন গণনায় বসলেন। বিড়বিড় করে বলে চললেন, ‘‘পঁয়ত্রিশ। এখন সেঞ্চুরি সংখ্যা আশি। মানে আরও কুড়িটা। বছরে পাঁচটা করে হলেও আরও চার বছর। বিরাট তখন উনচল্লিশ। হবে? কঠিন কাজ। খুব কঠিন কাজ।’’

কিন্তু কোহলি যে এত ফিট? কড়া অনুশাসনে বেঁধে রেখেছেন, আপনি নিজেই তো বারবার টাইগার পটৌডি স্মারক বক্তৃতায় বলে এলেন। এমনও বলে এলেন, ছেলে খেলাধুলোয় আসতে চাইলে বলবেন, কোহলির প্রস্তুতি আর অনুশাসনকে উদাহরণ করো। তা হলে? লারার পর্যবেক্ষণ, ‘‘পারে যে-হেতু লোকটার নাম বিরাট কোহলি। ওর শৃঙ্খলা আর অধ্যবসায়ের খুব বড় ফ্যান আমি। যে ভাবে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে ও তৈরি হয় ম্যাচের জন্য, সেটা স্রেফ সাধনার পর্যায়ে। ভক্ত না হয়ে উপায় কী!’’ যোগ করলেন, ‘‘কিন্তু বয়স। জানেন তো বয়স কারও জন্য থেমে থাকে না। কোহলি হয়তো অনেক রেকর্ডই ভেঙে দেবে। কিন্তু একশো সেঞ্চুরির মাইলস্টোন মনে হয় সবচেয়ে কঠিন শৃঙ্গ। সহজ হবে না সেই শৃঙ্গ জয় করে ফেলা।’’

এটা তো আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস হয়ে গেল। খটখটে রোদ উঠবে, আবার মেঘও করতে পারে। বৃষ্টি হতেও পারে, না-ও হতে পারে। সরাসরি বলুন, কোহলি পারবেন কি পারবেন না? লারা ফের চুপ। আবার চোখ বন্ধ। মনে হল, ধ্যানে বসেছেন। বললেন, ‘‘নিশ্চিত করে কিছুতে বলা সম্ভব নয়। যে বলবে, সে ক্রিকেটীয় যুক্তি বাছবিচার করে বলবে না। আমার মনে হয়, কুড়িটা সেঞ্চুরি এখনও অনেক দূরের গ্রহ। অনেকে গোটা ক্রিকেটজীবনে করতে পারে না। অ্যাডভেঞ্চার করার নেশায় দুম করে বলে দিচ্ছি না যে, কোহলি পারবেই।’’

অবশ্য দ্রুত মনে করিয়ে দিতে ভুলছেন না, ‘‘তবে কোহলির জন্য আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। যদি ও সচিনের মতো একশো সেঞ্চুরি করে ফেলতে পারে, দারুণ ব্যাপার হবে। আমি খুব খুশি হব। সচিন আমার খুব প্রিয় বন্ধু কিন্তু কোহলির ক্রিকেটেরও আমি বড় ভক্ত।’’ তিনি নিজে এত বড় এক জন কিংবদন্তি। এবিপি সংস্থার আমন্ত্রণে বিশেষ অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। সারাদিন ধরে তাঁকে ঘিরে মানুষের আবেগ, উন্মাদনা দেখে কে বলবে তিনি প্রাক্তন। মনে হবে এই সদ্য বিশ্বকাপ জিতিয়ে-টিতিয়ে ঝটিকা কলকাতা সফরে এসেছেন। দুটি পাঁচতারা হোটেলেই এমন উপচে পড়া ভিড় ঘিরে ধরেছিল যে, এগোতেই পারছিলেন না। নিজস্বী আর সইয়ের আব্দারের স্রোত যেন থামতেই চায় না। রাতে একটি নাইটক্লাবে গিয়েও একই অবস্থা। ভেবেছিলেন, নিভৃতে আলাদা একটা জায়গায় বসে থাকবেন। কিন্তু উপায় কী? ডিজের বারবার ঘোষণা এবং উপস্থিত জনতার তারস্বর অনুরোধে বেরিয়ে আসতেই হল। মঞ্চে উঠে ডিজে ব্র্যাভোর ‘চ্যাম্পিয়ন’ গানের সঙ্গে কোমর দোলালেন। যাঁকে নিয়ে এখনও এমন চৌম্বক আকর্ষণ, তিনি দুই ভারতীয় ব্যাটসম্যানকে নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ। কোহলি এবং গিল। ‘‘শুভমনের মতো এত প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান আমি খুব কমই দেখেছি,’’ বলে চলেন ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি, ‘‘আর কোহলি ক্রিকেটকে পাল্টে দিয়েছে। ক্রিকেট কী বলছি, জীবন দর্শনই পাল্টে দিয়ে গেল ছেলেটা। জেতার এমন আপসহীন মনোভাব আর সাফল্যের জন্য অক্লান্ত ভাবে নিজেকে তৈরি করার এই সাধনা উদাহরণ হতে পারে যে কোনও খাতের মানুষের জন্য।’’

এই যে মাঝেমধ্যেই তর্ক ওঠে, কোহলি মন্থর খেলছেন বা স্বার্থপরের মতো নিজের স্কোরের দিকটাই শুধু দেখছেন? লারাকে দেখে মনে হল যেন কোনও ইংরেজ বোলারকে সামনে দেখছেন। যাঁদের দেখলেই শুধু ব্যাট হাতে ওড়াতে চাইতেন। ‘‘শুনুন, এই কথাগুলো যারা বলে, ঈর্ষায় বলে। আমাকেও শুনতে হয়েছে। আসলে আমরা বড় রান করলেই কিছু লোকের গায়ে জ্বলুনি তৈরি হয়।’’ এই যে ক্রিকেট দুনিয়ায় প্রায়ই তর্ক উঠছে সর্বকালের সেরা নিয়ে, ‘গোট’ (গ্রেটেস্ট অব অল টাইম) নিয়ে, আপনার চোখে ‘গোট’ কে? একটুও না ভেবে লারার জবাব, ‘‘স্যর গ্যারি সোবার্স। ওঁর চেয়ে বড় কেউ নেই আমার কাছে।’’ সোবার্সের সর্বোচ্চ ৩৬৫ রানের রেকর্ড তাঁর সামনেই ভাঙেন লারা। বিশ্বকাপের মধ্যে সচিনের সামনে যেমন কোহলি পেরিয়ে গেলেন তাঁর সর্বাধিক ওয়ান ডে শতরানের মাইলফলককে। ‘‘আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিনগুলোর একটি,’’ বলে দিচ্ছেন লারা।

আপনার সমসাময়িকদের মধ্যে সেরা কে? এই প্রশ্ন শুনেও একটুও ভাবলেন না তিনি। ‘‘সচিন তেন্ডুলকর। সারা পৃথিবীতে রান করেছে। কোনও ভয়ঙ্কর বোলার, কোনও খারাপ পিচ, কোনও প্রতিকূল পরিবেশ, কোনও ঝড়-ঝঞ্ঝাই যেন ওকে থামাতে পারত না। সচিন ওর ক্রিকেটীয় যোগ্যতা, দক্ষতা দিয়ে সব কিছুকে বশ করে ফেলতে পারত।’’ এর পরে নিজেই পর পর তাঁর চোখে সেরা কারা বলে দিলেন, ‘‘যাদের সঙ্গে খেলেছি, তাদের মধ্যে সেরা ব্যাটসম্যান ভিভিয়ান রিচার্ডস। যাদের বিরুদ্ধে খেলেছি, তাদের মধ্যে সেরা সচিন। যাদের সঙ্গে খেলেছি, তাদের মধ্যে সেরা বোলার ম্যালকম মার্শাল। যাদের বিরুদ্ধে খেলেছি, তাদের মধ্যে সেরা বোলার ওয়াসিম আক্রম।’’ ভিভকে নিয়ে তাঁর কাছে যা গল্প রয়েছে, বই হয়ে যায়। ক্রিকেটজীবনের শুরুতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ড্রেসিংরুমে ঢুকে কিটব্যাগ রেখেছিলেন একটা জায়গায়। কিছুক্ষণ পরে নীচে দাঁড়িয়ে দেখেন, প্যাড, গ্লাভস সব উড়ে উড়ে আসছে। কী ব্যাপার? না, যেখানে কিটব্যাগ রেখেছিলেন, সেটা স্যর ভিভের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে সকলে ঘুমোচ্ছে দেখে তিনিও ড্রেসিংরুমে ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ উপলব্ধি করেন নাকের সামনে কিছু একটা নড়ছে। চোখ খুলে দেখেন, এত বড় একটা নাক। আবার ভিভ। ‘‘ইয়ং ম্যান, লেট নাইট?’’ বলে স্যর ভিভের আদেশ, ‘‘খেলা হচ্ছে না তো কী? যাও, বাইরে গিয়ে বৃষ্টি দেখো। ঘুমোনোর জন্য তোমাকে নিশ্চয়ই ক্রিকেট বোর্ড পয়সা দেয়নি।’’ তবু মানছেন, ভিভের সেই কড়া, সময়-সময় অত্যাচারী রাজার চাবুক তাঁকে শক্তপোক্ত করেছিল। অনমনীয় ব্রায়ান চার্লস লারার মনন তৈরি করে দিয়েছিল। অনেকে সেই চাবুক নিতে পারেননি, তিনি পেরেছিলেন। ভিভের চোখে চোখ রেখে তাঁর সব রাজকীয় ইনিংসের মুকুট ছিনিয়ে নিতে থাকেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement