স্টুয়ার্ট ব্রড। —ফাইল চিত্র
যখনই উইকেটের প্রয়োজন, বেন স্টোকস তাকান তাঁর দিকে। বল তুলে দেন। সেই বল হাতে নিয়ে বোলিং মার্কে গিয়ে সমর্থকদের তাতান তিনি। তার পরে বিষাক্ত সব আউট সুইং করেন। সেই বিষ থেকে বাঁচতে পারেননি টেস্ট ক্রমতালিকার সেরা দুই ব্যাটার মার্নাশ লাবুশেন ও স্টিভ স্মিথ। বার্মিংহ্যামে ৩৬ বছরের স্টুয়ার্ট ব্রডকেই সব থেকে বেশি ভয় করেছে অস্ট্রেলিয়া।
চতুর্থ দিন ব্যাটাররা ব্যর্থ হওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার সামনে খুব বেশি লক্ষ্য রাখতে পারেনি ইংল্যান্ড। তাই ম্যাচে টিকে থাকতে অন্তত কয়েকটি উইকেট দরকার ছিল স্টোকসদের। তিনি তাকালেন সেই ব্রডের দিকে। আর ব্রড কী করলেন? অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংয়ের দুই প্রধান স্তম্ভ লাবুশেন ও স্মিথকে দু’ওভারের একটি স্পেলে ফিরিয়ে দিলেন। প্রথম ইনিংসেও লাবুশেনকে আউট করেছিলেন ব্রড। বিপক্ষ দলের সেরা ব্যাটারকে পর পর দু’ইনিংসে আউট যিনি করেছেন তাঁকে তো প্রতিপক্ষ ভয় পাবেই।
চলতি বছর এপ্রিল মাসে ব্রড জানিয়েছিলেন, একটি গোপন অস্ত্র পেয়ে গিয়েছেন তিনি। সাধারণত, বল সিমে ফেলে পিচ থেকে আউটসুইং করান বোলাররা। কিন্তু ব্রডের সেই নতুন অস্ত্র খানিকটা আলাদা। বল পিচে পড়ে বাইরের দিকেই সুইং করবে। কিন্তু সিম সোজা থাকবে না। অর্থাৎ, ব্যাটার বুঝতে পারবেন না যে বল কোন দিকে যাবে। সেখানেই ব্রডের কৃতিত্ব। আর এই নতুন অস্ত্রে যে তিনি কতটা ভাল শান দিয়েছেন, তা এই টেস্টেই দেখা গিয়েছে। দুই ইনিংসে লাবুশেন ও দ্বিতীয় ইনিংসে যে ভাবে স্মিথকে তিনি আউট করেছেন, সেখানে বল সিমে পড়েনি। কিন্তু পিচে পড়ে ডান হাতি ব্যাটারের বাইরের দিকে গিয়েছে।
আসলে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে যখন খেলতে নামেন তখন সেটা ব্রডের কাছে শুধুমাত্র একটি খেলা থাকে না। হয়ে ওঠে লড়াই। আর সেই লড়াই জেতার জন্য সব রকম পথ অবলম্বন করতে রাজি ব্রড। ইংরেজ পেসার নিজেই জানিয়েছেন, প্রথম ইনিংসে দুই পুলিশকর্মীর সাহায্যে লাবুশেনকে আউট করেছেন তিনি। লাবুশেন যখন ব্যাট করতে নামেন তখন সাইট স্ক্রিনের পাশে দুই পুলিশকর্মী বসেছিলেন। তাতে সমস্যা হয় লাবুশেনের। তিনি আম্পায়ারকে বলে তাঁদের সেখান থেকে সরান। কিন্তু তার মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারের মনঃসংযোগে কিছুটা ব্যাঘাত হয়েছিল। সেটা কাজে লাগান ব্রড। বল করার আগে দর্শকদের তাতিয়ে তোলেন তিনি। যত বড় ব্যাটারই হোক, ইনিংসের প্রথম বল খেলার আগে কিছুটা হলেও চাপ থাকে। লাবুশেনের সেই চাপকে কাজে লাগান ব্রড। তাঁকে খেলতে বাধ্য করেন। খেলতে গিয়েই উইকেটরক্ষকের কাছে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন লাবুশেন।
বয়সে জেমস অ্যান্ডারসন বড় হলেও ব্রডই যেন এই বোলিং আক্রমণের নেতা। কারণ, ওলি রবিনসন থেকে শুরু করে মইন আলি, সবাইকে পরামর্শ দিতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। এমনকি প্রয়োজনে অ্যান্ডারসনও কথা বলছেন ব্রডের সঙ্গে। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের বোলারদের মধ্যে সব থেকে বেশি ওভার বল করেছেন ব্রড। দ্বিতীয় ইনিংসেও লম্বা স্পেল করছেন। ব্রড জানেন, সবাই মিলে আক্রমণ না করলে জিততে পারবেন না। পঞ্চম দিন খেলতে নামার আগে তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা জানি যে সব বোলারদের একসঙ্গে চেষ্টা করতে হবে। শুরুতেই অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারদের চাপে ফেলতে হবে। কারণ, এক বার ৩০-৪০ রান করে ফেললে তার পর ওদের আউট করা সহজ নয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব ওদের আউট করতে হবে।’’
আবার শুধু আক্রমণ করলেই যে হবে না সেটাও জানেন ব্রড। কারণ, অস্ট্রেলিয়ার সামনে লক্ষ্য খুব বেশি নয়। তাই রান আটকানোর কাজও করতে হবে ইংল্যান্ডকে। সেই ব্যাপারে অধিনায়ক স্টোকস ও কোচ ব্রেন্ডন ম্যাকালামের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেছেন। ব্রড বলেছেন, ‘‘কোচ ও অধিনায়কের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওদের সহজে রান করতে দেবো না। উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি রান আটকানোর দিকেও নজর থাকবে আমাদের। তাই যেমন উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করব, তেমনই চার আটকানোর চেষ্টা করব। সে ভাবেই পরিকল্পনা করেছি।’’ পঞ্চম দিন সকাল থেকে সেটাই দেখা যাচ্ছে। এমন ভাবে ফিল্ডিং সাজানো হয়েছে যাতে খুব বেশি রান তুলে নিতে না পারে অস্ট্রেলিয়া। চাপে পড়েই আউট হয়েছেন ট্রাভিস হেডের মতো আক্রমণাত্মক ব্যাটার।
শুধু বল হাতে নয়, ব্যাট হাতেও দলকে ভরসা দিয়েছেন ব্রড। হতে পারে দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১০ রান করেছেন তিনি, কিন্তু এই সময়ের মধ্যে অ্যান্ডারসন ও রবিনসনের সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন। দলের রানের সঙ্গে আরও ৪৪ রান যোগ করেছেন। এই টেস্টের নিরিখে সেই ৪৪ রানের গুরুত্ব কতটা তা ভাল ভাবে জানেন স্টোকস। সেই ৪৪ রান না হলে পঞ্চম দিনের খেলা শুরু হওয়ার আগেই অনেকটা এগিয়ে থাকত অস্ট্রেলিয়া। সেটা হয়নি।
টেস্ট ক্রিকেটে ৫৮৭ উইকেট হয়ে গিয়েছে ব্রডের। কিন্তু তার মধ্যে ৫৩৭ উইকেট স্টোকস-ম্যাকালাম পূর্ববর্তী সময়ের। নতুন জমানাতেও ৫০ উইকেট নিয়ে ফেলেছেন ব্রড। খিদে এখনও মেটেনি। প্রতিটি বল করার আগে একই রকম আগ্রাসন, একই রকম উদ্যম নিয়ে বল করতে যাচ্ছেন ব্রড। প্রতিটি বলে নিজের ১০০ শতাংশ দিচ্ছেন। আর সেই কারণেই এই ইংল্যান্ড দলের সব থেকে ধারাল অস্ত্র হয়ে উঠেছেন তিনি।