অপ্রতিরোধ্য: লখনউ জয় করে মুম্বইয়ে ফিরলেন রোহিত। ছবি টুইটার।
লখনউয়ে ভারত বনাম ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের ম্যাচ কি শেষ হয়েছে? নাকি এখনও চলছে? মাঠ থেকে তা গড়িয়েছে বিমানবন্দরে?
সোমবার দুপুরে লখনউ বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে সত্যিই গুলিয়ে যাচ্ছিল। জনতার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, ভারতরত্ন শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী একানা স্টেডিয়ামেই দাঁড়িয়ে আছি। চরণ সিংহ বিমানবন্দরে নয়।
রবিবার মাঠে রোহিত বা বুমরা-শামিদের জন্য যেমন জনতার গর্জন উঠছিল, এ দিন বিমানবন্দরেও তেমনই দেখা গেল। একই সময়ে দু’টো দল ঢুকল, কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরতীধর্মী অভ্যর্থনা অপেক্ষা করল তাদের জন্য। একটা দলের জন্য থাকল বিজয়ীর অদৃশ্য বরণডালা। অন্যটার জন্য পরাভূত, পরাক্রান্তের যন্ত্রণা ও উপেক্ষা।
ভারতীয় দলের এক-এক জন ক্রিকেটার যখন ঢুকছেন, বিমাবন্দরের মধ্যেও জয়ধ্বনি আর চিল চিৎকারে কান পাতা দায়। ‘ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া’ ধ্বনি সব চেয়ে জোরালো শোনাল। পাশেই বিশাল জাতীয় পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে এক প্রৌঢ়। কী নিবিড় ভাবে বুকের কাছে তেরঙ্গাটা আঁকড়ে ধরে আছেন! দেখে যে কারও গায়ে কাঁটা দেবে। মনে হচ্ছিল, রোহিতের দল অপ্রতিরোধ্য ক্রিকেট খেলে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী— জাতীয় আবেগের মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছেন। এক শহর থেকে অন্য শহর সেই মশাল ঘুরছে। সকলে সেই দৌড়ে অংশ নিতে চায়।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে যখন উঠছেন ভারতীয় ক্রিকেটারেরা, পুরো লাউঞ্জ উপচে পড়ছে ভিড়ে। এমনকি দোতলার করিডরও ভর্তি। হাততালি দিচ্ছেন সকলে। বিরাট কোহলি বা রোহিত শর্মাদের দেখলে জনতা বাঁধনহারা হবে, এ তো জানা কথাই। লখনউ বিমানবন্দরও ব্যতিক্রম নয়। তবে তৃতীয় এক জনের নামে বেশ জয়ধ্বনি উঠল সোমবার। বুম বুম বুমরা। ওঠাই উচিত। বোলাররা তারকা হয় না বলে একটা অপবাদ রয়েছে। কপিল দেবের পরে শেষ বোলার-তারকা সম্ভবত অনিল কুম্বলে, হরভজন সিংহ, জাহির খান। এই তালিকায় দ্রুতই জ্বলজ্বল করা উচিত যশপ্রীত বুমরার নাম। কুলদীপ যাদবকে নিয়েও উচ্ছ্বাস দেখা গেল। তাঁর নামও ভবিষ্যতে এই তালিকায় যোগ হলে মনে হয় না কেউ আপত্তি করবেন। যে স্বপ্নের বলে তিনি বাটলারকে আউট করেছেন, তা দেখে কেউ কেউ বলছেন, শেন ওয়ার্ন পুনর্জন্ম নিয়ে ফিরে এসেছিলেন রবিবার লখনউয়ের মাঠে। বাঁ হাতে লেগস্পিন করছিলেন।
আর অন্য দলটা? হায় রে ইংল্যান্ড! মাঠের যুদ্ধে হেরেও যেন নিস্তার নেই। মাঠের মধ্যে পঞ্চাশ হাজারের সারাক্ষণ ‘ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া’ চিৎকারের সামনে খেলতে হয়েছে। নাসের হুসেন যা দেখে বলছিলেন, ‘‘এর মধ্যে ব্যাট করতে নামলে যে কারও মনে হতে বাধ্য, গোটা পৃথিবী আমার বিরুদ্ধে।’’ এ দিন বিমানবন্দরেও মুখোমুখি হতে হল ‘ভারত আর্মি’-র। ইংল্যান্ডের নিজেদের দর্শকদের একটা বাহিনী আছে, যার নাম ‘বার্মি আর্মি’। তেমনই ভারতীয় ক্রিকেট দলের ভ্রাম্যমান সমর্থকের দল ‘ভারত আর্মি’। দেশ-বিদেশে কোহলিদের খেলার সময় মাঠে হাজির থাকে। নানা রকম গান তৈরি করে। নিজেদের দলের গুণগান করে আর প্রতিপক্ষকে ঠেস দিয়ে। বেয়ারস্টো, বাটলার, স্টোকসদের দেখে বিমাবনবন্দরেই এরা গান ধরল— ‘ইংল্যান্ড তুমি যেখানেই যাবে, ধ্বংস হবে।’ আশেপাশে তখন বিভিন্ন উড়ানযাত্রীদের ভিড়। তাঁরাও বাক্যবাণ নিক্ষেপ শুরু করলেন, ‘‘কোহিনুর যতই তোমরা রেখে দাও, ক্রিকেট কোহিনুর আমরা ছিনিয়ে নেব। বিশ্বকাপ আমরা নিয়ে যাব। ২০১৯ ছিল তোমাদের। ২০২৩ আমাদের।’’ এখানেই শেষ নয়। আরও অপ্রীতিকর মুহূর্ত তৈরি হল যখন পুরো ইংল্যান্ড দল মুখোমুখি হয়ে গেল অইন মর্গ্যানের। ২০১৯ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিশ্বজয়ী দলের অধিনায়ক মর্গ্যান বোমা ফাটিয়ে বলেছেন, বাটলারের দলের মধ্যে অশান্তির আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। তারই প্রতিফলন পড়ছে মাঠে। ইংল্যান্ডের কোচ ম্যাথু মট রবিবার ম্যাচের শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে পাল্টা বলেছেন, দলে কোনও অশান্তি নেই। মর্গ্যান অনেক দূরে বসে এ সব কথা বলছেন। এমনও বলেন তিনি যে, ‘বন্ধু’ মর্গ্যানের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবেন। এ দিন বিমানবন্দরে দেখা গেল মট কথা বলছেন মর্গ্যানের সঙ্গে। তবে বাটলারকে সে দিকে ঘেঁষতে দেখা গেল না। স্টোকস বা বেয়ারস্টোদেরও কি দেখলাম চার বছর আগের কাপজয়ী অধিনায়কের কাছাকাছি আসতে? মনে তো করতে পারছি না। শুধু দু’জনকে দেখলাম। মইন আলি ও আদিল রশিদ।
লখনউয়ে ইংল্যান্ডকে ১০০ রানে উড়িয়ে রোহিতদের বিশ্বকাপ মশাল অবশ্য হইহই করেই সোমবার পৌঁছল মুম্বইয়ে। চেন্নাইয়ের মেরিনা বিচে যাত্রা শুরু হয়েছিল। এ বার আরব সাগরের পারে মেরিন ড্রাইভে এল। যেটা আবার ২০১১-র বিশ্বকাপ জয়ের মহামঞ্চ। আরও আবেগের পরশ যোগ হতে বাধ্য। মাঝখানে দিল্লির যন্তরমন্তর থেকে আমদাবাদের সবরমতীর পাড়, গান্ধী আশ্রম, ধর্মশালার পাহাড়ি সৌন্দর্য থেকে লখনউয়ের ভুলভুলাইয়া ঘুরে এসেছে। পাহাড় থেকে সমতল, গরম থেকে হাল্কা শীত। ইডলি-দোসা থেকে তুন্ডে কাবাব। যেখানেই গিয়েছে জ্বলজ্বল করছে টিম ইন্ডিয়ার মশাল। এ বার এল পানিপুরির শহরে। রবি শাস্ত্রী রবিবার মাঠে ধারাভাষ্য দেওয়ার ফাঁকে খোঁজ করছিলেন, ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন কারা আছে? তিনি নিজেই দ্রুত উত্তর দিয়ে দিলেন— ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অস্ট্রেলিয়া। এর পরে যোগ করলেন, ‘‘তিন নম্বর নামটা এ বার যোগ না হলেই অবাক হব।’’
লখনউয়ের মাঠে রবিবার দু’টো এমন দৃশ্য দেখা গিয়েছে, যা সর্বকালীন ভারতীয় ক্রিকেটের জাদুঘরে স্থান করে নিতে পারে অনায়াসে। এক) রোহিতকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিয়ে কোহলির উৎসব। অধিনায়কত্ব যিনি ছাড়লেন আর যিনি তা পেলেন, এই দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বের ছবি ভারতীয় ক্রিকেটের আর্কাইভে খুঁজে পাওয়া কঠিন। ধোনি এবং কোহলি প্রথম এই তিক্ততার ইতিহাস পাল্টান। এ বার কোহলি-রোহিতও তাতে যোগ দিতে চলেছেন। অথচ, এই দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে একটা সময় কত সব কাহিনি লেখা হয়েছে! দুই) ম্যাচের পরে দু’দলের অধিনায়ক যখন হাত মেলাচ্ছেন। জস বাটলার ও রোহিত শর্মা। অনেকের মতে, এটাই বিশ্বকাপের সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছবি হতে চলেছে। বিশ্বকাপ শাসকদের হাত বদলের ছবি। বিশ্বকাপ ফয়সালার আসল পর্ব এখনও শুরুই হয়নি। নক-আউটে ভারতের এতকালের ফল শোচনীয়। যে কেউ নিজেদের দিনে যে কাউকে হারিয়ে দিতে পারে। কিন্তু কে শুনছে সে সব কথা। জনতা বলতে শুরু করেছে, ইংল্যান্ড সিংহাসন হারাচ্ছে, ভারত পাচ্ছে। রাজা মৃত, নতুন রাজা দীর্ঘজীবী হোন। সাম্রাজ্য হারাতে চলা শাসকেরা ছ’টায় পাঁচটা হেরেছে। সাম্রাজ্যের অধিকারী হতে চলা নতুন শাসকেরা ছয়ে ছয়। ২০১৯-এ যেমন ঘরের মাঠে অপ্রতিরোধ্য দেখাচ্ছিল ইংল্যান্ডকে, ২০২৩-এ তেমনই নিজেদের ঘরে ছুটছে রোহিতদের রথ। ইংল্যান্ডের যেমন দুর্ধর্ষ দুই ওপেনার ছিল জনি বেয়ারস্টো ও জেসন রয়, ভারতের তেমন রোহিত শর্মা, শুভমন গিল। মাঝে বিরাট কোহলি, কে এল রাহুল। চোট পেয়ে এই মুহূর্তে বাইরে থাকলেও বেন স্টোকসের মতোই ম্যাচ জেতানো অলরাউন্ডার রয়েছে ভারতের— হার্দিক পাণ্ড্য। লক্ষণগুলোতেও কত মিল।
ক্রিকেট মহান অনিশ্চয়তার খেলা মাথায় রেখেও এই নীল গর্জনের সঙ্গে গলা মেলানোর হাতছানি সংবরণ করা কঠিন। তার উপরে বারো বছর ধরে অধরা থাকা স্বপ্ন। এক-এক সময় সব যুক্তি-তর্ক দূরে ছেলে দিয়ে শুধু নীলের আবেগকে প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে, লখনউ বিমানবন্দরে ওঠা ধ্বনিটাকে স্লোগানে পরিণত করে দিলে কেমন হয়? কোহিনুর রেখে দাও, ক্রিকেট কোহিনুর দিয়ে যাও।