পুরনো ছন্দে ফিরছেন পুজারা ফাইল চিত্র
গত জানুয়ারিতে জোহানেসবার্গ টেস্টে ভারতের প্রথম ইনিংসের পরে সুনীল গাওস্কর বলেছিলেন, ‘‘নিজের টেস্টজীবন বাঁচানোর জন্য হয়তো আর একটাই ইনিংস পাবে চেতেশ্বর পুজারা।’’ খুব একটা ভুল বলেননি গাওস্কর। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৩ রানের ইনিংস বাঁচাতে পারেনি পুজারাকে। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের পরে দেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কা সিরিজের টেস্ট দল থেকে বাদ পড়েছিলেন পুজারা। প্রশ্ন উঠেছিল, তবে কি রাহুল দ্রাবিড়ের ‘উত্তরসূরি’র কেরিয়ার শেষ? কিচ্ছু বলেননি তিনি। মুখে জবাব দেননি। জবাব দিয়েছে তাঁর ব্যাট। যে দেশের আবহাওয়ায় বলের সুইং সামলাতে সমস্যায় পড়েন বিশ্বের সেরা ব্যাটাররা, সেই ইংল্যান্ডে এক মরসুমে পাঁচটি শতরান করেছেন তিনি। তার মধ্যে তিনটি দ্বিশতরান। সোজা ব্যাটে খেলছেন পুজারা। তবে কি ইংল্যান্ডে পুনর্জন্ম হল ভারতীয় মিডল অর্ডার ব্যাটারের!
২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিডনিতে ভারতের হয়ে শেষ শতরান করেছিলেন (১৯৩) পুজারা। তার পর থেকে ৫১টি ইনিংস খেললেও শতরান করতে পারেননি তিনি। এই ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরেই শুরু হয়েছিল সমালোচনা। দাঁত-নখ বার করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সমালোচকরা। তাতে নড়ানো যায়নি পুজারার ডিফেন্স। উইকেটে নতুন করে গার্ড নিয়ে তৈরি হয়েছিলেন বিপক্ষের বাউন্সার সামলানোর জন্য।
পুজারা ফিরে গিয়েছিলেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। রঞ্জি খেলেন। কিন্তু সৌরাষ্ট্রের হয়েও বিশেষ সাফল্য পাননি। তা সত্ত্বেও হাল ছাড়েননি। ঠিক করে নিয়েছিলেন, কাউন্টি খেলবেন। সাসেক্সে যোগ দিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে, পুজারা যখন কাউন্টি খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই ছিল আইপিএলের নিলাম। গত বার পুজারাকে কিনেছিল চেন্নাই সুপার কিংস। খেলার সুযোগ পাননি। পাওয়ার কথাও ছিল না। তাঁর ধ্রুপদী ক্রিকেট কুড়ি-বিশের বুম-বুম ক্রিকেটের আঙিনায় বেমানান। এ বারের আইপিএলে দলই পাননি। অন্য ক্রিকেটাররা যেখানে আইপিএলে দল না পেলে হতাশ হন, সেখানে উল্টো পথে হেঁটেছিলেন পুজারা। তিনি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘আমাকে আইপিএলে কোনও দল কিনলেও খেলার সম্ভাবনা কম থাকত। হয়তো একটা ম্যাচেও খেলার সুযোগ পেতাম না। তাতে আমার খেলার উন্নতি হত না। নিজের পুরনো ছন্দে খুঁজে পেতে তাই কাউন্টিকে বেছে নিয়েছি।’’
ঠিক পথই বেছেছিলেন। সাসেক্সের হয়ে পুজারার ব্যাটে ফিরেছে সোনালি ছোঁয়া। তাঁকে থামানো যাচ্ছে না। প্রথম ম্যাচেই ডার্বিশায়ারের বিরুদ্ধে ২০১ রান করেন তিনি। তার পরে উরসেস্টারশায়ারের বিরুদ্ধে ১০৯, মিডলসেক্সের বিরুদ্ধে ১৭০ ও ডারহামের বিরুদ্ধে ২০৩ রান করেন। মিডলসেক্সের বিরুদ্ধেই চলতি ম্যাচে ২৩১ রান করেছেন ভারতীয় ব্যাটার। সাসেক্সের হয়ে ন’টি ইনিংসে ১০৯.৪৩ গড়ে ৭৬৬ রান করেছেন তিনি। শুধু রান করা নয়, উইকেট আঁকড়ে পড়ে থাকার পরিচিত ছবিও দেখা যাচ্ছে। মিডলসেক্সের বিরুদ্ধে ২৩১ রান করতে পুজারা নিয়েছেন ৪৩০ বল।
কাউন্টিতে একের পর এক নজির গড়েছেন পুজারা। প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার হিসাবে লর্ডসে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শতরান করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে ভেঙেছেন মহম্মদ আজহারউদ্দিনের নজির। কাউন্টিতে দু’টি দ্বিশতরান ছিল আজহারের। এখনও পর্যন্ত সেটিই ছিল কাউন্টিতে ভারতীয় ব্যাটারদের মধ্যে সব থেকে বেশি দ্বিশতরানের নজির। আজহারকে টপকে পুজারা করলেন তিনটি দ্বিশতরান।
লক্ষ্য পূরণ হয়েছে পুজারার। ছন্দে ফিরেছেন তিনি। পুজারা নিজেও সে কথা জানেন। তাই তো কাউন্টিতে ধারাবাহিক সাফল্যের পরে তিনি বলেছেন, ‘‘ভারতীয় দলে ফেরার লক্ষ্যে কাউন্টিতে খেলিনি। ছন্দে ফেরাটাই লক্ষ্য ছিল। বড় ইনিংস খেলতে চেয়েছিলাম। বড় রান মানে ১০০ নয়। ১৫০-র বেশি রানের ইনিংস। কারণ যত বড় রান করব তত বেশি বল খেলতে হবে। তত বেশি ক্ষণ মনসংযোগ ধরে রাখতে হবে। সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।’’
কাউন্টিতে ভাল খেলার পুরস্কার পেয়েছেন পুজারা। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পঞ্চম টেস্টে তাঁকে দলে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ইনিংয়ে ৬৬ রান করেছেন তিনি। ভারতীয় দলের তিন নম্বরে ফের নিজের জায়গা পাকা করছেন পুজারা। বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এখনও তাঁর বিকল্প নেই।
পুজারার সঙ্গেই ভারতীয় দল থেকে বাদ পড়েছিলেন আরও দুই ক্রিকেটার। অজিঙ্ক রহাণে ও ঋদ্ধিমান সাহা। বাদ পড়ার পরে রঞ্জি খেলেছেন রহাণে। কিন্তু সে রকম সাফল্য পাননি। বাংলার ঋদ্ধি গুজরাত টাইটান্সের হয়ে খেলেছেন আইপিএলে। ট্রফি জিতেছেন। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে দেখা যায়নি তাঁকে। বাংলার কর্তাদের সঙ্গে বিবাদের জেরে বাংলা ছেড়েছেন ঋদ্ধি। যোগ দিয়েছেন ত্রিপুরাতে। কিন্তু ভারতীয় দলের দরজা এখনও তাঁদের জন্য বন্ধ। পুজারা কিন্তু বিতর্কে জড়াননি। অনুশীলন করেছেন। লড়াই করেছেন। খেলেছেন। ফিরে এসেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে কেউ পছন্দ না করতে পারেন, কিন্তু অবহেলা করতে পারবেন না।