বিরাট কোহলি। —ফাইল চিত্র।
তিন টেস্ট শেষে সিরিজ়ে সমানে সমানে দুই দল। ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া এ বার শেষ দুই টেস্ট জিতে সিরিজ় পকেটে পুরতে চাইবে। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট। মেলবোর্নে প্রথম দিনের সব টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে। ৯০ হাজার দর্শকের সামনে শুরু হবে টেস্ট, যা ঐতিহাসিক ঘটনা বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে সেই টেস্ট শুরুর আগে মাঠের বাইরে অস্ট্রেলিয়ার আক্রমণ সামলাতে হচ্ছে ভারতীয় দলকে। সমস্যা তৈরি করছে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম। অস্ট্রেলিয়ার দ্বাদশ ব্যক্তি হয়ে উঠেছে তারা।
অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যমের এমন আক্রমণ যদিও নতুন কিছু নয়। এর আগে যখনই ভারতীয় দল সে দেশে গিয়েছে, তখনই সামলাতে হয়েছে এমন আক্রমণ। তবে এ বারে তাঁর ঝাঁজ খানিক বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ড ভেবেছিল মেলবোর্নের ম্যাচের আগেই হয়তো তারা ৩-০ এগিয়ে যাবে সিরিজ়ে। যে কারণে পার্থ, অ্যাডিলেড (দিন-রাতের ম্যাচ) এবং ব্রিসবেনে প্রথম তিনটি ম্যাচ রাখা হয়েছিল। এই তিন মাঠে গতি এবং বাউন্স বেশি। ভারতীয় ব্যাটারদের সমস্যায় ফেলার জন্যই এমন পরিকল্পনা ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও তা সফল হয়নি। গতি এবং বাউন্সের পিচে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন যশপ্রীত বুমরা। তাঁর দাপটে ঢেকে গিয়েছে ব্যাটারদের ব্যর্থতা। আর সিরিজ় ১-১ রেখে মেলবোর্নে এসেছে ভারত। যে মাঠে গত দু’বারই জিতেছে তারা। সেই টেস্টের আগে তাই অস্ট্রেলিয়ার আক্রমণ বেড়েছে মাঠের বাইরে।
কোহলিকে আক্রমণ
মেলবোর্নের বিমানবন্দরে পা রাখতেই শুরু হয়ে যায় আক্রমণ। বিরাট কোহলি তাঁর পরিবার নিয়ে গিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু তিনি চাইছেন না তাঁর সন্তানদের ছবি সমাজের সামনে আসুক। যে কারণে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বার বার অনুরোধ করেন সন্তানদের ছবি না-তোলার জন্য। অস্ট্রেলিয়ার একটি সংবাদমাধ্যম সেটা শোনেনি। তারা বিরাট-পত্নী অনুষ্কা শর্মা এবং তাঁদের সন্তানদের ছবি তোলে। বিরাট সেই সাংবাদিককে ছবি এবং ভিডিয়ো মুছে ফেলতে অনুরোধ করেন। তবে নিজের ছবি তুলতে বাধা দেননি বিরাট। অস্ট্রেলিয়ার আইনে প্রকাশ্য জায়গায় তারকাদের ছবি তোলায় কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। বিরাট বাধা দেওয়ায় তা নিয়ে শোরগোল ফেলে দেয় অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম। বলা হয়, ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক খারাপ আচরণ করেছেন। পরে যদিও বোঝা যায় গোটা ঘটনাটাই একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য হয়েছে। বাবা হিসাবে বিরাট নিজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন শুধু, যেটাকে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম বড় করে তাঁর উপর চাপ তৈরি করার চেষ্টা করেছে।
বিতর্কে জাডেজা
মেলবোর্নে ভারতের প্রথম অনুশীলনের পর জাডেজা এ দিন সাংবাদিক বৈঠক করেন। সব প্রশ্নেরই উত্তর হিন্দিতে দেন। তিনি উঠে যাবেন, এমন সময় এক অসি সাংবাদিক অনুরোধ করেন একটি প্রশ্নের উত্তর ইংরেজিতে দিতে। ভারতের মিডিয়া ম্যানেজার জানান, হাতে সময় নেই। টিম বাস অপেক্ষা করছে জাডেজার জন্য। তিনি জানান, সাংবাদিক বৈঠকটি আয়োজনই করা হয়েছে মূলত ভারতীয় সাংবাদিকদের জন্য, যাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই হিন্দি জানেন। কিন্তু অসি সাংবাদিক মানতে রাজিই ছিলেন না। তিনি ভারতের মিডিয়া ম্যানেজারের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেন। এমনকি বিসিসিআই-কে অপেশাদার সংগঠন বলেও অভিহিত করেন। ওখানে উপস্থিত এক সাংবাদিক বলেন, “আমি ওখানে ছিলাম। ভারতের অনেক সাংবাদিকই প্রশ্ন করার সুযোগ পাননি সময় শেষ হয়ে গিয়েছে বলে। কিন্তু সাংবাদিক বৈঠক শেষ হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার বেশ কিছু সাংবাদিক ভারতের মিডিয়া ম্যানেজারের উপর রেগে যান। খারাপ আচরণ করেন। আমি নিয়মিত সাংবাদিক বৈঠকে যাই। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের সাংবাদিক বৈঠকের সময়েও অনেক ভারতীয় সাংবাদিক প্রশ্ন করার সুযোগ পান না। আমরা কখনও এমন আচরণ করিনি।”
রবীন্দ্র জাডেজা। —ফাইল চিত্র।
অভিযোগের তির আকাশের দিকে
মেলবোর্ন টেস্টের আগে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলতে এসেছিলেন আকাশ দীপও। তার পরেই অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম দাবি করে, ইচ্ছা করেই আকাশকে পাঠানো হয়েছে। কারণ, তিনি ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন না। তিনি অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব না-দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছেন বলেও অভিযোগ করা হয়। এই অভিযোগের পর পাল্টা মুখ খোলে ভারতের সংবাদমাধ্যম। তাদের দাবি, মোটেই অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে যাননি আকাশ। উল্টে তাঁরা যে সব প্রশ্ন করেছেন তাঁর জবাব আকাশ দিয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। ইচ্ছা করে ভারতীয় ক্রিকেটারদের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম এই কাজ করছে বলে অভিযোগ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের।
অভিজ্ঞদের অভিজ্ঞতা
ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক মাইকেল ভন বরাবরই ভারতীয় ক্রিকেট দলকে আক্রমণ করেন। অ্যাশেজ় যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া-বিরোধী সেই ভন যদিও এই ধরনের ঘটনার পর তাতে বাড়তি রং দিয়েছেন। তিনি বলেন, “ভারত এখন ক্রিকেট বিশ্বে বড় শক্তি। তাদের মনে হতেই পারে বিমানবন্দরে ক্রিকেটারদের পরিবারের ছবি তোলা খুব বড় ব্যাপার। যে বিতর্ক বাড়ে জাডেজা ইংরাজিতে কথা না বলায়। তবে এখন তো প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে হিন্দি থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করে নেওয়াই যায়। হয়তো সেই অনুবাদ নিখুঁত হবে না, তবে মজার হবে।” ভন প্রশংসা করেন ভারতের মিডিয়া ম্যানেজারেরও। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক বলেন, “ভারতীয় মিডিয়া ম্যানেজারকে আমার ভাল লেগেছে। সে শুধু হাত দেখিয়ে সাংবাদিকদের চলে যেতে বলেছিল।”
ভন ভারতীয় মিডিয়া ম্যানেজারের প্রশংসা করলেও অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ক্রিকেটার সাইমন কাটিচ বিষয়গুলি ভাল ভাবে নেননি। তিনি এক সংবাদমাধ্যমে বলেন, “সিরিজ়ে শত্রুতা বাড়িয়ে দিচ্ছে ঘটনাগুলো। এগুলো মানসিক লড়াই। কিন্তু খুব ভাল নয় বিষয়গুলো। সংবাদমাধ্যমের উচিত ক্রিকেট খেলাটার প্রচার করা। কিন্তু ভারতীয় সংবাদমাধ্যম কী করতে চাইছে বুঝছি না। ওরা কী ভাবছে জানি না। এটা সম্পূর্ণ ওদের সমস্যা।”
যুযুধান দুই পক্ষ
মেলবোর্নে নামার আগে ৩-০ এগিয়ে যেতে না পারার আক্ষেপ অস্ট্রেলিয়া দলে রয়েছে। কারণ শেষ দু’টি টেস্টের পিচ ভারতীয়দের কিছুটা সাহায্য করবে। তাই মেলবোর্নে নামার আগেই ভারতীয় ক্রিকেটারদের মনঃসংযোগ নষ্ট করে দিতে দ্বাদশ ব্যক্তি হিসাবে নেমে পড়েছে সংবাদমাধ্যম। ক্রিকেটারেরা অবশ্য জানেন, দিনের শেষে জবাবটা মাঠেই দিতে হবে। সে যতই বাইরে থেকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম দুই দলকে নিয়ে শিরোনাম তৈরি করুক, দিনের শেষে ব্যাট, বলের লড়াইটা জিততে হবে। আর সেটা লড়বেন ক্রিকেটারেরাই। তাই সাংবাদিকদের বাউন্সারের থেকেও বিরাটদের সতর্ক থাকতে হবে অস্ট্রেলিয়ার পেসারদের করা অফ স্টাম্পের বাইরের বলগুলিতে। কিছু প্রশ্নের মতো ওগুলিও ছাড়তে হবে তাঁদের।