নাসিম শাহ, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, মহম্মদ রিজওয়ান। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ছবির মতো পাহাড়ি গ্রাম। পাকিস্তানের উত্তর দিকে আফগানিস্তানের সীমান্তের কাছে খাইবার পাখতুনখাওয়া অঞ্চলের ‘মায়ার জান্ডুল’। পাহাড়ি গ্রামের কোলে একটি নদী বয়ে যাচ্ছে। যে নদী গ্রাম পেরিয়ে চলে যায় শহরে। ওই গ্রামের ছেলেদের মতো। যারা গ্রাম থেকে শহরে যায় রোজগারের আশায়। নাসিম শাহের চোখেও ছিল সেই স্বপ্ন। ১৯ বছরের নাসিম এখন ওই এলাকার মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন স্বপ্নের নায়ক। শ্রীলঙ্কার কাছে এশিয়া কাপের ফাইনালে হারতে হলেও নাসিমরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাঁরা অন্যতম ফেবারিট হয়েই নামবেন। পাকিস্তানের পেসারের তুলনা হচ্ছে খাইবার এলাকার তারকা ক্রিকেটার শাহিদ আফ্রিদির সঙ্গে। এশিয়া কাপে পাকিস্তানের সাজঘরে পাস্তো ভাষা খুব সহজেই বলা যেতে পারে। খাইবার অঞ্চলের ভাষা পাস্তো। এই অঞ্চলে মূলত পাঠানদের বাস। সেই অঞ্চল থেকেই উঠে এসেছেন নাসিম শাহ, মহম্মদ রিজওয়ান, ফখর জামান, ইফতিকার আহমেদ, হ্যারিস রৌফ এবং খুশদিল শাহ। শাহিন শাহ আফ্রিদি এবং মহম্মদ ওয়াসিম জুনিয়র দলে থাকলে পাকিস্তান দল প্রায় পাঠান একাদশ হয়ে যেত।
উত্তরের ছোট শহর থেকে এসে জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়া এখন আর শুধু শাহিদ আফ্রিদির গল্প নয়। সময় পাল্টেছে। একাধিক ক্রিকেটার উঠে আসছে উত্তরের গ্রাম থেকে। ভারতীয় দলে যেমন জায়গা করে নেন কাশ্মীরের উমরান মালিক। যার শুরু হয়েছিল মহেন্দ্র সিংহ ধোনির হাত ধরে। ঝাড়খণ্ডের ক্রিকেটটাই পাল্টে দিয়েছে তাঁর উত্থান। ছোট শহর রাঁচীতে ধোনি ছিলেন ফুটবলের গোলরক্ষক। সেখান থেকে হয়ে ওঠেন উইকেটরক্ষক। ভারতের অন্যতম সফল অধিনায়ক, বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক।
এখন পাকিস্তান ক্রিকেটের অন্যতম নায়ক নাসিম শাহ। ফাইল চিত্র
উত্তর ভারতের রাজ্য থেকে যেমন মাঝে মাঝেই খবর আসে জঙ্গি হানার, পাকিস্তানের খাইবার অঞ্চলও শান্ত নয়। সেখানেও সেনার বন্দুক গর্জে ওঠে। তা যদিও ক্রিকেটকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। শান্ত পরিবেশ হলেই যদি খেলোয়াড় তৈরি হয়ে যেত তা হলে সুইৎজারল্যান্ড প্রতি বছর প্রচুর অলিম্পিক্স পদক নিয়ে যেত। পাকিস্তানের ছোট অঞ্চল থেকে ক্রিকেটার উঠে আসার মূল কারণ ক্রিকেটকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এক সময় যে ক্রিকেট থাকত সেনার অধীনে, সেই খেলা এখন সকলের। এর পিছনে মূল কারণ অবশ্যই পাকিস্তান সুপার লিগ। ভারতে যেমন আইপিএল চিনিয়ে দেয় উমরান মালিক, অর্শদীপ সিংহ, বেঙ্কটেশ আয়ার, দীপক চাহারদের, পিএসএলও তেমন পাল্টে দিয়েছে পাকিস্তানের ক্রিকেটের চরিত্র। ক্রিকেটাররা এখন অনেক বেশি পেশাদার। ক্রিকেট নিয়ে যে ব্যবসা সম্ভব, সেটা বুঝতে পেরেছে পাকিস্তানও।
ভারতীয় ক্রিকেটে যেমন ধীরে ধীরে দিল্লি-মুম্বই শহরের ক্রিকেটারদের আধিপত্য কমছে, তেমনই পাকিস্তানও এখন আর ক্রিকেটার পাওয়ার জন্য লাহৌর আর করাচির দিকে তাকিয়ে থাকে না। এশিয়া কাপের দলে থাকা পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের মধ্যে বাবর আজম এবং উসমান কাদির বাদে বাকি সব ক্রিকেটারই উঠে এসেছেন কোনও না কোনও ছোট শহর থেকে।
পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম। ফাইল চিত্র
শাহনেওয়াজ দাহানি এসেছেন দাহানি গ্রাম থেকে। সিন্ধ অঞ্চলের এই গ্রাম ক্রিকেটার তৈরির জন্য পরিচিত নয়। স্থানীয় মান্ডিতে (বাজার) কাজ করতেন পাক পেসার। সেখান থেকে কাছের শহর লারকানাতে যেতেন অনুশীলন করার জন্য। সেখানেও মাত্র এক-দু’জন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার ছিলেন। আগেকার সময় হলে শাহনেওয়াজ হয়তো খেলার জন্য কোনও ব্যাঙ্কের চাকরি পেয়ে খুশি থাকতেন, নয়তো সুযোগ না পাওয়ার আক্ষেপ করে বাকি জীবন কাটাতেন। পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছে। পাকিস্তান সুপার লিগে খেলতে নেমে তিনি হয়ে গেলেন সেরা বোলার। মুলতান সুলতান্স দলে তিনি পেলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে। পেস বোলার তৈরি করার জন্য যিনি বিখ্যাত। তাঁর প্রশিক্ষণে গোটা পাকিস্তান দেখল শাহনেওয়াজের দাপট। জাতীয় দল থেকে তাঁকে দূরে রাখা কঠিন ছিল। এখন পাকিস্তানের হয়ে সব ধরনের ক্রিকেটে খেলেন শাহনেওয়াজ।
পাকিস্তান বিধ্বস্ত বন্যায়। এমন ভয়ানক বন্যা অনেক বছর কোনও দেশ দেখেনি। ইতিমধ্যেই প্রায় দেড় হাজার মানুষ মারা গিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ শিশু। প্রায় সাত লক্ষ মানুষ ঘর ছাড়া। শাহননেওয়াজ যে অঞ্চলে অনুশীলন করতেন সেই লারকানাও ক্ষতিগ্রস্ত। সিন্ধ অঞ্চলের বহু মানুষ ঘর ছাড়া। বন্যায় ভেসে গিয়েছে চাষের জমি, খামার। সিন্ধু নদ ভেসে গিয়েছে। কোথাও তৈরি হয়ে গিয়েছে বিশাল জলাশয়। নাসিমের খাইবার পাখতুনখাওয়ায় এখনও পর্যন্ত মারা গিয়েছেন ২৩৯ জন। দির অঞ্চলের পাঁচ শিশু স্কুল থেকে ফেরার সময় ভেসে যায়। পাহাড়ি অঞ্চলে বন্যার কারণে ধস নেমে গিয়েছে। বহু বাড়ি ভেঙে গিয়েছে। নাসিমদের কাছে সে খবর অবশ্যই পৌঁছেছে। সেই অবস্থাতেও এশিয়া কাপে ঝড় তুললেন তাঁরা। গতির দাপটে ব্যাটারদের স্টাম্প ওড়ালেন বার বার।
শুধু নাসিম বা শাহনেওয়াজ নন, পাকিস্তানের বহু ক্রিকেটারই উঠে এসেছেন ছোট শহর বা গ্রাম থেকে। পেসার হ্যারিস রউফ যেমন এক বন্ধুকে সঙ্গ দিতে গিয়েছিলেন লাহৌর কালান্দারসের ট্রায়ালে। আকিব জাভেদ খোঁজ করছিলেন পেসারের। হ্যারিস নাম দেন। তাতেই পাল্টে যায় পাক পেসারের জীবন।
পাকিস্তানের সহ-অধিনায়ক শাদাব খান। পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের মিয়াঁওয়ালা শহর থেকে উঠে এসেছেন তিনি। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলার পর ভেবেছিলেন তাঁর সব পাওয়া হয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে তাঁর জীবনে আসে ইসলামাবাদ ইউনাইটেড। তিন বছরের মধ্যে পিএসএলের সব চেয়ে তরুণ অধিনায়ক হন শাদাব। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন স্পিনার জোহান বোথার প্রশিক্ষণে তৈরি হন তিনি। শাদাবকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন ডিন জোন্সও। শাদাবকে নেতা হিসাবে তৈরি করার পিছনে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। ক্রিকেটার শাদাব ইসলামাবাদ ইউনাইটেডে হয়ে ওঠেন অধিনায়ক শাদাব।
শাদাবের জন্য ইসলামাবাদ ইউনাইটেড যেমন, শাহিনের জন্য তেমনই লাহৌর কালান্দারস। তারাও শাহিনের মধ্যে একজন অধিনায়ককে দেখতে পেয়েছিল। লাহৌরকে ট্রফিও জিতিয়েছেন শাহিন। খাইবার অঞ্চলের মানুষদের কাছে যা স্বপ্নের মতো।
কিছু দিন আগে ইংল্যান্ড সফরের সময় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড নেটমাধ্যমে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করে। সেখানে দেখা যায় পাকিস্তান দলের পাঠানরা মিলে একসঙ্গে আনন্দ করে কাহওয়া (চায়ের মতো এক ধরনের পানীয়) খাচ্ছেন। রিজওয়ান কাহওয়া তৈরি করে এনে দিচ্ছেন শাহিন, নাসিম, ইফতিকারদের। সকলে আড্ডা দিচ্ছেন। একে অপরের সঙ্গে ইয়ার্কি করছেন। খাইবার অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এই ক্রিকেটারদের কেরিয়ার যদি এমন না হত, তা হলে হয়তো এখন তাঁরা পাহাড়ের কোনও ঘরে বসে কাহওয়া খেতেন আর নিজেদের ভাগ্যকে দুষতেন।