Sri Lanka cricket

দেশের প্রবল আর্থিক সঙ্কটেও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট! কী ভাবে? রয়েছে ভারতের ‘অবদান’-ও

গত ১৮ মাসে দলের কারও কোনও সমস্যা হলে সকলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। একটা পরিবার হয়ে উঠেছেন শনাকারা। পরিবারে রাগ, অভিমান, খুনসুটি আছে। সব থেকে বেশি আছে একতা, সংহতি। তাতেই ধরা দিচ্ছে সাফল্য।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২৩:৪২
Share:

এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর উচ্ছ্বাস শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের। ছবি: পিটিআই

রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটে দমবন্ধ পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার। আকাশ ছোঁয়া দ্রব্যমূল্যে নাভিশ্বাস উঠেছে আম জনতার। কমছে রাজকোষ। সমস্যা সমাধানের রাস্তা খুঁজছে সরকার। সাধারণ মানুষ খুঁজছে একটু স্বস্তি। অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা, অন্ধকার ভবিষ্যতের মাঝেও সুখ খুঁজে পাচ্ছেন সে দেশের মানুষ! যে সুখের নাম ক্রিকেট।

Advertisement

এই সুখের নেপথ্যে রয়েছে ভারতের অবদান! গত কয়েক বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তেমন সাফল্য নেই শ্রীলঙ্কার। এই সঙ্কটের মধ্যে কী ভাবে বদলে গেল দ্বীপরাষ্ট্রের ক্রিকেট? দাসুন শনাকারা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন দেশের পতাকা তুলে ধরার। গত বছর অর্থ সঙ্কটে থাকা শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট বোর্ডকে সাহায্য করতে সে দেশে সাদা বলের সিরিজ খেলেছিল ভারত। দ্বিতীয় সারির দল পাঠিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট কর্তাদের অভিযোগ, অনেকটা সমাজসেবামূলক মানসিকতা প্রকাশ করেছিল বিসিসিআই। যা তাঁদের আঁতে ঘা দেয়। মুখে কিছু না বললেও, তখনই দেশের ক্রিকেটে আবার ৯০ দশকের গৌরব ফিরিয়ে আনার সংকল্প নেন তাঁরা, যে গৌরবের অংশ ৯৬ সালে বিশ্বকাপ জয়। ভারতকে জবাব দেওয়ার লড়াইটা দাঁতে দাঁত চেপে শুরু হয় তখন থেকেই। রাজাপক্ষে সরাসরি বলেছেন, ‘‘দু’দশক আগে আমাদের ক্রিকেটের একটা পরিচিতি ছিল। আমরা আবার সেটাই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। কোচ ক্রিস সিলভারউড আমাদের সাহায্য করছেন। গত ১২-১৫ মাসে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে আমরা অনেক তরুণ ক্রিকেটারকে সুযোগ দিয়েছি। সে জন্যই এই সাফল্য আসছে। আমরা এখন অনেক আত্মবিশ্বাসী।’’

তরুণ ক্রিকেটার তুলে এনে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নামিয়ে দেওয়াই শুধু নয়। সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে আরও একটি কারণ। দেশে অর্থনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা শুরু হওয়া থেকেই বেঁধে বেঁধে রয়েছেন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা। গত ১৮ মাস প্রতি দিন সবাই সবার খবর নিয়েছেন। কেমন আছেন বা কোনও সমস্যা হচ্ছে কী না। যে কোনও সমস্যায় সকলে এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সাহায্য করতে। সঙ্কটের আঁচ যাতে দলের কোনও সদস্যকে স্পর্শ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। দল থেকে পরিবার হয়ে উঠেছেন শনাকারা। সেই পরিবারে রাগ, অভিমান, খুনসুটি সব আছে। সব থেকে বেশি আছে একতা, সংহতি। সংহতির শক্তিতেই ধরা দিচ্ছে সাফল্য।

Advertisement

তাই ভারতকে হারিয়ে উঠে ভানুকা রাজাপক্ষে সগর্বে বলতে পারেন, ‘‘আমরা এখন আর দল হিসাবে পিছিয়ে নেই। আমিরশাহিতে যখন এসেছিলাম, তখন সকলেই আমাদের দুর্বল মনে করছিল। ভারত এবং পাকিস্তান নিজেদের দিনে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা আমাদের অজানা ছিল না। কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম ক্রিকেট বিশ্বকে নিজেদের শক্তির পরিচয় দিতে। এই শক্তি দেশবাসীকেও মানসিক বল দিতে পারে।’’

সব নেইয়ের মাঝেও ক্রিকেট রয়েছে। ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তানের সঙ্গে সিরিজে ভাল পারফরম্যান্সের পর এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হল শ্রীলঙ্কা। একের পর এক সাফল্য পাচ্ছে বহু সমস্যায় জর্জরিত দেশের ক্রিকেট দল। সাফল্যের মধ্যেও কাঁটা বিঁধছে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের। সুযোগ পেলেই সাংবাদিকরা জানতে চাইছেন দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে।

শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের মধ্যে সাবলীল ইংরাজি বলতে পারেন মাত্র কয়েক জন। তাঁদেরই অন্যতম রাজাপক্ষে। তিনি আবার সম্পর্কে শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষের আত্মীয়। বাংলাদেশ ম্যাচের পর দল থেকে সাংবাদিক সম্মেলনে পাঠানো হয় রাজাপক্ষেকে। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের মোচড় বুঝতে পারেননি শ্রীলঙ্কার ব্যাটার। তাঁর উত্তর ঘিরে তৈরি হয় বিতর্ক। পরে পরিস্থিতি সামাল দেন অধিনায়ক শনাকা। তার পর থেকে প্রতি ম্যাচের পর সাজঘরে ক্রিকেটাররা নিজেরা আলোচনা করে নিচ্ছেন। যিনি সাংবাদিক বৈঠকে যাবেন তাঁকে ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কোন প্রশ্ন নেবেন, কোন প্রশ্ন এড়িয়ে যাবেন। শনাকারা চাইছেন না এশিয়া কাপের মধ্যে কোনও বিতর্কে জড়াতে। পাকিস্তান ম্যাচের পর ওয়ানিন্দু হাসরঙ্গকে সাংবাদিক বৈঠকে পাঠানো হয়। যদিও তাঁর পাশে বসেছিলেন শনাকা। যাতে কোনও বিতর্কিত প্রশ্ন এলে তা সামলানো নয়।

এশিয়া কাপ খেলতে এসে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের ক্রিকেটের পাশাপাশি কূটনীতিতেও মন দিতে হয়েছে। কারণ, তাঁদের দেশের অস্থির পরিস্থিতির জন্যই প্রতিযোগিতা হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে। ভারতের বিরুদ্ধে জয়ের পরেও সাংবাদিক বৈঠকে আসেন রাজাপক্ষে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘এত সঙ্কটের মধ্যেও আমরা শুধু ভাল ক্রিকেট খেলেই দেশবাসীর মুখে হাসি ফোটাতে পারি।’’ অধিনায়ক শনাকা জানিয়েছেন, ফাইনাল খেলা নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই তাঁদের ফোন অভিনন্দন বার্তায় ভরে যাচ্ছে। দেশের বহু মানুষ অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠাচ্ছেন তাঁদের। শনাকা বলেছেন, ‘‘এই প্রতিযোগিতায় আমাদের পারফরম্যান্স ভাল। সমর্থকদের ভালবাসার প্রতিদান দিতে চাই আমরা। কিছু ফিরিয়ে দিতে চাই ওঁদের।’’

ক্রিকেটই এখন শ্রীলঙ্কাবাসীর কাছে আনন্দ, গর্বের এক মাত্র মাধ্যম। কিছু দিন আগেই শ্রীলঙ্কা সরকার কমনওয়েলথ গেমসে দল না পাঠানোর কথা জানিয়েছিল। সে সময়ও এগিয়ে এসেছিল শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড। বার্মিংহামে দল পাঠানোর খরচ সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট কর্তারা। পদক জিততে পারেন, এমন ক্রীড়াবিদদের প্রস্তুতির জন্য আলাদা ভাবে অর্থ সাহায্য করেছিলেন তাঁরা।

শনাকাদের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত প্রাক্তন অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারাও। ফাইনালের আগে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের আবেগঘন বার্তা পাঠান তিনি। প্রাক্তন ক্রিকেটার নেটমাধ্যমে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেন। তাতে বলেন, ‘শনাকা, তোমাকে এবং তোমার দলকে এশিয়া কাপ ফাইনালের জন্য শুধু শুভেচ্ছা জানাতে চাই। প্রতিযোগিতার সব খেলাই দেখছি। বলে বোঝাতে পারব না, তোমাদের খেলা আমাদের কতটা অনুপ্রাণিত করছে। শুধু এই প্রতিযোগিতা নয়, গত কয়েক মাসের কথাই বলতে চাইছি। তোমরা সত্যিই দুর্দান্ত খেলছ। তুমি নিজে দারুণ নেতৃত্ব দিচ্ছ। প্রয়োজনের সময় পারফরম্যান্স করে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছ। আমাদের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠার সুযোগ করে দিচ্ছ। দিন দিন তোমার এবং তোমার দলের প্রতি আমাদের ভালবাসা বাড়ছে। এই সব কিছুর জন্য তোমাদের ধন্যবাদ। আর একটা ম্যাচ। নিজেদের সেরাটা দিও। তোমাদের প্রতিভা, দক্ষতা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। একটা দল হিসাবে খেলছ। আশা করব এ ভাবেই দেশে ট্রফি নিয়ে আসবে তোমরা।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement