ভারত টেস্ট সিরিজ জিততেই পারে, মনে করছেন চাঁদু বোরদে। ফাইল ছবি।
১১ বছর আগের সিরিজের কথা মনে আছে?
চাঁদু বোরদে: ওফ! সে ভোলা যায় নাকি! রাহুল দ্রাবিড় ছিল অধিনায়ক। আমি ছিলাম ম্যানেজার। ২১ বছর পর আমরা ইংল্যান্ডে সে বার জিতেছিলাম টেস্ট সিরিজ। শুরুতে কিন্তু কেউ আমাদের গুরুত্ব দেয়নি। সবাই বিশ্বকাপ জেতার কথা বলে। ২০০৭ সালে আমরা যে এত বছর পর সিরিজ জিতেছিলাম, তা আলোচিত হয় না সে ভাবে। কিন্তু অসাধারণ কৃতিত্ব ছিল টেস্ট সিরিজ জেতা।
সেই সময়ের কন্ডিশন কি এ বারের থেকে আলাদা ছিল?
চাঁদু বোরদে: হ্যাঁ, এ বার তো বেশ গরম। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ভাল লাগে ক্রিকেট খেলাটার প্রতি একাত্মতা। ক্রিকেটপ্রেমীরা পছন্দ করেন স্টেডিয়ামে আসতে। রোদ উঠলে মাঠ ভরে যায়। এখনও পর্যন্ত আবহাওয়া দারুণ রয়েছে। আমি নিশ্চিত, এ বারও টেস্টের সব মাঠই ভর্তি থাকবে। সে বার টেস্ট সিরিজ দারুণ উত্তেজক ছিল।
সে বারই তো ‘জেলি বিনস’ কাণ্ড ঘটেছিল। ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে জাহির খান ব্যাট করতে গিয়ে দেখেছিলেন ‘জেলি বিনস’ (বিনের দানার মতো দেখতে ছোট ছোট লজেন্স) পড়ে রয়েছে ক্রিজে। ফেলে দেওয়ার পরও, ফের তা ছোড়া হয়েছিল।
চাঁদু বোরদে: হ্যাঁ, ওই টেস্টে এই ঘটনায় আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা ভাবতেই পারিনি। যা নিয়ে সেই মুহূর্তে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। আম্পায়াররা হস্তক্ষেপ করার পর ব্যাপারটা বন্ধ হয়েছিল। তবে অন্য কোনও টেস্টে এটা ঘটেনি। আসলে ক্রিকেটে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ভাবে স্লেজিং করে। চেষ্টা করে বিপক্ষকে ডিসটার্ব করতে। এটাও ছিল এক ধরনের স্লেজিং। ব্যাটসম্যানের ভাবনা, তাঁর মনসংযোগকে নষ্ট করাই উদ্দেশ্য।
এ বারের সফরেও কি বিরাট কোহালিদের ফোকাস নষ্ট করার এই জাতীয় উদ্যোগ দেখা যেতে পারে?
চাঁদু বোরদে: হতেই পারে। না হওয়ার তো কিছু নেই। ক্রিকেটে এখন এটা অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছে। কে এটা কী ভাবে সামলাচ্ছে, সেটাই আসল। বিশ্বের সর্বত্র এখন এটা হচ্ছে। ব্যাটসম্যান বা বোলারের মানসিক স্থিতি নষ্ট করা,আচমকা উত্তেজনা তৈরি করা, এখন ট্যাকটিক্স হয়ে উঠেছে।
ররি শাস্ত্রী ও বিরাট কোহালি জুটি কি সফল হবেন ২০০৭ সালের চাঁদু বোরদে-রাহুল দ্রাবিড় জুটির মতো? ছবি: রয়টার্স।
আপনাদের সময়েও কি এমন ঘটনা ঘটত?
চাঁদু বোরদে: স্লেজিং কিন্তু সব সময়েই ছিল। এটা উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। হয়তো এখনকার মতো খারাপ শব্দ ব্যবহার করা হত না। কিন্তু কৌশলটা ছিলই। বিভিন্ন ম্যানারিজমের মাধ্যমে এটা করা হত। এটা করা হত বিপক্ষের মনোযোগ কাড়তে, ডিসটার্ব করতে। এগুলো হতই। এখনও হচ্ছে। হতেই থাকবে। তাই ভারতীয়দের সতর্ক থাকতে হবে। প্ররোচনায় পা দিলে চলবে না।
কোহালি বনাম অ্যান্ডারসন। এ ভাবেই দেখা হচ্ছে এই সিরিজকে। চার বছর আগে যখন শেষ বার ইংল্যান্ডে গিয়েছিল ভারত, সেই সিরিজে ১০টি টেস্ট ইনিংসে কোহালির গড় ছিল ১৩.৪০। এ বার কোহালি কি রান করতে পারবেন?
চাঁদু বোরদে: দেখুন, কোহালি এখন অনেক পরিণত। অনেক উন্নতি করেছে। অভিজ্ঞতা বেড়েছে। জানে, বিপক্ষ কী করতে পারে। আমি নিশ্চিত, ও রান করবে। দুর্দান্ত ট্যালেন্ট ওর। আমার তো দারুণ লাগে ওর ব্যাটিং। কোনও সন্দেহ নেই, ও অসাধারণ ব্যাটসম্যান। টাইমিং দুরন্ত। মারাত্মক আত্মবিশ্বাসী। ও ব্যাট করতে যাওয়ার সময় শরীরী ভাষাতেই ঠিকরে পড়ে আত্মবিশ্বাস। প্রথম বল খেলার সময় থেকেই মনে হয় ও কনফিডেন্ট। যা তারিফযোগ্য। নিজের ওপর বিশ্বাস ও মেলে ধরে অনায়াসে। শুধু ট্যালেন্টেড আর গিফটেড ব্যাটসম্যানই নয়। ও প্রচণ্ড পরিশ্রমী।
ভারতের ওপেনিং কম্বিনেশন নিয়ে একটা বিতর্ক রয়েছে। শিখর ধবন না লোকেশ রাহুল কাকে খেলাতে চাইবেন?
চাঁদু বোরদে: দেখুন, এক-আধটা ম্যাচে কেউ খারাপ খেলা মানেই সে বাজে ক্রিকেটার হয়ে যায় না। আমি বলব, প্রাথমিক ভাবে যে পরিকল্পনা ছিল, সেটাতেই ঠিক থাকা দরকার। প্রস্তুতি ম্যাচে ধবন রান পায়নি মানেই বাদ দেওয়ার পক্ষপাতী আমি নই।
আরও পড়ুন: ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হাজার রানের মাইল স্টোনের সামনে বিরাট
আরও পড়ুন: ছেলেরা তৈরি, নামবে জেতার জেদ নিয়েই
ইংল্যান্ডে সাতটা টেস্ট খেলেছেন আপনি। এ ছাড়াও অনেক ম্যাচে ড্রেসিং রুমে থেকেছেন। কী মনে হয়, ইংল্যান্ডে কুলদীপ যাদবের মতো চায়নাম্যান সফল হতে পারবেন?
চাঁদু বোরদে: কেন নয়? ওকে পড়তে না পারলে কিন্তু বিপদ অপেক্ষা করছে ইংল্যান্ডের জন্য। এই সফরেই শুরুর দিকে ওকে খেলতে পারছিল না ইংল্যান্ড। পরের দিকে দেখলাম, ওকে স্টাডি করে কিছুটা উন্নতি করেছে টেকনিকে। শুরুতে মারতে যাচ্ছিল, লেংথ তালগোল পাকানো ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু তাতে সফল হয়নি।
সুনীল গাওস্কর। গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। সচিন তেন্ডুলকর। বিরাট কোহালি। কী ভাবে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের এই ধারাকে দেখছেন?
চাঁদু বোরদে: (হেসে) শুনুন, শুনুন, আমি কিন্তু তুলনায় বিশ্বাসী নই। প্রত্যেকেই নিজের সময় গ্রেট। নিজের যুগে প্রত্যেকই অসাধারণ সব কীর্তি রেখে গিয়েছে। নিজের প্রজন্মে প্রত্যেকেই ছিলেন ভেরি গুড। প্রত্যেকেরই দাপট ছিল নিজের সময়ে। আমার সময়ে যেমন ছিলেন বিজয় হাজারে। আমরা ভালবাসতাম ওঁর ব্যাটিং। উনি ছিলেন গ্রেট। একই ভাবে প্রত্যেকেরই জীবনে একটা সময় থাকে, যখন ফর্ম থাকে তুঙ্গে। এখন যেমন রয়েছে বিরাটের। কিন্তু,ওর আগেও অনেক গ্রেট ছিলেন। আর সন্দেহ নেই, কোহালিও ভেরি গুড প্লেয়ার।
ক্রিকেটে বলা হয়, রেকর্ড গড়া হয় ভাঙার জন্যই। তবু সচিনের ১০০ শতরানের রেকর্ড কি কোহালি টপকে যেতে পারেন?
চাঁদু বোরদে: হ্যাঁ, এখন যত ম্যাচ খেলা হচ্ছে, তাতে পুরনো সব রেকর্ড ভাঙতেই পারে। আর এখন ক্রিকেটারদের সামনে সুযোগও রয়েছে। এত ম্যাচ খেলা হয় এখন! আমি তো বিশ্বাস করি, আগের সব রেকর্ডই ভাঙবে।
বিরাট কি পারবেন ইংল্যান্ড থেকে টেস্ট সিরিজ জিতে ফিরতে? ছবি: রয়টার্স।
এখন যেমন প্রচুর ম্যাচ খেলা হয়, তেমন চাপও তো কয়েক গুণ বেশি। তিন রকম ফরম্যাটের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়।
চাঁদু বোরদে: দেখুন, তিন রকম ফরম্যাটের জন্যই আলাদা আলাদা মানসিকতা লাগে। টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে একদিনের ক্রিকেটের বিশাল তফাত। আবার টি-টোয়েন্টির সঙ্গে ওয়ান-ডে ক্রিকেটেরও বিস্তর তফাত। তবে আমার মনে হয়, বেসিক ভাল থাকলে তিন ফরম্যাটেই মানিয়ে নেওয়া সম্ভব। ফাউন্ডশনই চাবিকাঠি। বলা হয় না, ভিত ঠিক থাকলে নির্মাণে কোনও সমস্যা হয় না। ক্রিকেটেও তাই। জমাট টেকনিক হল আসল। কোহালি যেমন। নানা রকমের শট খেলতে পারে অনায়াসে। এখন অবশ্য নানা বৈচিত্র এসেছে। অফস্টাম্পে সরে এসে লেগে মারা। আবার লেগে সরে গিয়ে কভারের ওপর দিয়ে তোলা। এটা বলতেই হবে, এই সময়ের ক্রিকেটারদের রিফ্লেক্স অনেক দ্রুত। অ্যাপ্রোচও আলাদা খানিকটা। জলদি মানিয়ে নিতে পারে এখনকার ক্রিকেটাররা। এটা প্রশংসনীয়।
এরাপল্লি প্রসন্নর মতো অনেক প্রাক্তনের কাছেই ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা অধিনায়ক হলেন মনসুর আলি খান পটৌডী। আপনার টেস্ট অভিষেক হয়েছিল ৬০ বছর আগে, ১৯৫৮ সালে। অনেক অধিনায়ক দেখেছেন। কার নেতৃত্ব সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে?
চাঁদু বোরদে: আমাদের সময়ের থেকে এখনকার ক্রিকেট অনেক বদলেছে। তখন ওয়ান-ডে ছিল না, টি-টোয়েন্টি ছিল না। নেতৃত্বের ধরন তাই স্বাভাবিক ভাবেই ছিল আলাদা। তখন ট্যাকটিক্সও ছিল অন্য রকমের। তখন আমরা অপেক্ষা করতাম ধৈর্যের সঙ্গে। এখন অপেক্ষার ব্যাপার নেই। অধিনায়করা কিছু ঘটাতে চায় সব সময়। তার জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দরকার অন্য মানসিকতার। তবে আবার বলছি, এ ভাবে তুলনা টানার পক্ষপাতী আমি নই।
শেষ প্রশ্ন। আপনারা যা করেছিলেন ২০০৭ সালে, এ বার কি তার পুনরাবৃত্তি সম্ভব?
চাঁদু বোরদে: কেন সম্ভ নয়? ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টকে বলব, অতীতে কী হয়েছে, তা ভুলে যাও। নিজের শক্তি মেলে ধর। গত কয়েক বছর যে ভাবে খেলেছো, সেটাতেই নজর দাও। আমাদের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে টেস্ট সিরিজ জেতার। আমাদের দল বেশ ভাল।
আরও পড়ুন: ভারতের তুরুপের তাস ‘চায়নাম্যান’ কুলদীপই
আরও পড়ুন: দ্বৈরথের আগে সতর্ক জিমি