সেই মহার্ঘ টিকিট
গোটা বাংলাদেশ কি ক্রিকেট-উন্মত্ত হয়ে গেল? না কি শুধু ঢাকা?
তা শনিবার সকাল থেকে এই শহরের যা ছবি দেখছি, তা উপমহাদেশে বড় ফাইনালের মাপেও অভাবনীয়।
কাল রাত থেকে টিকিট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন। সকালে টিকিট না-পেয়ে পুলিশের সঙ্গে টিকিট-উৎসাহীদের সংঘর্ষ। এ সব তো অল্প-বিস্তর হয়েই থাকে। ক্রিকেট প্রশাসক টিকিট খুঁজছে। দেশের ডাকসাইটে মন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করছেন টিকিট না পাওয়ায়। ঢাকা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ফোনে কালোবাজার থেকে দশ গুণ বেশি দাম দিয়ে টিকিট কিনতে তৈরি, এটাও বোঝা যাচ্ছে।
কিন্তু যারা ভারতের সঙ্গে কাল ফাইনাল খেলবে তারাই কেউ কেউ নাকি কোটার টিকিট পায়নি।
সকালের মীরপুর সাংবাদিক সম্মেলন নিশ্চয়ই ক্রিকেট ইতিহাসে অভূতপূর্ব। কারণ মাইকে বাংলাদেশ অধিনায়ককে জিজ্ঞেস করা হল, আপনি ক’টা টিকিট পেয়েছেন? বিশ্বের কখনও কোথাও সাংবাদিক সম্মেলনে এমন আজব প্রশ্ন হয়েছে বলে শোনা যায় না।
মাশরাফি মর্তুজা ডান হাত তুলে দেখালেন পাঁচটা। ভাবাই যায় না মাশরাফি যিনি বকলমে স্বয়ং বাংলাদেশ ক্রিকেট, তিনি পরিবার-বন্ধু-স্পনসর সব মিলে মাত্র পাঁচটা টিকিট পেয়েছেন। তাঁর টিমের এক উঠতি ক্রিকেটার শুনলাম বিলাপ করেছে যে তাকে মাত্র দু’টো টিকিট দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীর যে কোনও স্টেডিয়ামে ফাইনালের আগের দিন ম্যাচ প্রিভিউ লিখতে গেলে সাধারণ আলোচনা হল যে, দু’দলে কে কে গেমচেঞ্জার হতে পারেন? কার কার দিকে চোখ রাখা উচিত? এখানে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখি কিছু হিসেব শুনলাম— তিনশো জন এমপি পাঁচটা করে টিকিট মানে ১৫০০।
প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকে আসবেন মানে তাঁর ব্যারিকেড ৫০০।
সমস্ত ক্লাব আর রেজিস্টার্ড প্লেয়ার ৩০০০।
আর্মি ২০০০।
আমলা এবং তাঁদের বায়না-সহ ২০০০।
মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত টিকিট ১০০০।
মাত্র পঁচিশ হাজার টিকিট থেকে এতগুলো চলে গেলে কত থাকল ভেবে দেখুন? তথ্যগুলো ঠিক না ভুল জানি না তবে এ জাতীয় আলোচনা ক্রিকেট মহলের খোপে খোপে। বাংলাদেশ বোর্ড কর্তাদের প্রায় সবারই মোবাইল মোটামুটি বন্ধ। কেউ এই সব বিপদের দিনের জন্য আলাদা সিম রাখেন। তাতেও নাকি এ বার নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না। এখন প্রযুক্তির যুগ। টিকিটপ্রার্থী ফেসবুকের ইনবক্সে মেসেজ রেখে দিচ্ছে। ইনস্টাগ্রামে বি দিচ্ছে— বিপন্ন, টিকিট দাও। টুইটারে নোটিফিকেশন দিচ্ছে। বাঁচার উপায় কোথায়?
নেটে সামনে ধোনি ব্যাট করছেন। কে বলতে পারে বাংলাদেশে রোববারই তাঁর শেষ ম্যাচ কি না? কিন্তু সে সব দিকে কারও আজ লক্ষ্যই নেই।
ফাইনালে পিচ কেমন হবে তা নিয়েই বা আলোচনা কোথায়? অথচ পিচ এই টুর্নামেন্টে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। মনে করা হচ্ছে ফাইনালে বাংলাদেশের একমাত্র সুযোগ সবুজ পিচে যদি তার চার ফাস্ট বোলার কোনও কেরামতি দেখাতে পারে। কিন্তু সবুজটাতেই কি ফাইনাল হচ্ছে? না কি পাশের স্লো উইকেটে?
কারও কোনও উচ্চবাচ্য নেই। এমনিতে মীরপুর মাঠে সন্ধের দিকে ক্রিকেট দেখাটা এমনই উৎসবের জমজমাট অভিজ্ঞতা যে, রবীন্দ্রসঙ্গীত ভক্তের দু’লাইন গুনগুন চলেই আসতে পারে—
‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।’
কিন্তু এই রোম্যান্টিসিজম মুহূর্তে উড়ে যাবে স্থানীয় ক্রিকেটভক্তের বিলাপ শুনলে— কাল মীরপুর মাঠে দেখতে পাবেন সব নতুন দর্শক। আর্মির লোক, মন্ত্রী-আমলা-পেয়াদা, ব্যবসায়ী। আমরা তো টিকিটই পাচ্ছি না!
সোশ্যাল মিডিয়ায় সকাল সকাল তাসকিন আর ধোনির একটা পাশাপাশি ছবি ভাইরাল হয়ে গিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। রবি শাস্ত্রীকে তা নিয়ে জিজ্ঞেসও করা হল। তিনি সুন্দর ভাবে পাশ কাটালেন— ‘‘আমরা যখন ক্রিকেট খেলি তখন না-পড়ি খবরের কাগজ, না দেখি অন্য কিছু।’’ তাঁর এই উত্তর সত্ত্বেও সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন করে জলঘোলা হতে পারত পুরনো সব ঢাকা মাঠের ভারত-বাংলাদেশ বৈরিতা নিয়ে। কিন্তু টিকিটের চাহিদা যেন ম্যাচের প্রথম বল হওয়া পর্যন্ত সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে। হারিয়ে দিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের ন্যক্কারজনক পোস্টটাকেও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক আসিফ জামাল অবশ্য গোটা দেশের এই ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে একতাবদ্ধ হওয়ায় অভিভূত নন। হতাশ ভাবে বলছিলেন, ‘‘বিনোদিত হওয়ার মতো উপকরণ এ দেশে এত কম যে লোকে এই জাতীয় বিনোদন পেলেই তার প্রতি অনিবার্য ভাবে আকৃষ্ট হতে থাকে। জাতীয় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেতনা শুধু ক্রিকেট নামক সরু সুতোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? ঐক্যবদ্ধ তো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়েও হওয়া যায়। শাসক কী ভাবে ঠকায়, তার বিরুদ্ধেও হওয়া উচিত। শুধু ক্রিকেটই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে কেন?’’
কিন্তু এমন কণ্ঠস্বর এশিয়া কাপ নির্ণয়কারী রোববারের প্রাক্কালে মরুভূমিতে রোদনের মতো। সব চেয়ে আশ্চর্যের কলকাতায় যেমন ৩ এপ্রিল বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টি ফাইনাল বলে লোকে আগাম টিকিটের আকুতি করে রেখেছে, ঢাকাবাসী সেটা করেনি। মাশরাফির টিম টি-টোয়েন্টির দল হিসেবে যেহেতু ঐতিহাসিক ভাবে সফল নয়, কেউ তাদের উপর ভরসাই করেনি। হঠাৎ করে টিম ফাইনাল চলে যাওয়ায় তাই শেষ মুহূর্তের আকুলি-বিকুলি।
এশীয় ফাইনাল টিকিটের জন্য ‘হোক কলরব’ গর্জনে অবাক হয়ে ভাবছি দু’বছর আগে এখানেই বিশ্ব টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ খারাপ খেলার পর কী মুষড়ে আর কী রকম নৈরাশ্যের মধ্যে ছিলেন মানুষ। এমনকী বাংলাদেশ মিডিয়াও। দু’টো কাগজ প্রথম পাতায় এমন ব্যতিক্রমী শিরোনাম করেছিল যে, তেইশ মাস পরেও মনে আছে।
‘এই পরাজয়ের শেষ কোথায়’
‘জয় তুমি কী, খুব জানতে ইচ্ছে করে’
আজ বুড়িগঙ্গার ধারে সেই শহরই কি না টি-টোয়েন্টির ফাইনালে ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ক্রিকেটের এই থিমপুজো যেন বলছে, হোক কলরব, ইতিহাস তৈরির প্রত্যুষে।
এমনই অদ্ভুত স্ব-বিরোধিতা যে এই লাইনটা যাঁর রচিত, গোটা ঢাকায় একমাত্র তাঁকেই এই কলরবে পাওয়া যাচ্ছে না। বিখ্যাত গায়ক সায়ন চৌধুরী অর্ণব ক্রিকেটভক্ত হয়েও জানতেন না রোববার যে ফাইনাল। লজ্জিত ভাবে বললেন, ‘‘বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি গানটার ওপর কোরাসে একটা অ্যাপ তৈরি করছি বলে রাতদিন ব্যস্ত রয়েছি। তবে ক্রিকেটের কলরব তো সব সময়ই ভাল।’’
ভারতীয় শিবিরের দর্শন ঠিক বিপরীতমুখী। রবি শাস্ত্রীর অধীনে টিমটা এখন একটা জোনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সব ম্যাচ তারা একই রকম ভয়ডরহীন ভঙ্গিতে খেলে জিততে চায়। কোনটা ফাইনাল, কোনটা সাধারণ ম্যাচ তার তোয়াক্কা না করে। তা হলে আর বিশেষ করে একটা দিনে কলরব চাইবে কেন?
ঢাকায় রোববার ফাইনাল একটা হচ্ছে বটে!