লড়াই: লকডাউনেও প্রস্তুতি চলছে সিঙ্গুরের পলির। নিজস্ব চিত্র
প্রায় দেড় বছর পরে ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের শিবিরে ডাক পেয়েছিলেন পলি কোলে। চূড়ান্ত দলে নির্বাচিত হওয়ার আগেই শুরু হয়ে যায় লকডাউন। অন্ধকার নেমে আসে বাঙালি ডিফেন্ডারের জীবনে।
অস্থির সময়ে কী ভাবে ফিট থাকতে হবে প্রত্যেক ফুটবলারকে জানিয়ে দিয়েছিলেন জাতীয় দলের ফিটনেস ট্রেনার। নিয়মিত অনুশীলনের পাশাপাশি খেতে হবে পুষ্টিকর খাবার। কিন্তু সিঙ্গুরের বুড়োশান্তি গ্রামে গৃহবন্দি পলির ভরসা শুধু ভাত, ডাল আর আলুসেদ্ধ! ফোনে বাংলা মহিলা দলের প্রাক্তন অধিনায়ক বলছিলেন, ‘‘জাতীয় দলের ফিটনেস ট্রেনার বলেছিলেন, সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন মাংস খেতেই হবে। এ ছাড়া প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, দুধ ও ফল খেতে বলেছেন। কিন্তু আমার পক্ষে এই মুহূর্তে কেনা সম্ভব নয়।’’ কেন? হতাশ পলি বললেন, ‘‘আমার দাদা দিন মজুর। লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই বাড়িতে বসে রয়েছেন। আমি এখনও চাকরি পাইনি। তা ছাড়া এই মুহূর্তে আমাদের এখানে ১৪০ টাকা কেজিতে মুরগির মাংস বিক্রি হচ্ছে। আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় কেনা।’’ তিনি আরও বললেন, ‘‘আমাদের রুটি খেতে বলা হয়েছে। কিন্তু লকডাউনের কারণে আটার দাম এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে কেনা সম্ভব নয়। আর ফল কিনতে যাওয়া তো এই সময় বিলাসিতা। ভাত-ডাল আর আলুসেদ্ধই আমাদের কাছে অমৃত।’’
প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অনুশীলন বন্ধ করেননি পলি। ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে হরিপাল যেতেন অনুশীলন করতে। বাড়ি ফিরেই ছুটতেন স্কুলে। বিকেলে আবার গ্রামের মাঠে ছেলেদের সঙ্গে খেলতেন।’’ লকডাউনের জেরে এখন অবশ্য গ্রামের মাঠে ফুটবল বন্ধ। তাই বাড়িতেই বাড়িতেই দু’বেলা অনুশীলন করছেন জাতীয় দলের ডিফেন্ডার। বলছিলেন, ‘‘এর চেয়েও খারাপ অবস্থার মধ্যে আমার দিন কেটেছে।’’ কবে? পলি বলছিলেন, ‘‘আমার বাবা একশো দিনের কাজের শ্রমিক ছিলেন। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। দু’বেলা খাওয়া জুটত না। পুকুর থেকে তুলে আনা গেড়ি-গুগলি ও ভাতের ফ্যান খেয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছে। কখনও আবার শুধুই ছাতু খেয়েছি।’’ বঙ্গ ডিফেন্ডার যোগ করলেন, ‘‘এমনও দিন গিয়েছে, অন্যের খেত থেকে তুলে আনা ছোলা আমরা ভাগ করে খেয়েছি। কখনও কখনও সেটাও জুটত না। তখন শুধু জল খেতাম। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই অনুশীলন বন্ধ করিনি। কারণ, ফুটবলই আমার বেঁচে থাকার মন্ত্র।’’
প্রবল দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে করতেই সিঙ্গুরের গোলাপমোহিনী মল্লিক গার্লস হাইস্কুলের দলে সুযোগ পান পলি। সেখান থেকেই নির্বাচিত হন অনূর্ধ্ব-১৯ বাংলা দলে। বছরখানেকের মধ্যেই জায়গা করে নেন সিনিয়র দলে। বাংলার হয়ে দুর্দান্ত খেলায় ডাক পান জাতীয় দলে। কিন্তু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে ভারতীয় দল নেপাল রওনা হওয়ার ঠিক আগে বাবাকে হারান তিনি। আর যেতে পারেননি নেপালে। সেই আক্ষেপ কিছুটা দূর হয়েছিল অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন পর্বের ম্যাচের জন্য ফের ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ায়। তবে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করা সত্ত্বেও চাকরি জোটেনি পলির। উপেক্ষার যন্ত্রণা নিয়ে গত মরসুমে চলে গিয়েছিলেন কেরলের গোকুলম এফসির হয়ে খেলতে। পলির কথায়, ‘‘অন্যান্য রাজ্যের ফুটবলারেরা অধিকাংশই সরকারি চাকরি করে। রাজ্য দলের হয়ে খেললে চাকরি নিশ্চিত। ব্যতিক্রম বাংলাতেই। জাতীয় দলে হয়ে খেলা সত্ত্বেও আমি চাকরি পাইনি।’’ এই মরসুমে আবার বাংলায় ফিরেছেন পলি। শ্রীভূমি এফসির হয়ে মেয়েদের আই লিগে খেলেছেন। ডাক পান সাফ চ্যাম্পিয়শিপের জন্য। কিন্তু করোনার থাবায় স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়েই এখন দিন কাটছে পলির।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)