লকডাউন ময়দান। —প্রতীকী চিত্র।
ছোটবেলায় আঁকার ঝোঁক ছিল। কিন্তু বাইশ গজে ব্যাট হাতে নেমে পড়ার নেশা ছিল তার চেয়েও বেশি। আঁকার সেই লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেই ডালপালা মেলে দিয়েছে লকডাউনে। সারাদিন বাড়িতে। স্ত্রী সুস্মিতাকে বাড়ির কাজে সাহায্য, টুকটাক রান্নাঘরে ঢুকে ইউটিউব দেখে খিচুড়ি-চিকেন কারিওয়ালা বানানো, বছর দু’য়েকের ছেলে উভানের সঙ্গে খেলা— তার পরেও হাতে থাকছে সময়। রাতের দিকে কাগজ আর পেন নিয়েই বসে পড়ছেন। আঁকছেন নিজের মতো। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টও করছেন। ক্রিকেটার মনোজ তিওয়ারির যেন খুলে গিয়েছে অন্য এক জীবন।
ইনি ক্রিকেটার নন, ফুটবলার। ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন ক্যাপ্টেন এবং বর্তমান দলের সদস্য। রয়েছেন জালন্ধরের কাছে নিজের গ্রামে। গ্রামের নাম জিগরানা। গুরবিন্দর সিংহের দিন শুরু হয় প্রার্থনা দিয়ে। তার পর বাড়িতে জিমে ঘণ্টা দু’য়েক চলে যায়। ট্রেডমিলে ঘাম ঝরিয়ে হাত লাগান বাড়ির কাজে। সাফ-সুতরো হয়ে রান্নায় সাহায্য। চিকেন কারিও তৈরি করে ফেলছেন কখনও। বেগুনের তরকারিও পারেন। তার পর বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলো। গ্রামের এক জায়গায় নোংরা জল বেরিয়ে আসছিল। সেটাকেও ঠিকঠাক করে এসেছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন গ্রামবাসীদের দিকে। এতই ব্যস্ত যে মোবাইল বেজে যাচ্ছে, ধরার ফুরসতই মিলছে না!
আরও পড়ুন: আমাদের সেই দল বিরাটদের কড়া চ্যালেঞ্জে ফেলত, বলছেন রবি শাস্ত্রী
করোনাভাইরাস আসলে পাল্টে দিয়েছে খেলোয়াড়দের রুটিনকেই। ক্রিকেট হোক বা ফুটবল, কবে যে তা শুরু হবে, তার আন্দাজ বোধহয় ফেলু মিত্তির বা ব্যোমকেশের পক্ষেও জানা মুশকিল। ময়দানে সব কিছুই যে অচেনা এ বার।
পয়লা বৈশাখে বারপুজোয় বল গড়ানো শুরু। তার পর ক্রমশ জাগতে থাকে ময়দান। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে পঞ্চম ডিভিশন, চতুর্থ ডিভিশনের ফুটবল ম্যাচ শুরু হয়ে যায়। বিকেলের সেই সব ম্যাচের আগে অর্থাৎ সকালে বড় ক্লাবগুলো প্রস্তুতি সেরে নেয়। সমর্থকদের ভিড়ে গমগম করতে থাকে ক্যান্টিনগুলো। ময়দান মার্কেটে বাড়তে থাকে জার্সি-বুটের অর্ডার। রোদ-জল-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে শহর মেতে ওঠে ফুটবলের মরসুমে।
বাড়িতে সপরিবারে মনোজ তিওয়ারি। —নিজস্ব চিত্র।
২২ গজের দুনিয়ায় এই সময়ের ছবিটা থাকে একটু আলাদা। ক্লাব ক্রিকেট পৌঁছে যায় শেষ পর্বে। সঙ্গে থাকে আইপিএলের উন্মাদনা। কলকাতা নাইট রাইডার্সের খেলায় পাল্টে যায় ময়দানের চেহারা। বেগুনি-সোনালি পতাকা-জার্সিতে ভরে যায় ইডেন। মধ্যরাত পর্যন্ত উত্তেজনা-উন্মাদনায় মেতে ওঠে শহর।
লকডাউনের শুনশান নিষ্প্রাণ ময়দানে এখন সে সবই লাগে গল্পকথার মতো। যেন কোন দূর অতীতের টুকরো টুকরো ছবি। জনমানবহীন বটতলা, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সামনে খাঁ খাঁ রাস্তা, তালা মারা ক্যান্টিন, ঘুমিয়ে পড়া ইডেন...
মুশকিল হল, করোনাভাইরাস আতঙ্ক কাটিয়ে কবে ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে ময়দান, সেটাও আন্দাজের উপায় নেই। জীবনই যেখানে অনিশ্চয়তায় সরণিতে, সেখানে ঝুঁকি নিয়ে খেলার কথা ভাবাও যে বাতুলতা। ক্রিকেটার-ফুটবলাররা স্বাভাবিক ভাবেই ঘরবন্দি। সময় কাটাতে নিত্যনতুন কাজে পড়ছেন জড়িয়ে।
A post shared by MANOJ TIWARY (@mannirocks14) on
ছবি আঁকছেন মনোজ। পোস্ট করলেন নিজেই।
মনোজ যেমন আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, “রান্না করছি, ঘর পরিষ্কারের কাজে হাত লাগাচ্ছি, ছেলেকে সামলাচ্ছি। তার পরও হাতে সময় থাকছে। অগত্যা, পেন দিয়ে স্কেচ করছি। রং-পেন্সিল নেই, শুধু পেন নিয়েই বসে পড়ছি। মার্কারও আছে। কার্টুন চরিত্র আঁকছি। ছেলেবেলায় আঁকতে ভালবাসতাম। কিন্তু তার পর আর সময় পাইনি। এখন ভালই লাগছে আঁকতে। ইনস্টাগ্রামে পোস্টও করছি।”
ঋদ্ধিমান সাহা আবার পড়াচ্ছেন মেয়ে আনভিকে। প্রায় দু’মাসের ছেলে ছোট্ট অনভয়কে যখন সামলাচ্ছেন স্ত্রী রোমি, তখন বই-খাতা নিয়ে রীতিমতো গৃহশিক্ষকের ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। পাশাপাশি, ঝাড়ু দেওয়া, ফ্যানের ব্লেড পরিষ্কারের মতো ঘরোয়া কাজেও হাত লাগাচ্ছেন দেশের এক নম্বর উইকেটকিপার। সঙ্গে অবশ্য থাকছে শরীরচর্চাও। হাতের কাছে যা পেয়েছেন, তাই নিয়েই চালিয়েছেন তা। এমনকী, সুটকেস তুলেই সেরেছেন ওয়েট ট্রেনিং। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ভিডিয়োয় স্ত্রী রোমির ক্যাপশন, ঋদ্ধি হলেন ‘অফফিল্ড অলরাউন্ডার’।
ঘরের কাজেও কেমন দক্ষ ঋদ্ধিমান, দেখে নিন এই ভিডিয়োয়।
অনেকের আবার গানের প্রতিভাও বেরিয়ে আসছে। গীতিময় বসুকে যেমন দেখা যাচ্ছে, টুইটারে গানের ভিডিয়ো পোস্ট করতে। বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে খেলা গীতিময় বললেন, “গান গাইতে বরাবরই ভাল লাগে। বাথরুম সিঙ্গার ছিলাম। স্ত্রী শ্রমণা, ছেলে শ্রময়কে দেওয়ার পরও এখন প্রচুর অবসর। গান গাইছি মনের আনন্দে। সবাই উৎসাহ দিচ্ছে বলে ভালও লাগছে। তা ছাড়া ব্যায়াম করছি। এই সময়ে কী কী কসরত বাড়িতেই সহজে করা যায়, তেমন ভিডিয়োও পোস্ট করেছি।”
একা গীতিময় নন, নিজেকে ফিট রাখার চ্যালেঞ্জ রয়েছে সমস্ত ক্রিকেটারেরই। ব্যাট-বল নিয়ে নেটে নামার উপায় নেই, কিন্তু ‘ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ’ তো করাই যায়। এ ক্ষেত্রে গাইডের ভূমিকায় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল। শুধু সিনিয়র দলই নয়, বাংলার সমস্ত বয়স-ভিত্তিক দলের কাছেই পৌঁছে গিয়েছে ফিটনেস পোগ্রাম। সিএবি সচিব স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “বাংলার রঞ্জি দলের ক্রিকেটারদের সবাইকে ট্রেনিং শিডিউল পাঠানো হয়েছে। যাতে সবাই বাড়িতে বা বাড়ির কাছে মাঠ থাকলে প্রস্তুতি নিতে পারে। বাংলার সমস্ত পর্যায়ের দলের ক্রিকেটারদেরই এ ভাবে ট্রেনিং করতে বলা হয়েছে।” এর মধ্যে ভিভিএস লক্ষ্মণ বাংলা ক্রিকেটারদের অনলাইনে বিশেষ ক্লাসও নিয়েছেন। এ ভাবে যতটা তৈরি থাকা যায় আর কী!
গত ৩০ এপ্রিল আবার জন্মদিন ছিল অনুষ্টুপ মজুমদারের। রঞ্জিতে বাংলার ফাইনালে ওঠার অন্যতম কারিগর স্বাভাবিক ভাবেই লকডাউনের আবহে ঘরোয়া চৌহদ্দিতেই তা সীমাবদ্ধ রেখেছেন। স্ত্রী সোনালির বানানো কেক, বিরিয়ানি ও পায়েসে অবশ্য তা ভালমতনই কেটেছে। ছেলে ঋষিকও বেশ মজা পেয়েছে। তবে আক্ষেপ একটাই, বাবা-মার আশীর্বাদও নিতে হয়েছে ভিডিয়ো কলে।
লকডাউনের মধ্যেই ঘরোয়া জন্মদিন পালন অনুষ্টুপ মজুমদারের। —নিজস্ব চিত্র।
ফুটবলে আবার একেবারেই ভাঙা হাটের ছবি। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, দুই দলেরই স্প্যানিশ ব্রিগেড দেশে ফেরার উড়ান ধরেছে আগেই। করোনা-আতঙ্ক চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই ক্লাবের কোচ-ফুটবলারদের একই বাসের সওয়ারি করে পৌঁছে দিয়েছে রাজধানীতে। সেখান থেকে তাঁরা ধরেছেন আমস্টারডামের উড়ান। তবে দুই প্রধানের সব বিদেশি এখনও দেশে ফিরতে পারেননি। ইস্টবেঙ্গলে আসা কোস্টারিকার বিশ্বকাপার জনি অ্যাকোস্তা যেমন শহরে পা রেখেই গিয়েছেন আটকে। কোনও ম্যাচও খেলতে পারেননি। মোহনবাগানের পাপা দিবাকরও রয়েছেন কলকাতায়। লাল-হলুদ শিবিরের কাশিম আইদারাও ফ্রান্সে ফিরতে পারেননি।
আরও পড়ুন: ‘এই সময়টা যেন ভয়ঙ্কর উইকেটে টেস্ট ম্যাচ খেলা’
এই আবহেও পরের মরসুমের কথা ভেবে ফুটবলারদের সঙ্গে চুক্তি সেরে নিচ্ছে ইস্টবেঙ্গল। মোহনবাগান আবার অপেক্ষায় এটিকের সঙ্গে সংযুক্তির। যা আভাস, তাতে এটিকের ফুটবলাররাই দলে বেশি প্রাধান্য পাবেন। ফলে, দল গড়ার ক্ষেত্রে খুব একটা উদ্যোগী দেখাচ্ছে না সবুজ-মেরুন শিবিরকে। তবে তা নিয়ে ভাবছেনই না আশুতোষ মেটা। এটিকেতে তিনি যোগ দিতে পারেন বলে খবর রয়েছে। তাঁর চিন্তা মুম্বইয়ে ফিরতে না-পারা নিয়ে। মোহনবাগানের সাইড ব্যাক আটকে পড়েছেন কলকাতায়। সময় কাটছে কী করে? আশুতোষ বললেন, “রান্না করছি, চিকেন আর পাস্তাই ভালই পারি। ভিডিয়ো গেম খেলছি। ফুটবল না-খেলার কষ্ট ভোলাচ্ছি ও ভাবেই। আর দেখছি সিনেমা। ইংলিশ-হিন্দি কিছুই বাদ দিচ্ছি না। শেষ দেখলাম ‘হায়দর’। নতুন সিনেমাও অনেক দেখেছি। তবে তাও বাড়ির কথা মনে পড়ছে। এখানে ভাল লাগছে না আর। ভিডিয়োতে কথা বলছি মাঝে মাঝেই।”
ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণের বড় ভরসা গুরবিন্দর অবশ্য আছেন পঞ্জাবেই। কিছুদিন আগে ইটভাটার শ্রমিকদের সাহায্য করেছিলেন। গ্রামের ২৫ পরিবারের পাশেও দাঁড়িয়েছেন তিনি। মোবাইলে বললেন, “বাড়িতেই রয়েছে জিম। তাতে সব যন্ত্রপাতিই রয়েছে। আমি সেখানেই সময় কাটাই।” আর কী করেন? বললেন, “বাড়িতে অনেক কাজ থাকে। সাফাই-রান্না। বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা। গ্রামের শ্মশানঘাটের কাছে জল বেরিয়ে যাওয়ার জায়গা ভরে গিয়েছিল। নোংরা জল বেরিয়ে আসছিল। সেটা পরিষ্কার করতেও চলে গিয়েছিলাম। গ্রামের মানুষদের সাহায্য করছি। আর জিম তো আছেই। পরিশ্রমের মধ্যেই আছি। প্রস্তুত রাখছি নিজেকে।”
দেখুন ভিডিয়ো—
ঘরেই জিম, ছাদেই ফুটবল, লকডাউনে কী করছেন খেলোয়াড়রা?
আই লিগ জয়ী মোহনবাগানের রক্ষণের শেষ প্রহরী শঙ্কর রায় আসন্ন মরসুমের জন্য সই করেছেন ইস্টবেঙ্গল। তা কখন শুরু হবে, তা অজানা। তবে নিজেকে ফিট রাখতে তো বাধা নেই। দমদম নাগেরবাজারের বাড়ির ছাদে স্ত্রী প্রিয়ার সঙ্গেই করছেন টুকটাক ট্রেনিং। বললেন, "স্কিপিং করছি, পেটের এক্সারসাইজ সারছি। আবার বল ধরাও অনুশীলনও করছি।" পাশাপাশি, নিয়মিত গান শোনা, দিদির সঙ্গে লুডো খেলা, অনলাইনে ভিডিয়ো গেম ‘প্রেস’-এ সময় কাটানোও রুটিনে ঢুকে পড়েছে। যা আবার ফুটবল গেমস। দুধের স্বাদ ঘোলেই মিটছে খানিকটা। সঙ্গে থাকছে খাওয়াদাওয়া। প্রিয়া কখনও কেক বানাচ্ছেন, কখনও অন্য কিছু তৈরি করছেন। রসনাতৃপ্তি ঘটছে। বললেন, "আমি রান্নার দিকে ঝুঁকছি না। আমার স্ত্রী যা বানিয়ে আনছে, আরাম করে খাচ্ছি। কেকটা যেমন দারুণ হয়েছিল।" আর খাওয়া-দাওয়ার পর ক্যালারি খরচের জন্য ছাদ তো রয়েইছে!
মুশকিল হল, খেলোয়াড়রা এখন শুধু তৈরিই রাখতে পারেন নিজেকে। তার বাইরে কোনও কিছুই যে হাতে নেই। কবে কাটবে করোনা-ভয়, কবে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে জীবনযাত্রা, তা জানা নেই কারও। ফলে বাড়ছে অসহায়তা।
ক্রিকেটে যেমন সিএবি লিগের দ্বিতীয় ডিভিশনের অনেক খেলা বাকি। প্রথম ডিভিশনে শুধু গ্রুপের খেলা শেষ হয়েছে। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল, ফাইনালের নকআউট পর্যায় বন্ধই আপাতত। সিএবি নকআউটে শেষ হয়েছিল লিগের খেলা, নকআউট হয়নি। জেসি মুখার্জি ট্রফির লিগের খেলাও শেষ হয়নি। পি সেন ট্রফি নিয়ে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয় সিএবি। এ বছর তো সেই প্রশ্নই ওঠে না।
ফিসফাস শোনা যাচ্ছে যে, এই আবহে কিছু ক্লাব চাইছিল যেখানে থমকে আছে খেলা, সেখান থেকেই পরের বছর শুরু করতে। যাতে এই বছরের চুক্তিতেই পরের বছর খেলানো যায় ক্রিকেটারদের। এতে অবধারিত ভাবেই পকেটে কোপ পড়ার কথা ক্রিকেটারদের। কারণ, এক মরসুমের অর্থই এতে ফাঁকি পড়ে যেত। সিএবি এখনও তা মানেনি। তবে ক্লাব ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে, ক্রিকেটারদের চুক্তির পরিণতিই কী হবে, তা নিয়ে থাকছে বিস্তর ধোঁয়াশা।
সাধারণত, এক বছরের জন্যই ক্লাবের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকেন ক্রিকেটাররা। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ চুক্তির এক-তৃতীয়াংশ সাধারণত দেওয়া হয়ে থাকে ক্রিকেটারদের। গরমের মধ্যে দেওয়া হয় আরও কুড়ি-পঁচিশ শতাংশ টাকা। আর মরসুমের শেষে বাকি পেমেন্ট করা হয়। যা হাতে আসতে অগস্ট হয়ে যায়। সেপ্টেম্বরে শুরু হয় দলবদল। এ বার কী অবস্থা দাঁড়াবে, তা নিয়ে থাকছে ধোঁয়াশা। অনেক ক্রিকেটারই বুঝতে পারছেন না, এ বারের চুক্তির পুরো টাকা মিলবে কি না। এই মরসুমের খেলাই বা কী হবে, পরের মরসুম কী দাঁড়াবে, দলবদলেরই বা কী ভবিতব্য, উত্তর নেই কোনও কিছুরই। থাকছে শুধু আশঙ্কা, চুক্তির টাকা মিলবে তো!
চলছে ভিভিএস লক্ষ্মণের অনলাইন কোচিং ক্লাস। আছেন বাংলার কোচ অরুণলালও। —সিএবি সূত্র।
যে ক্লাবগুলো আবার ট্রফি জেতার লক্ষ্যে নামে, ভাল জায়গাতেও রয়েছে, তাঁদের ক্রিকেটারদের আক্ষেপ আবার অন্য। যে ক্রিকেটাররা নকআউট পর্যায়ে ভাল পারফরম্যান্সের জেরে নির্বাচকদের নজরে পড়তে চান, বাংলা দলে আসার দাবি জোরাল করতে চান, তাঁদের মানসিক অবস্থা আরও খারাপ। একটা মরসুম করোনাতেই তো চলে যাচ্ছে। বাংলার হয়ে খেলার স্বপ্ন ফিকে হচ্ছে না তো!
শুধু ক্রিকেটাররাই নন, দুশ্চিন্তায় আম্পায়ার-স্কোরাররাও। খেলা না হলে তাঁদের অস্তিত্বও যে সঙ্কটে। ভাঁড়ারে টান সিএবি-রও। করোনার জেরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কী? স্নেহাশিস বললেন, “দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ওয়ানডে ম্যাচ হয়নি। আইপিএল হল না। ফলে সিএবি-র আর্থিক ক্ষতি তো হয়েইছে। সঠিক অঙ্ক বলা মুশকিল, তবে ক্ষতি যে কোটির উপরে, তা নিয়ে সংশয় নেই।”
সিএবি আবার করোনার বিরুদ্ধে লড়াইতেও এগিয়ে এসেছে। ত্রাণ তহবিলে দেওয়া হয়েছে এককালীন ২৫ লক্ষ টাকা। আরও ১৭ লক্ষ টাকা জোগাড় করে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ক্লাব, ক্লাবকর্তা ও ক্রিকেটারদের থেকে। একক ভাবেও নানা ক্লাবকর্তা এগিয়ে এসেছেন। বিশ্বরূপ দে যেমন। কলকাতার নানা অঞ্চলে টানা কয়েকদিন তিনি চাল-ডাল-আলু পৌঁছে দিয়েছেন। শিশুদের জন্য পৌঁছে দিয়েছেন দুধ। সার্বিক ভাবে পাঁচ হাজার অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়নো লক্ষ্য তাঁর। এর মধ্যে ইডেন গার্ডেন্স, মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান স্পোর্টিং, সল্টলেকে যাদবপুর ক্যাম্পাসের মাঠ— সব জায়গার মাঠকর্মীদের জন্য খাওয়ার প্যাকেটও দিয়েছেন।
প্রাক্তন ক্রিকেটার ও বর্তমানে সিএবি নির্বাচক শুভময় দাস থাকেন সল্টলেকে। সেখানে কয়েক দিন ধরে আটকে পড়েছেন বেশ কয়েকজন খেটে খাওয়া লোক। যাঁদের কেউ থাকেন অন্য রাজ্যে। যাওয়ার উপায় নেই বলে থেকে গিয়েছেন এখানে। আবার কেউ এখানকারই বাসিন্দা। কিন্তু রোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এঁদের সবার দায়িত্ব নিয়েছেন শুভময়। ব্যবস্থা করে দিয়েছেন খাদ্যদ্রব্যের।
ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ও বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক লক্ষ্মীরতন শুক্ল আবার করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বার্তা দিতে বাড়িতে বসেই তৈরি করেছেন একটি শর্ট ফিল্ম। সাড়ে ছয় মিনিটের এই শর্ট ফিল্মের নাম ‘ডাল, ভাত, চোখা’। যাতে মানুষকে বাড়িতে থাকার বার্তা দিয়েছেন চিরকালের ‘ফাইটার’ লক্ষ্মী। লকডাউনে বারবার বাড়ির বাইরে না যাওয়ার আবেদনের পাশাপাশি পোলাও, মাছ, মাংসের মতো এলাহি খাবারের বদলে ডাল, ভাত, আলুর চোখা খেয়েই কঠিন পরিস্থিতিতে লড়তে বলেছেন তিনি। রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্রিকেটার মনোজ তিওয়ারি-অনুষ্টুপ মজুমদার, অনূর্ধ্ব-২৩ বাংলা দলের কোচ সৌরাশিস লাহিড়ীরা বাড়ি থেকেই অভিনয় করেছেন এতে।
লকডাউনে এই শর্ট ফিল্ম বানিয়ে ফেললেন লক্ষ্মীরতন।
ফুটবলে ময়দানের প্রধান আকর্ষণ হল ডার্বি। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের চিরকালের ঘটি-বাঙালের লড়াই বঙ্গ-আবেগের শিরায় শিরায় এখনও আনে উত্তেজনা। আই লিগে দ্বিতীয় দফায় এই ম্যাচ হয়নি করোনার জেরে। কলকাতা লিগে কি তা হবে? মোহনবাগানের ফুটবল সচিব সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় বললেন, “এখন ফুটবলের কথা ভাবছিই না। বিশ্ব জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। ভারতেও এত মানুষ আক্রান্ত। এখন এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আছি, যেখানে কারও হাতে কিছু নেই। আমার তো খুব সংশয় আছে, লিগ আদৌ শুরু হবে কি না। এত তাড়াতাড়ি তো কোনও প্রশ্নই নেই। পরের দিকে হয়তো হলেও হতে পারে। তবে আবার বলছি, ফুটবলের কথা এখন ভাবা উচিত নয়।”
কিন্তু ফুটবল বন্ধ থাকলে কয়েক হাজার ফুটবলারও যে বিশ বাঁও জলে। অনেকেই উপার্জন করেন শুধুমাত্র ফুটবল খেলে। অনেকের চাকরির প্রশ্ন জড়িত থাকে। বাংলার হয়ে খেললে সরকারি চাকরির সুযোগ থাকে যেমন। আর্থিক ক্ষতির ফলে ফুটবল ছেড়ে অন্য দিকে ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কাও থাকছে। সংসার চালাতে হবে, বেঁচে থাকতে হবে যে। শুধু ফুটবলাররাই তো নন, রেফারিদের উপার্জনও ফুটবল লিগের সঙ্গে জড়িত। বল-বয়, স্ট্রেচার-বয়, আরও অনেকে— একটা বিশাল পরিকাঠামো মজুত থাকে ম্যাচের সঙ্গে। কিন্তু, এখন এই অবস্থায় সবটাই নড়বড়ে এবং দিশাহীন।
ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বা আইএফএ-র সচিব জয়দীপ মুখোপাধ্যায় বললেন, “এটা অজানা সঙ্কট। যা কবে মিটবে তা কারও জানা নেই। ২০ মে থেকে পঞ্চম ডিভিশনের খেলা শুরু হয়। কলকাতা লিগ (সিএফএল) অগস্টে চালু হয়। আশা করছি, এটা চালু করতে পারব। অন্তত, কোনও না কোনও রাস্তা বের হবে ঠিকই। আমাদের প্রধান চিন্তা প্রথম ডিভিশন থেকে পঞ্চম ডিভিশনের খেলা নিয়ে। এই ক্লাবের খেলাগুলো আমরা ময়দানে দিই। ৩০ সেপ্টেম্বরের পর ময়দান পনেরো দিনের জন্য চলে যায় সেনার হাতে। তার পর ক্রিকেটের জন্য পিচ তৈরি হয়। এই ক্লাবগুলোর পক্ষে দূরে গিয়ে খেলা আর্থিক কারণেই মুশকিল। ফলে, সমস্যা থাকছে। আসলে কোনও পরিকল্পনাই তো করতে পারা যাচ্ছে না এই পরিস্থিতিতে। ফলে, অসহায় লাগছে। তবে এ বার আমরা নতুন কিছু ভেনু পেয়েছি। ফলে, তাড়াতাড়ি খেলা শেষ করা যাবে। কিন্তু, ঝুঁকি নিয়ে তো আর ফুটবল শুরু করা সম্ভব নয়। মানুষের জীবন সবার আগে।”
আরও পড়ুন: নেতৃত্বে গম্ভীর, দেখে নিন নাইট রাইডার্সের সেরা আইপিএল একাদশ
ফুটবল চরিত্রগত ভাবেই এমন খেলা যেখানে শারীরিক দূরত্ব রাখা অসম্ভব। যখনই শুরু হোক, যত দেরিতেই ময়দানে শুরু হোক ফুটবল, ট্যাকল বা হেড করার সময় ফুটবলারদের মনের মধ্যে খচখচানি আসতেই পারে। যদি স্টেডিয়াম খালি রেখেও বড় দলের ম্যাচ হয়, তা হলেও তো মানসিক দ্বিধা আসতে পারে। প্রয়োজনে মনোবিদের সাহায্য নেওয়ার ভাবনা আসছে তাই। আইএফএ চাইছে সরকার থেকে শুরু করে লিগের সব ডিভিশনের সাব-কমিটি ও ক্লাবগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এগোতে। তবে পরের দিকে ট্রেডস কাপ ও আইএফএ শিল্ড হতেই পারে, কারণ তা সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে তা পরের কথা। সাম্প্রতিকতম খবর হল, ৮ মে আইএফএ-র যে বিশেষ সাধারণ সভা হওয়ার কথা ছিল, তা অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গিয়েছে।
অর্থাৎ, আশা, পরিকল্পনা, ভাবনা... এই শব্দগুলোই বড্ড ফিকে। করোনা এমনই চেপে ধরেছে মনের আনাচে-কানাচে যে সোজাসুজি সামনের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। পথের বাঁকে লুকিয়ে থাকছে অজানা ভয়। ধোঁয়াশা আর সংশয়ে মেশা সেই ধূসর ভবিষ্যতই জন্ম দিচ্ছে উদ্বেগ। কে জানে, কবে করোনা-আতঙ্ককে মাঠের বাইরে আছড়ে ফেলবে ক্রিকেট। ময়দান মেতে উঠবে বল-পায়ে বা ব্যাটে-বলে, প্রাণের আরামে!