ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি জ়ায়ের বোলসোনারো। ছবি: রয়টার্স।
কোপা আমেরিকা নিয়ে সারা বিশ্বের ফুটবল ভক্তদের মধ্যে উন্মাদনা শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ফুটবলের দেশ ব্রাজিলে এই প্রতিযোগিতা হওয়া নিয়ে সাম্বা উৎসব হচ্ছে না। বরং ফুটবল সম্রাট পেলের দেশে প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, কেন এমন আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে কোপা আয়োজনের ঝুঁকি নিজেদের ঘাড়ে নেওয়া হল?
উরুগুয়ে এবং আর্জেন্টিনায় কোপা আয়োজন নিয়ে সমস্যা দেখা দেওয়ায় একেবারে শেষ মুহূর্তে তা স্থানান্তরিত হয়েছে ব্রাজিলে। দক্ষিণ আমেরিকা ফুটবল সংস্থার (কনমেবল) প্রধান আলেসান্দ্রো দোমিনিগেস এই ঘোষণা করে ধন্যবাদ দেন ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি জ়ায়ের বোলসোনারোকে। কিন্তু কোপা আয়োজনে রাজি হওয়ায় রাষ্ট্রপতি এখন চাপে।
ব্রাজিলে এখনও প্রত্যেক দিন ৬০,০০০ করে মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। গত তিন মাসে শুধু স্বাস্থ্য কর্মীদের মধ্যেই মৃতের সংখ্যা দু’লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধ করা বা প্রতিষেধক দেওয়ার অভিযানে পুরোপুরি ব্যর্থ বোলসোনারোর সরকার। বহু মানুষ ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন সরকারের বিরুদ্ধে। কেউ কেউ তুলনা টেনে বলছেন, ‘‘যেন রোম পুড়ছে আর সম্রাট নিরো চান ফুটবল ম্যাচ দিয়ে উৎসব সারতে!’’ বিরোধীরা দাবি তুলেছেন, ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের প্রধানকে তলব করে প্রশ্ন করা হোক যে, দেশে করোনা নিয়ে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে কোপা আমেরিকা করার সম্মতি দিলেন কেন? মামলা গড়িয়েছে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, কোপা আয়োজনের বিশদ পরিকল্পনা জানাতে। কী ভাবে করোনা স্রোতের মধ্যে কোপা আমেরিকা করা সম্ভব, তা জানাতে হবে বোলসোনারো সরকারকে।
কোপা আমেরিকা ব্রাজিলে হবে ঘোষণা হওয়া মাত্র তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় সাধারণ মানুষের মধ্যেও। গণমাধ্যমে অনেকে একটি ছবি তৈরি করে দিতে থাকেন। কফিন লাথি মারছে ফুটবলের আদলে গোলাকৃতি ভাইরাসে। ফুটবল সংগঠকদের বিরুদ্ধে প্রচার চালু হয়েছে ‘কোভা-আমেরিকা’ নাম দিয়ে। পর্তুগিজ ভাষায় ‘কোভা’ শব্দের অর্থ কবর। দেশের প্রাক্তন এক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘ব্রাজিলের মানুষের জন্য প্রতিষেধকের চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে কফিন। এর মধ্যে ওরা কোপা আমেরিকা করছে। সাধারণ বু্দ্ধিটুকুও লোপ পেয়েছে।’’ ব্রাজিলে যে কোপা হবে, সেই ঘোষণার দু’দিন আগেই লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নেমে সরকার বিরোধী প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেন। প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলে দিচ্ছেন, ‘‘জীবনের বিরুদ্ধে গোল করতে যাচ্ছে ব্রাজিল। শুধু ভাইরাস এই প্রতিযোগিতা দেখে উৎসব করবে, আর কেউ নয়।’’
বোলসোনারো এমনিতেই নানা বিষয় নিয়ে কোণঠাসা। করোনা মোকাবিলায় কাঠগড়ায়, সঙ্গে দেশ জুড়ে বেকারত্ব এবং তীব্র আর্থিক সঙ্কট। তার মধ্যে বিরোধীদের হাতে অস্ত্র হিসেবে তুলে দিয়েছেন কোপা আমেরিকা। পরের নির্বাচন আর এক বছর দূরে। যদিও বোলসোনারো খুব উদ্বিগ্ন নন। তিনি বলে দিচ্ছেন, ‘‘অতিমারির শুরু থেকে বলে এসেছি, আমি এই মৃত্যু মিছিলে শোকাহত। কিন্তু আমাদের বাঁচতেও হবে।’’ তাঁর ক্যাবিনেট সদস্য বিবৃতি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, কোপা আমেরিকা ‘সুপারস্প্রেডার’ হয়ে উঠবে না। তাঁর দাবি, কোপায় প্রত্যেকটি দলকে বলে দেওয়া হয়েছে, ৬৫ জনের বেশি সদস্য রাখা যাবে না। খেলা হবে দর্শকহীন স্টেডিয়ামে। তাঁর কথায়, ‘‘ব্রাজিলে নিজেদের ঘরোয়া ফুটবল প্রতিযোগিতা তো চলছে। তা হলে কোপা আমেরিকা করা নিয়ে এত প্রশ্ন কেন?’’
প্রশ্ন তবু থেকেই যাচ্ছে। সব জায়গায় সব হাসপাতালে করোনা আক্রান্তদের ভিড়ে বেড ফাঁকা পাওয়া কঠিন। এখনও পর্যন্ত দেশের ১০.৫ শতাংশ মানুষকে প্রতিষেধক দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে জানাচ্ছে সে দেশের প্রথম সারির দৈনিক। বিশেষজ্ঞদের কথায়, ‘‘এ রকম একটা বিশাল মাপের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে গেলে প্রচুর কর্মীর দরকার হবে। তাতে সংক্রমণ ছড়ানোর আরও ভয় থাকছে।’’ তাঁদের আরও বড় উদ্বেগ, স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে সাধারণ মানুষের মধ্যে। মনে হতে পারে, কোপা হচ্ছে যখন, সব কিছু আবার আগের মতো ঠিক হয়ে গিয়েছে। এই কারণেই কোপা আমেরিকা আয়োজন করতে যাওয়াকে ‘আত্মঘাতী, দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত’ আখ্যা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ফুটবল যে দেশের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, সেখানে আজ
ফুটবলই কাঠগড়ায়!