(বাঁ দিকে) এটিকে-র চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য বিশ্বজিৎ সাহা। (ডান দিকে) তাঁর ফাস্ট ফুড সেন্টার। —নিজস্ব চিত্র।
প্রদীপের নীচেই যে অন্ধকার রয়েছে, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তিনি। চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য হয়েও বাস্তবের রুক্ষ জমিতে যে এ ভাবে আছড়ে পড়তে হবে, তা আগাম বুঝতে পারেননি একেবারেই।
ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে পিছন ফিরে তাকালে বিশ্বজিৎ সাহার এখন মনে হয় কেরিয়ারের সোনালি সময়ে শহরের ফ্র্যাঞ্চাইজি এটিকে থেকে কক্ষচ্যুত হয়ে পড়াতেই তাঁর সব স্বপ্নগুলো তালগোল পাকিয়ে গেল।
সবুজ-মেরুন বা লাল-সাদা জার্সি পরে সে সব দিনের কথা এখন তাঁর কাছে রূপকথার মতোই শোনায়। চেনা পরিচিতরা যখন তাঁকে বলেন, “তুইও তো খেলতিস”— তখন একসময়ের সাইড ব্যাকের বুকে তা যেন ঝড়ই তোলে।
আরও পড়ুন: ১১৭ দিন পর ফিরল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, উচ্ছ্বসিত ক্রিকেটমহল
ফুটবল ছেড়ে সম্পূর্ণ অন্য এক পেশায় এখন তিনি। বছর দু’য়েক আগে ফাস্ট ফুডের একটা দোকান খুলেছেন। কিন্তু লকডাউনে ফের ভাগ্য বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন তিনি। একসময়ে কলকাতা ময়দানের পরিচিত মুখ আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, ‘‘লকডাউনে সব সেক্টরেরই অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আমারও রোজগার প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে।’’
এটিকে-তে সতীর্থদের সঙ্গে বিশ্বজিৎ (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়)।
সবুজ ঘাসের মাঠই তো তাঁর আসল জায়গা। ফুটবলের মায়া কাটিয়ে ফাস্ট ফুড সেন্টারে কেন এটিকে-র চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য? বিশ্বজিৎ বলছিলেন, ‘‘আইএসএল-এর প্রথম বছর আমি এটিকে-র হয়ে খেলি। ২০১৪ সালে আইএসএল-এর প্রথম সংস্করণে আমরাই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। সেমিফাইনাল ও ফাইনাল বাদে সবক’টি ম্যাচই খেলেছিলাম। এটিকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে আমি স্পোর্টিং ক্লুব দ্য গোয়ায় লোনে খেলতে চলে যাই। আমার ম্যানেজার গোয়ায় এটিকে-র চুক্তিপত্র নিয়ে যায়। দু’বছরের চুক্তিতে আমি সইও করি। চুক্তিতে সই করে দিয়েছি বলেই অন্য ক্লাবের প্রস্তাব নিয়ে আমি আর ভাবনাচিন্তাই করিনি।’’
তখন নিয়ম ছিল, সব দল আগের বছরের ৬ জন করে ফুটবলারকে ধরে রাখতে পারবে। সেই ৬ জনের মধ্যে নাম ছিল এটিকে-র দু’নম্বর জার্সিধারীরও। দ্বিতীয় বছরের মরসুম শুরুর আগে তাঁর এজেন্ট জানান, চুক্তি বাতিল করে দিতে হবে। বিশ্বজিৎ বলছেন, ‘‘আমাকে সই করানোর পরেও কেন যে দলে রাখা হল না, সেটা কোনও দিন জানতে পারিনি।’’
কেন তাঁকে আর রাখল না এটিকে? সেই সময়ে এটিকে-র রিমোট কন্ট্রোল হাতে ছিল আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের হাতে। প্রথম বারেই দলকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন স্পেনীয় ‘জাদুকর’। গত মরসুমে দয়িত্বে ফিরে শহরের ফ্র্যাঞ্চাইজিকে ফের চ্যাম্পিয়ন করানো হাবাস প্রথমটায় তাঁর পুরনো ‘শিষ্য’কে চিনতেই পারেননি। তাঁর ছবি দেখে প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন হাবাস, ‘‘এটিকে-র কিট ম্যানেজার ছিল না ও?’’ এটিকে-তে বিশ্বজিৎ পরিচিত ছিলেন ‘সহা’ নামে।
হাবাস স্বয়ং তাঁকে সেই নামেই ডাকতেন। মাঝের কয়েক বছরে ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে হাবাসের স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিলেন বিশ্বজিৎ। স্পেনীয় কোচের ভুল ভাঙানো হলে, তিনি বলেন, ‘‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। টেকনিক্যালি ভাল প্লেয়ার ছিল। কিন্তু লড়াকু বলতে যা বোঝায়, সেটা ও ছিল না।’’
ময়দানে আবার প্রচলিত রয়েছে, এটিকে-র ‘ম্যাজিশিয়ান কোচ’ লড়াকু, হার না মানা মনোভাবের প্লেয়ারদেরই পছন্দ করেন। বিশ্বজিৎ কি জানেন তাঁর হাবাস-স্যরের এ হেন মনোভাবের কথা? মোহনবাগান-সালগাওকর খেলা ডিফেন্ডার বলছেন, ‘‘কী জানি! স্যর তো আমাকে পছন্দই করতেন বলে জানতাম। কিন্তু কেন যে আমাকে সরতে হল, তা বুঝলাম না।’’
২০০৭ ও ২০০৮ সালে কলকাতা লিগে জর্জ টেলিগ্রাফের হয়ে ভাল খেলে ২০০৯ সালে মোহনবাগানে সই করেন বিশ্বজিৎ। তখন বাগানের কোচ করিম বেনশরিফা। বাঙালি এই ফুটবলারকে বেশ পছন্দ করতেন মরোক্কান কোচ। সালগাওকরের কোচ হওয়ার পরে বিশ্বজিতকে গোয়ায় নিয়ে যান করিম। সেখানে এক মরসুম খেলার পর ফের সবুজ-মেরুন জার্সিতে ফেরেন বিশ্বজিৎ। সেখান থেকেই আইএসএল-এর বৃত্তে।
বিশ্বজিৎ সাহা।
এটিকে-র চুক্তি বাতিল হওয়ার পরে কখনও সাদার্ন সমিতি, কখনও তিন মাসের জন্য লোনে ইস্টবেঙ্গলের জার্সি পরেন। বিশ্বজিৎ বলছিলেন, ‘‘জীবন চালাতে গেলে টাকার দরকার। তাই এটিকে-র সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হওয়ার পরে বিভিন্ন ক্লাবে খেলেছি। ২০১৭-’১৮ মরসুমে মুম্বই সিটি এফসি-তে সই করি। কিন্তু চোট আঘাত নিয়ে ফিরতে হয়। কেরিয়ারের আসল সময়টা তো আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। খেলতেই পারলাম না। আর কী করেই বা বুঝব এটিকে-র হয়ে নিয়মিত খেলার পরেও আমাকে ছিটকে যেতে হবে।’’ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বিশ্বজিৎ।
মুম্বই সিটি থেকে চোট পেয়ে ফেরার পরেই পরিবারের পরামর্শে বাড়ির কাছে খুলে ফেলেন ফাস্ট ফুডের দোকান। জনা পাঁচেক কর্মী কাজ করেন তাঁর দোকানে। কিন্তু লকডাউনে তাঁর সেই ব্যবসাও এখন মন্দার মুখে। এক সময়ে যাঁরা ছিলেন তাঁর সতীর্থ, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। তাঁর ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা লোকমুখে অনেকে জানলেও, ফোন নম্বর নেই অনেকের কাছেই। অভিমানেই কি যোগাযোগ আর রাখেন না একসময়ের সতীর্থদের সঙ্গে? না কি বাস্তবের কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে ‘বন্ধুত্বের নেটওয়ার্ক’ও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে?
আরও পড়ুন: জার্সি ওড়াতে তোমরা সবাই, মায়াঙ্ককে বললেন সৌরভ
বিশ্বজিৎ বলছিলেন, ‘‘আসলে গত কয়েক বছরে এত বার আমার ফোন নম্বর বদলেছে যে, আমার এখনকার নম্বর অনেকেই জানে না।’’ ফুটবল জীবন যে শেষ হতে চলেছে, সেই দেওয়াললিখন আগেই পড়ে ফেলেছেন তিনি। প্র্যাকটিস করছেন এখনও। ভবিষ্যতে কোচিং করানোর ইচ্ছার কথা জানালেন। কিন্তু সে তো ভবিষ্যতের কথা! এই দারুণ কঠিন সময়ে বাস্তবের জমাটি আক্রমণকে কী ভাবে রুখে দেবেন? লড়াকু নন এই অপবাদে এক দিন তাঁকে ছিটকে যেতে হয়েছিল। আজকের এই কঠিন সময়ে লেফট ব্যাকের সম্বল সেই লড়াই।