সব সময় ভেবেছি আরও ভাল করা যায়

এক্সক্লুসিভ সচিন তেন্ডুলকর: দাদার চ্যালেঞ্জেই সিডনি টেস্টে কভার ড্রাইভ বন্ধ

অবসরের পরে এই প্রথম এত অন্তরঙ্গ, খোলামেলা ভঙ্গিতে সচিন তেন্ডুলকর। বান্দ্রায় নিজের বাড়িতে বসে আনন্দবাজারকে দেওয়া দেড় ঘণ্টার দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকারে মুখ খুললেন নানা বিষয় নিয়ে। যেন এক অনাবিষ্কৃত সচিন। সাক্ষাৎকারের আজ তৃতীয় পর্ব... 

Advertisement

সুমিত ঘোষ

মুম্বই শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৯ ০৪:২২
Share:

কিংবদন্তি: সেরা প্রতিভা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেও মানসিক শক্তি, সংযম, শৃঙ্খলা, ধৈর্যের পরীক্ষায় অটল থাকাই মন্ত্র ছিল সচিনের। ট্রু ব্লু

অস্ট্রেলিয়া গিয়ে প্রথম টেস্টেই আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের শিকার। তার পরে হতাশা। কী করে ঘুরে দাঁড়ালেন সিডনিতে? কে দিয়েছিল অমূল্য পরামর্শ? ওয়ান ডে ওপেনার হওয়ার নেপথ্য কাহিনি কী ছিল? কিংবদন্তির অবিশ্বাস্য জয়যাত্রায় পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অজানা, চাঞ্চল্যকর সেই সব কাহিনি। অবসরের পরে এই প্রথম এত অন্তরঙ্গ, খোলামেলা ভঙ্গিতে সচিন তেন্ডুলকর। বান্দ্রায় নিজের বাড়িতে বসে আনন্দবাজারকে দেওয়া দেড় ঘণ্টার দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকারে মুখ খুললেন নানা বিষয় নিয়ে। যেন এক অনাবিষ্কৃত সচিন। সাক্ষাৎকারের আজ তৃতীয় পর্ব...

Advertisement

প্রশ্ন: ওয়ার্নকে খেলা হল। আর ওয়ার্নের দেশে গিয়ে সেই টেস্ট। সিডনি টেস্ট। যেখানে একটাও শট কভার দিয়ে খেললেন না, তবু ডাবল সেঞ্চুরি করলেন। একটা প্রিয় অঞ্চল শটের তালিকা থেকে বাদ দিয়েও কী ভাবে এত রান করা সম্ভব?

সচিন: সেই সফরে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে আমার মনে হয়েছিল, ভাল ব্যাটে-বলে হচ্ছে। কিন্তু প্রথম টেস্টেই এমন একটা সিদ্ধান্ত পেলাম! আহা, তখন যদি ডিআরএস থাকত! বলটা স্টাম্পের অন্তত ছ’ইঞ্চি উপর দিয়ে যাচ্ছিল। তবু আমি আউট! ওই সিদ্ধান্তটা আমার উপরে খুব প্রভাব ফেলেছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, সিরিজের প্রথম টেস্টেই কিনা আমার কপালে একটা খারাপ সিদ্ধান্ত জুটতে হল! একটা সিদ্ধান্তই তো একটা টেস্টে ভাল কিছু করার স্বপ্ন শেষ করে দিতে পারে। আক্ষেপ করতে করতেই পরের টেস্টের জন্য এগিয়ে যেতে হবে। যা-ই হোক, এই যন্ত্রণার মধ্যেই আমি আবিষ্কার করলাম, ভাল খেলছি, কিন্তু শট নির্বাচন ঠিক হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ছিলাম। ব্যাটে-বলে ভালই হচ্ছিল, তবে আমি খুব তাড়াহুড়ো করে ফেলছিলাম। খুব দ্রুত গিয়ার পাল্টানোর চেষ্টা করছিলাম।

Advertisement

প্রশ্ন: কী ভাবে সেটা কাটালেন?

সচিন: সিডনি টেস্টের আগে দাদার (অজিত তেন্ডুলকর, কিশোর বয়স থেকেই যিনি ভাই সচিনের পথপ্রদর্শক) সঙ্গে কথা বললাম। ও আমাকে বলল, এর সঙ্গে টেকনিকের কোনও সম্পর্ক নেই। একমাত্র কারণ হচ্ছে শট নির্বাচন। বলল, কোনও বোলার আমার উইকেট নিচ্ছে না। আমি নিজেই উইকেট দিয়ে আসছি। যদি আমি কয়েকটা শট খেলার প্রবণতা বন্ধ করতে পারি, তা হলেই ফের রান আসবে। দাদার সঙ্গে কথা বলার পরেই নিজে শপথ নিলাম, আমি নিজে উইকেট দিয়ে আসব না। এর পরে যখন ব্যাট করতে ক্রিজে গেলাম, নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, কোন শটটা আমার উইকেট নিচ্ছে? কভার ড্রাইভ? আচ্ছা, আমি তা হলে কভার দিয়ে মারবই না। আমি কিন্তু ড্রেসিংরুম থেকে ভেবে আসিনি সে-দিন যে, অমুক শটটা খেলব না। একদম ক্রিজে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজে নিজেকে প্রশ্ন করে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম।

প্রশ্ন: অস্ট্রেলীয় বোলারেরা তো সেই একই ফাঁদ পেতে রেখেছিল?

সচিন: ওরা সেই আমার শরীর থেকে দূরে অফস্টাম্পের বাইরে বল করতে থাকল। মানে আমার জন্য টোপ। প্রলুব্ধ হয়ে মারতে যাব আর আগের মতো ফের আউট হব। তাই আমি নিজেকে বললাম, আজ তোমাকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। দেখো তো সেই পরীক্ষায় কে জেতে! ঠিক করলাম, স্কোরবোর্ডের দিকে তাকাব না আর ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে অন্যান্য জায়গা দিয়ে রান সংগ্রহ করতে থাকব। দু’ঘণ্টা ব্যাট করি কি পাঁচ ঘণ্টা, ওই বলটা আমি খেলব না। তার পরে দেখা যাক, কী হয়। পুরো টেস্টে আমি একটাও শট কভার দিয়ে মারিনি। তার পরেও সম্ভবত তিনশো রানের কাছাকাছি করেছিলাম ম্যাচে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে, আমার দাদা অজিত সেই টেস্টে একটা চ্যালেঞ্জ আমার দিকে ছুড়ে দিয়েছিল। আমি সেটা গ্রহণ করেছিলাম।

• ভারত প্রথম ইনিংসে ৭০৫-৭ (ডিক্লেয়ার্ড)। সচিন ন.আ ২৪১। দ্বিতীয় ইনিংসে ২১১-২ (ডিক্লেয়ার্ড)। সচিন ন. আ ৬০।
• অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস ৪৭৪ ও দ্বিতীয় ইনিংস ৩৫৭-৬

প্রশ্ন: জানতে ইচ্ছা করছে, এটাই কি আসলে সচিন তেন্ডুলকর? এই সংযম, এই শৃঙ্খলা, ধৈর্যের পরীক্ষায় অটল থাকা। বিস্ময়-বালক হিসেবে প্রবেশ করেও, সেরা প্রতিভা হয়েও আমাকে পরিশ্রম করে যেতে হবে, সাধনা করে যেতে হবে— এটাই কি আপনার বিরল সাফল্যের নেপথ্যে?

সচিন: দেখুন, খেলোয়াড়ের জীবনে সব চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে টিম স্কোরবোর্ড। তোমাকে দারুণ আগ্রাসী দেখাতে পারে। দারুণ আকর্ষক ব্যাটিং করছ বলে মনে হতে পারে। দিনের শেষে সেগুলো কোনও ব্যাপার নয়। ৩০, ৪০ রান করে চলে গেলে টিমের স্কোরবোর্ডের কোনও উপকার হবে না। প্রধান ব্যাটসম্যানদের এক জন হিসেবে আমার দায়িত্ব এই রানগুলোকে বড় স্কোরে পরিণত করা। আর সেখানেই খেলোয়াড়ের মানসিকতার ভূমিকা বড় হয়ে দাঁড়ায়। শুধু টেকনিকের দিকটা দেখলেই হবে না। নিজেকে প্রশ্ন করে যেতে হবে, মানসিক শক্তি আছে কি না? আমি যখনই এই প্রশ্নটা নিজেকে করেছি, একটাই উত্তর পেয়েছি। আমি আরও ভাল হতে পারি। যত দিন খেলেছি, মানসিক দিকটা আরও ভাল করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। আর সেখানেই অতিরিক্ত শৃঙ্খলা যোগ করার ব্যাপারটা চলে এসেছে। অনেক সময় নিজেকে বলতে হয়েছে, সহজাত প্রবণতার হাতে নিজেকে তুলে দিয়ো না। তাতে ঝুঁকি থেকে যাবে। টিমের তোমাকে দরকার। টপ গিয়ারে ওঠো আস্তে আস্তে। সিডনি ছিল সে-রকমই একটা টেস্ট। যেখানে থার্ড গিয়ারেই আমি নিজেকে রেখে দিচ্ছিলাম। টপ গিয়ারে উঠিনি। ওদের স্ট্র্যাটেজি ছিল, শরীরের বাইরে বাইরে বল করে আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবে। আমি কাউন্টার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে ফেলি, একটাও বল মারব না কভার দিয়ে। ওদের বাধ্য করি, আমার শরীরের মধ্যে বল করতে।

প্রশ্ন: ওয়ান ডে ওপেনার হিসেবে আপনার উত্থান বেশ নাটকীয়। কয়েক দিন আগে বলেছেন, রীতিমতো ভিক্ষা করতে হয়েছিল ওপেনারের জায়গা পাওয়ার জন্য। ঠিক কী ঘটেছিল?

সচিন: ওই কথাটা আমি মজা করেই বলেছিলাম। আসলে যখন জানতে পারলাম, চোট লাগার জন্য নভজ্যোত সিংহ সিধু খেলতে পারবে না, তখনই ব্যাপারটা মাথায় এসেছিল। আমি জানতাম, শুরুতে গিয়ে দ্রুত রান করতে পারব। তার আগে পর্যন্ত ওপেনারদের ভূমিকাটা অন্য রকম ছিল। শুরুর ওভারগুলো দেখে দেখে খেলে দিয়ে নতুন বলের পালিশটা তুলে দিতে হত। ক্রিজে ভালমতো জমে গিয়ে তার পরেই আক্রমণ করার ঝুঁকি নেওয়া হত। আমার মনে হয়েছিল, এটা পাল্টানো দরকার। শুরুতেই যদি শট খেলা যায়, তা হলে স্কোরটা বাড়িয়ে তোলা যেতে পারে। আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে, আমি এই ধরনের ব্যাটিং করতে পারব। সেই কারণে অধিনায়ক আজহার এবং ম্যানেজার অজিত ওয়াড়েকরের কাছে গিয়ে বলি, আমাকে ওপেন করতে দাও। একটা সুযোগই শুধু চাইছি। যদি ব্যর্থ হই, আর কখনও তোমাদের কাছে এসে ওপেন করার কথা বলব না। দু’জনে আমার কথা শুনেছিল। ওদের আমি মানাতে পেরেছিলাম।

প্রশ্ন: ওপেনার হিসেবে সেই প্রথম ম্যাচটায় কী রকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মাঠে গেলেন? জিজ্ঞেস করছি কারণ, ওই একটা ইনিংস ওয়ান ডে ক্রিকেটে ভারতীয় ওপেনারদের ভূমিকাটাই পাল্টে দিয়ে গেল। এর পর থেকে টেমপ্লেটই হয়ে গেল যে, শুরু থেকেই ঝড় তুলে দিতে হবে।

সচিন: না, মজার ব্যাপার হচ্ছে, হোটেল থেকে মাঠে যাওয়ার সময়েও আমার মাথায় কিছু ছিল না। কী করে থাকবে? তখন তো জানিই না যে, সিধু খেলবে না। মাঠে গিয়ে বোঝা গেল, সিধু পারবে না। তখনই প্রথম আমার মাথায় ব্যাপারটা এল। আর আমি তখন দলের সহ-অধিনায়ক। তাই প্রথম একাদশ বেছে নেওয়ার জন্য যে টিম মিটিং হয়, তাতে আমি ছিলাম। তখনই আমি আজহার আর ওয়াড়েকর স্যরকে বলি, আমাকে ওপেন করতে দাও। একটা সুযোগ দাও। আর কখনও বলব না। আমি ওদের প্ল্যানটাও বলি যে, ওপেন করতে গিয়ে আমি আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে চাই। শুরুতেই যাতে আমদের অনেকটা রান উঠে যায়।

প্রশ্ন: বিশ্বকাপকে কেরিয়ারের সব চেয়ে আলোকিত মুহূর্ত বলেছেন। যদি টেস্ট ক্রিকেটের স্মরণীয় মুহূর্ত বাছতে বলি, কোনটাকে বাছবেন?

সচিন: কঠিন প্রশ্ন। কোনও একটাকে বেছে নেওয়া সত্যিই কঠিন। তবে ২০০১-এ বিশ্বজয়ী সেই অস্ট্রেলিয়া টিমকে যে-ভাবে হারিয়ে আমরা সিরিজ জিতেছিলাম, সেটা খুব স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া এখানে খেলতে এসেছিল টানা ষোলোটা টেস্ট জিতে। মনে আছে, সিরিজ শুরুর আগে আমাকে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনারা কি এই অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারবেন? আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ পারব। শেষ পর্যন্ত চেন্নাইয়ে জিতে আমরা সেই সিরিজ জিতেছিলাম। তার আগে মহাকাব্যিক টেস্ট জিতি কলকাতায়। এই সিরিজটার কথা ভোলা যাবে না। টিম হিসেবে আমরা খুব ভাল খেলেছিলাম। খুব হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। আর নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, ওই সিরিজে হরভজন সিংহ ছিল সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি আর তার পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ছিলাম আমি (হাসি)। না, না, আমি রসিকতাই করছি। তবে দলগত সাফল্যের দারুণ একটা উদাহরণ ছিল সেই জয়। সেই কারণেই অত মধুর হয়ে আছে। আর একটা কারণ হচ্ছে, সেই অস্ট্রেলিয়া দলের শক্তি। বিশ্বের সর্বত্র গিয়ে সব টিমকে ওরা তখন দুরমুশ করছিল। তাদের হারানোটা বিশেষ প্রাপ্তি ছিল।

প্রশ্ন: এই সিরিজটাই কি সেই টিম ইন্ডিয়াকে তৈরি করে দিল?

সচিন: একটা বিশ্বাসের শুরু তো বটেই যে, আমরা সেরাদের হারাতে পারি। একটা নতুন টিম তৈরির লগ্নও যেন উপস্থিত হল। সেই সিরিজে আত্মপ্রকাশ করল হরভজন। আমি বলব, লক্ষ্মণকেও প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেল ওই সিরিজ। তার আগে খুব পাকাপোক্ত জায়গা ছিল না লক্ষ্মণের। এর পরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ওকে। এর পরে সহবাগ এল। শুরুতে সহবাগ, তিনে রাহুল, চারে আমি, পাঁচে সৌরভ, ছয়ে লক্ষ্মণ। এমন একটা ব্যাটিং বিভাগ দাঁড়িয়ে গেল, যা একসঙ্গে খেলে গিয়েছে বারো-তেরো বছরেরও বেশি। বোলিংয়ে জাহির এল, নেহরা এল। কিছু দিনের জন্য শ্রীনাথ ছিল। কুম্বলে সেই সিরিজটায় ছিল না চোটের জন্য, কিন্তু অবশ্যই অনেক দিন আমাদের সঙ্গে খেলেছে। আমার মনে হয়, সেই সময় আমাদের টিমে অনেক ম্যাচউইনার ছিল। একার হাতে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ম্যাচ নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখত অনেকে। একটা টিমের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে ভারসাম্যের উপর। আর ব্যাটিং-বোলিং মিলিয়ে আমাদের দলে সেটা ছিল। সময়ের সঙ্গে টিম অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকল। ওহো, সেই সিরিজটার বাইরে আরও একটা টেস্টের কথা মনে পড়ে গেল। হেডিংলে টেস্ট। ভিজে পিচে আমরা প্রথম ব্যাট করে ছ’শোর বেশি রান তুলেছিলাম। ইনিংসে জিতেছিলাম টেস্টটা। ভেরি স্পেশ্যাল ভিকট্রি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement