উদ্বোধনের প্রস্তুতি। রিওতে।
নারী-শরীরের সরব উদযাপন, না ভোগের রিপুকে পঞ্চমাঙ্কে পৌঁছে দেওয়ার ব্রাজিলীয় আকর্ষণের উপস্থাপনা!
শুক্রবার রাতে ঐতিহাসিক মারাকানা স্টেডিয়ামে রিও অলিম্পিক্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের যে আগাম নির্যাস চুঁইয়ে বেরোচ্ছে তাতে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, সাম্বার দেশে গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ শেষ পর্যন্ত ‘সেক্সি অলিম্পিক্স ওপেনিং’ আখ্যা পেয়ে যাবে কি না?
আথেন্সে অলিভ পাতার মুকুট দিয়ে যে টুনার্মেন্টের শুরু, প্রথম বার দক্ষিণ আমেরিকায় আসার পর তা কৌলীন্য হারিয়ে ফেলবে কি না, উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্নও।
কারণ, বিশ্বের সবথেকে দামি সুপারমডেল ব্রাজিলের জিসেল ক্যারোলিন বুন্দচেন ব্রাজিল মিডিয়ার কাছে ঘোষণা করে দিয়েছেন, অলিম্পিক্সের মঞ্চে নগ্ন হয়ে সাম্বা নাচতে তিনি তৈরি। ‘‘ব্রাজিলিয়ানদের কাছে সাম্বা ডান্স হল ঐতিহ্য। এ রকম একটি ঐতিহ্যের জন্য আমাকে যদি পোশাকহীন অবস্থায় পারফর্ম করতে হয় তা হলেও আমি করব। ব্রাজিল আমার জন্মভূমি। মডেলিংয়ের জন্য যদি নগ্ন হতে পারি, তা হলে দেশের জন্য হব না কেন?’’ ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনে একটি নগ্ন ফোটোশ্যুট করে তিনি দেখিয়েওছেন কী করতে চান ৫ অগস্ট রাতে। কী ভাবে মেলে ধরতে চান শরীরী হিল্লোল, আবেদন।
উদ্বোধনের মশাল জ্বালানোর সম্মান তিনিই পাচ্ছেন জানার পরেও বুড়ো বয়সে তিন নম্বর বিয়ে করে তীব্র সমালোচনার মুখে পেলে। ফুটবলসম্রাটের সমালোচনায় মুখর এখানে দেখলাম সাংবাদিকদের বাইরে অনেকেই। তাঁদের বক্তব্য, অন্তত এই সময়টায় পেলে বিয়েটা নাও করতে পারতেন। কিন্তু বিশ্ব মানচিত্রে ফুটবলের দেশের এক নম্বর আইকনকে তা সত্ত্বেও বঞ্চিত করা হচ্ছে না মশাল প্রজ্বলনের গৌরব থেকে। দেশে অনেক অলিম্পিক্স সোনাজয়ী। তবু হাঁটাচলার সমস্যায় ক্রমশ অশক্ত হয়ে পড়া পেলেই বিশ্বের পাঁচ মহাদেশ ঘুরে আসা মশাল নিয়ে উঠবেন, পূতাগ্নি জ্বালানোর মঞ্চে। অন্তত সে রকমই খবর। তবে স্পনসরদের চাপ আছে আবার পেলের উপর। শোনা যাচ্ছে, তাঁর নিজস্ব স্পনসরের সবুজ সঙ্কেত না এলে পেলে শেষ পর্যন্ত সরেও দাঁড়াতে পারেন।
পাশাপাশি আবার শোনা যাচ্ছিল, বাতিল করা হয়েছে মডেল-কন্যার আর্জি। অন্তত প্রকাশ্যে সেটাই জানাচ্ছেন সংগঠকরা। কিন্তু এখানে পৌঁছে শুনলাম এ সবই নাকি লোক দেখানো ‘বাতিল’। পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমের বিতর্ক থামানোর কৌশল। মারাকানায় সেনা-পুলিশের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় বুহস্পতিবার রাতে চলছিল শেষ প্রস্তুতি। কিছু ভাগ্যবান দর্শক আমন্ত্রণ পেয়ে গ্যালারিতে বসে দেখছেন সব কিছু। তবে ছবি তোলা যাবে না এই শর্তে। জানা গেল, যে একশোজন মেয়েকে সাম্বা নাচের জন্য বাছা হয়েছে এবং তাঁদের জন্য যে পোশাক তৈরি হয়েছে, তা পরলে নারী শরীরের আশি শতাংশ-ই দেখা যাবে। ‘‘আমরা এমন ভাবে পোশাক তৈরি করেছি যাতে শরীরের বেশির ভাগ অংশ-ই দেখা যায়। নগ্নতা হচ্ছে সাম্বার আকর্ষণ। এটাই ব্রাজিলের রীতি,’’ বলছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত এক সংগঠক। সাম্বা নাচের সঙ্গে গান গাইবেন এলজা সোরেস। যিনি প্রয়াত প্রবাদপ্রতিম ব্রাজিলীয় ফুটবলার গ্যারিঞ্চার এক সময়কার স্ত্রী।
সঙ্গে এটাও শোনা যাচ্ছে, নাচতে নাচতে বুন্দচেন তাঁর কস্টিউম নাকি সত্যিই খুলে ফেলবেন। তবে সেই কয়েক সেকেন্ডের নগ্নতা হবে আলোর ঝরনাতলায়। যৌনতার মায়াজাল ছড়ানোর সময় পোশাক হিসেবে থাকবে শুধু মায়াবী আলো। অবসর থেকে ফিরে এসে বুন্দচেন ফের পারফর্ম করবেন বিশ্ব-মঞ্চে। বিতর্কে না জড়ালে হয় না কি? তেত্রিশের বুনচেন আরও কী করবেন, তা নিয়ে এখানে জোর জল্পনা!
সুপারমডেল জিসেল।
ব্রাজিলের সময় শুক্রবার রাত আটটায় শুরু হবে একত্রিশতম অলিম্পিক্সের যাত্রা। ভারতীয় সময় তখন শনিবার ভোর সাড়ে চারটে। সংগঠকদের তরফ থেকে জানানো হচ্ছে, সৃষ্টি থেকে ব্রাজিলের বেড়ে ওঠা, ফুটবলের দেশের ঐতিহ্য— সব তুলে আনা হবে তিন ঘণ্টার প্যাকেজে। তার ভেতর অবশ্য অনেকটা সময় যাবে মার্চপাস্টে। ২০৬ দেশ, দশ হাজার ক্রীড়াবিদ! তবে কত জন সুপারস্টার থাকবেন মার্চপাস্টে তা নিয়ে কৌতূহল আছে। ভারতের পতাকা থাকবে অলিম্পিক্সের ইতিহাসে দেশের একমাত্র ব্যক্তিগত সোনাজয়ী অভিনব বিন্দ্রার হাতে। তবে সাইনা নেহওয়ালের মতো অনেকেই এখনও আসেননি। এ বারের মার্চপাস্টের সবথেকে বড় চমক মনে হয় কিংবদন্তি সাঁতারু মাইকেল ফেল্পসের যোগদান। কখনও মার্চপাস্টে অংশ না নিলেও এ বার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা বাহকের সম্মান পাচ্ছেন বাইশ অলিম্পিক্স পদকের মালিক।
এ দিকে, রিও পৌঁছে গেলেও গেমস ভিলেজে ঢুকতে পারেননি সচিন তেন্ডুলকর। শোনা যাচ্ছে আগামিকাল, উদ্বোধনের আগেও তাঁর ঢোকা মুশকিল।
বিশ্বখ্যাত পিয়ানোবাদক পাওলো জোবিমের তৈরি সঙ্গীতের মূর্চ্ছনার মধ্য দিয়ে মঞ্চে আসবেন ‘সেক্স বম্ব’ ব্রাজিল-কন্যা বুন্দচেন। বোসানোভা জ্যাজ গান, ‘দ্য গার্ল ফ্রম ইপানেমা’-র সঙ্গে নাচবেন তিনি। সঙ্গে একশো সঙ্গী। যাঁরা অনেকেই ব্রাজিলের উঠতি এবং পরিচিত মডেল। এই নাচের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে ‘ফিউচারিস্ট গেটওয়ে’-র সাম্বা থিম।
মিনিট টু মিনিট অনুষ্ঠানের বিবরণ পাওয়া যায়নি। অত্যন্ত গোপনীয় ভাবে তৈরি হচ্ছে সব কিছু। তবে শোনা যাচ্ছে, দেশে আর্থিক জরুরি অবস্থা জারি থাকায় উদ্বোধনী বাজেট কমানো হয়েছে অনেকটাই। লন্ডন অলিম্পিক্সের খরচের দশ শতাংশও খরচ করা হচ্ছে না এ বার। ‘‘আমাদের দেশে শিক্ষার জন্য ডলার দরকার,’’ বলছিলেন এক সংগঠক কর্তা। দেশের চার দিকে অলিম্পিক্স বিরোধী বিক্ষোভ চলছে, সংগঠকরা এ ছাড়া বলবেনই বা কী?
বেজিং এবং লন্ডনের পরম্পরা মেনে রিওর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বভারও তুলে দেওয়া হয়েছে সংগঠক দেশের সেরা সিনেমা পরিচালক ফার্নান্ডো মিরেলসের হাতে। ‘সিটি অব গড’ এবং ‘দ্য কনস্ট্যান্ট গার্ডেনার’ ছবির জন্য যিনি বিখ্যাত। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন আরও দু’জন পরিচালক যাঁরা লন্ডন অলিম্পিক্সের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন। প্রায় ছয় হাজার তরুণ-তরুণী অংশ নেবেন অলিম্পিক্সের ম্যাসকট ‘ভিনিশিয়াস’-কে (পর্তুগিজে যাকে বলা হচ্ছে ব্রাজিলের বিভিন্ন পশুর সমাহার) মাঠে ফুটিয়ে তুলতে।
শুধু লাস্য ঝরানো সাম্বা নয়, শেষ রিহার্সাল দেখে বের হয়ে আসা এক অতিথি দর্শকের মুখে শুনলাম, ব্রাজিলের সংস্কৃতি আর আধুনিকতা বোঝাতে এর চেয়ে ভাল অনুষ্ঠান নাকি হয় না। দাবি করছেন, এ দেশে দু’বছর আগের বিশ্বকাপের উদ্বোধন অনুষ্ঠান ম্লান হয়ে যাবে অলিম্পিক্সের বোধনে। ফুটবলের দেশে অলিম্পিক্সের আসর। তাই ফুটবলকে ব্রাত্য রাখা হচ্ছে না। একটা বারপোস্টও নাকি তৈরি হবে আলো আর মানুষের সাহায্যে মাঠের মাঝখানে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট থেকে ডেভিড বেকহ্যাম— অসংখ্য ভিভিআইপি থাকবেন মারাকানায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে আসা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিরাপত্তা দিতে রাতের ঘুম ছুটেছে ব্রাজিল সরকারের। তার উপর জঙ্গিহানার আশঙ্কা রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে তদন্তের আওতায় থাকা অপসৃত ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট বনাম দেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের সমর্থকদের বিক্ষোভ আর রেষারেষি। যা রাস্তায় নেমে এসেছে এখন। উদ্বোধনের দিনও বিক্ষোভ হবে বলে খবর।
ঐতিহাসিক মারাকানায় এর আগে নানা সময় ব্রাজিল কাঁটার মুকুট পরেছে। ’৫০-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে এই মাঠে হেরেছিল ব্রাজিলের সাদা জার্সি। স্টেডিয়াম নতুন করে তৈরির সময় বড় একটা অংশ ভেঙে মারা গিয়েছিলেন তিন জন শ্রমিক। আর গত ফুটবল বিশ্বকাপে তো এখান থেকেই কাপ নিয়ে গিয়েছিল জার্মানি। আবার পেলের এক হাজারতম গোল এই মাঠেই। কিন্তু ফুটবলসম্রাটও তো এখন বিতর্কে।
দেখার, অলিম্পিক্স উদ্বোধনের পর মারাকানায় ব্রাজিলের কী জোটে? ফুল, না কাঁটা!
ছবি: এএফপি এবং টুইটার।