ইডেনে গোলাপি বলের টেস্টে আমন্ত্রিত ছিলেন চান্দু বোর্দে। ফাইল চিত্র।
‘বলুন’। পরিষ্কার বাংলায় বললেন চান্দু বোর্দে। সদ্য গোলাপি বলের টেস্টে হাজির ছিলেন ইডেনে। সেই রেশ এখনও টাটকা। মুখে বাংলা শব্দ হয়ত সেই কারণেই। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯, এই ১১ বছরের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের পরও যুক্ত থেকেছেন ক্রিকেটের সঙ্গে। কখনও নির্বাচকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান, কখনও জাতীয় দলের ম্যানেজার। আর তাই ভাবনাচিন্তায় পুরনো হয়ে পড়েননি। এবং ৮৫ বছর বয়সেও রীতিমতো প্রাণবন্ত। অতীত আঁকড়ে নয়, অতীতকে সঙ্গে নিয়েই বর্তমানকে জড়িয়ে ধরেন। আনন্দবাজার ডিজিটালের সঙ্গে কথায় উঠে এল সেটাই।
ইডেনে দিনরাতের টেস্ট কেমন লাগল?
চান্দু বোর্দে: এটা টেস্ট ম্যাচকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস। এটা নিশ্চিত ভাবে ক্রিকেটপ্রেমীদের আকর্ষণ করবে। অফিসফেরত মানুষ মাঠে আসবেন। আমাদের চিরাচরিত লাল বলের টেস্টে এই আগ্রহটাই দেখা যাচ্ছে না। দুর্দান্ত এই টেস্ট আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি সৌরভকে। ও অসাধারণ পারফর্মার ছিল। এখন প্রশাসক হিসেবেও সেটাই করছে। ধন্যবাদ প্রাপ্য বাংলার দর্শকদেরও। টেস্ট দেখাতে এ ভাবে মাঠ ভরানো দারুণ ব্যাপার। এটা টেস্ট ক্রিকেটকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে দরকার ছিল। এর আগে টেস্ট দেখতে তো লোকই হচ্ছিল না!
কিন্তু খেলা তো আড়াই দিনও হল না!
চান্দু বোর্দে: কী করা যাবে। দুর্ভাগ্যের হল বাংলা ক্রিকেট দল (বাংলাদেশকে এ নামেই চিহ্নিত করলেন) প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল না। আর বিরাট কোহালির দল কী দাপটই না দেখাল। ভারতীয় দলের পারফরম্যান্স এক কথায় ব্রিলিয়ান্ট। বিশেষ করে দুই পেসার ইশান্ত শর্মা ও উমেশ যাদব গোলাপি বল যে ভাবে কাজে লাগাল, যে ভাবে সিম করাল, যে নিখুঁত লাইন-লেংথে বল করল, তা মন ভরিয়ে দিল। আমি নিশ্চিত, এই ভারতীয় দল বিশ্বের যে কোনও দলের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। চিন্তায় ফেলবে বিপক্ষকে।
আরও পড়ুন: ‘অতীতকে ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না’, গাওস্করের সুরেই আক্রমণাত্মক কারসন ঘাউড়ি
আরও পড়ুন: 'আগে ভারতকে দেখলেই বোঝা যেত চাপে রয়েছে, সৌরভ বদলে দিয়েছে ছবিটা'
তার মানে গোলাপি বলে টেস্টই ক্রিকেটের সনাতন ঘরানার ভবিষ্যৎ?
চান্দু বোর্দে: অন্তত দর্শককে মাঠে টেনে আনার দৃষ্টিকোণে তো বটেই। তবে আমাদের ঐতিহ্য হল স্পিন। সেটাতেই আমাদের শক্তি ছিল। ভারতকে বলা হত স্পিনের দেশ। কিন্তু গোলাপি বল পেসারদের পক্ষে সহায়ক। ইডেনে দেখলাম দারুণ সিম করছে। দুর্দান্ত সুইংও করছে। আমাদের টিমে পেসারদের উপর নির্ভরতা বাড়ছে। ফলে স্পিনারদের কাজটা কঠিন হয়ে উঠছে।
একফ্রেমে সচিন, কোহালি, শ্রীকান্ত, বিশ্বনাথ, দ্রাবিড়ের সঙ্গে বোর্দে। ইডেনে গোলাপি বলের টেস্টে। ছবি টুইটার থেকে নেওয়া।
গোলাপি বলে তো রিভার্স করানোও মুশকিল...
চান্দু বোর্দে: হ্যাঁ, সেটাও একটা দিক। তবে পেসাররা শুরুতে সুইং করাচ্ছে, সিম করাচ্ছে। আর তা অনেকটা করে হচ্ছে। ওদের সমস্যা হচ্ছে রিভার্স করানোয়। তুলনায় স্পিনারদের সমস্যা অনেক বেশি। প্রথমত, বল ধরতে সমস্যা। দ্বিতীয়ত, রাতের আলোয় এই সময় শিশির পড়া। লাল বলের ক্ষেত্রে সেলাই এমন থাকে, যাতে বল ধরতে সুবিধা হয় স্পিনারদের। কিন্তু গোলাপি বলে তা হচ্ছে না। তার উপর শিশিরের জন্য পিছলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে স্পিনারদের চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। নতুন কোনও না কোনও অস্ত্র বের করতেই হবে স্পিনারদের। না হলে অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখা মুশকিল। নিজে লেগস্পিন করতাম তো, তাই এটা আরও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
ভারতীয় ক্রিকেটমহল আবার অন্য একটা বিতর্কে উদ্বিগ্ন। বিরাট কোহালি ইডেনে জিতে উঠে বলেছেন যে, সৌরভের সময় থেকেই এই জয়যাত্রার শুরু। যা আবার মানতে পারছেন না সুনীল গাওস্কর। অতীতের সাফল্যকে অস্বীকার করা যায় না, পাল্টা বলেছেন তিনি। দীর্ঘদিন ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত আপনি। অনেক গৌরবের মুহূর্তের সাক্ষী। এই বিতর্কে কী মনে হচ্ছে?
চান্দু বোর্দে: আমি বলব, সৌরভেরটাও ছিল সোনার সময়। অনেক স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছে সেই যুগে। এটা ভুললে চলবে না যে ওদের পারফরম্যান্স অসাধারণ ছিল। সেই সময় আমি ছিলাম নির্বাচকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান। হ্যাঁ, বিরাটের দলের পারফরম্যান্সও দুর্দান্ত। এটা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। তবে আমি তুলনায় বিশ্বাস করি না। এটা ক্রিকেটের পক্ষেও ভাল নয়। আগের প্রজন্মও অসাধারণ খেলেছে, আর এখনকার প্রজন্ম সেই ধারাকেই বহন করে চলছে। যা ভারতীয় ক্রিকেটের পক্ষে ভাল লক্ষণ।
কিছুদিন আগেও প্রধান কোচ রবি শাস্ত্রী বলেছিলেন এটাই ভারতের সেরা সফরকারী দল। অ্যাওয়ে সিরিজে সাফল্যের নিরিখে এই মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
চান্দু বোর্দে: আমি সেই মন্তব্যে না ঢুকে বরং প্রশংসা করতে চাইব শাস্ত্রী আর ওর দলকে। সুন্দর ভাবে এই দল গড়ে তোলা হয়েছে। যা সাফল্য আনছে। আমি বরং চাইব, নিরন্তর উৎকর্ষের সন্ধানে যেন ওরা ব্যস্ত থাকে। কোথাও যদি দুর্বলতা থাকে, সেটা যেন দ্রুত মেরামত করে নেওয়া হয়। এই দলে যেটা সবচেয়ে বেশি আমাকে টানে, সেটা হল সম্মিলিত প্রচেষ্টা। বিরাট-শাস্ত্রী জুটি হিসেবে দলের প্রত্যেকের সেরাটা আদায় করে আনছে। একটা দল হিসেবে খেলছে ভারত। সেটাই সেরা প্রাপ্তি।
টেস্টে পাঁচ সেঞ্চুরি সহ তিন হাজারের বেশি রান রয়েছে বোর্দের। নিয়েছেন পঞ্চাশের বেশি উইকেটও। ফাইল চিত্র।
এই ভারতীয় দলের কাছে টেস্টে আপনার প্রত্যাশা কী? দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে টেস্ট সিরিজ জেতাকে কি ‘ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার’ বলবেন? কারণ, অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজ তো এই দলটা জিতে দেখিয়েছে।
চান্দু বোর্দে: তা হতেই পারে। কারণ, এই দলটার মাইন্ডসেট নজর কেড়ে নেওয়ার মতো। অতীতের ভারতীয় দলগুলোর চেয়ে এই দলটার মাইন্ডসেট একেবারে আলাদা।
ঠিক কী ভাবে?
চান্দু বোর্দে: দেখুন, আগে আমরা খুব সতর্ক ভাবে খেলতাম। শুরু করতাম সাবধানী ভঙ্গিতে। কখনও কখনও কুঁকড়ে থাকতাম চাপে। ধীরে ধীরে আমরা খোলস ছেড়ে বের হতাম। কিন্তু এই দলটা শুরু থেকেই ভয়ডরহীন মেজাজে খেলে। ওদের আত্মবিশ্বাসটা নজর কেড়েও নেয়। গোড়া থেকেই মারতে থাকে ওপেনাররা। সেই অ্যাপ্রোচটাই আগের দলগুলোর চেয়ে আলাদা। আগের দলগুলো ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বাড়াত। কিন্তু বিরাটরা তুঙ্গে থাকা আত্মবিশ্বাস নিয়েই ম্যাচে নামছে। ওরা সেটাকেই আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে মরিয়া।
আপনাদের সময়ের অ্যাপ্রোচ কেমন ছিল?
চান্দু বোর্দে: আমাদের সময়ও কি ইতিবাচক মানসিকতা ছিল না? না থাকলে পঙ্কজদা হেলমেট ছাড়াই ওয়েস্ট ইন্ডিজের রয় গিলক্রিস্টদের খেলতেন কী ভাবে? আমাদের সময় কোয়ালিটি ছিল। স্কিল ছিল। সেটার উপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে আমরা বড় রানের দিকে এগোতাম। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে আমরা প্রাথমিক ভাবে ঝুঁকে থাকতাম ডিফেন্সিভ মাইন্ডসেটের দিকে। তার পর আমরা ক্রমশ গড়ে তুলতাম ইনিংস। সেই ব্যাপারটা একেবারে চলে গিয়েছে। এখন শুরু থেকেই ব্যাটসম্যানরা ঝড় তুলছে। নির্ভীক মানসিকতায় নামছে ওপেনাররা। খোলা মনে খেলছে। তফাতটা এখানে। এই প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস ফ্যান্টাস্টিক। তা তারিফযোগ্য।
বিরাট কোহালির দলের মাইন্ডসেট অতীতের দলগুলোর চেয়ে আলাদা, মনে করছেন বোর্দে। ফাইল চিত্র।
অতীতে বিশ্বক্রিকেটের কোনও দলের এতটা আত্মবিশ্বাস চোখে পড়েছে? আপনি নিজে ৫৫ টেস্ট খেলেছেন। লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সেরা ফর্মের অস্ট্রেলিয়াকেও দেখেছেন। বিরাটদেরও কি ওই পর্যায়ে রাখা যায়?
চান্দু বোর্দে: আমাদের সময়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বা তার পরেও ওরা যা দাপট দেখিয়েছে, তার ছিটেফোঁটা কিন্তু এখন অবশিষ্ট নেই। একই ভাবে বিশ্বক্রিকেটে সব দলগুলো নিজেদের জায়গা ধরে রাখতে পারেনি। পঙ্কজদার কথা তো আগেই বলেছি। আমরা যখন ক্যারিবিয়ান পেসারদের সামলাতাম, তখন খেলাটাই যেন অন্যরকম ছিল। ওরা ছিল বিশ্বের এক নম্বর দল। কী ব্যাটিং ছিল ওদের। তখনকার ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াও ছিল শক্তিশালী। সেই সময়কার কিছু দলের পারফরম্যান্স এখন খারাপ হয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকাও তো আগের মতো নেই। পাকিস্তানও আগের তুলনায় শক্তি হারিয়েছে। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশও তাই। ফলে ভারতকে কড়া পরীক্ষায় ফেলার মতো দল খুব একটা বেশি নেই। এদের মধ্যে নিউজিল্যান্ড অবশ্য ভাল খেলছে এখন।
আমি বিশ্বক্রিকেটে এখনকার দলগুলোর কথা বলছি না। আগেকার অস্ট্রেলিয়া, আগেকার ওয়েস্ট ইন্ডিজের কথা বলছি। ধরুন লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা গ্রেগ চ্যাপেলের সময়ের অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মানসিকতার দিক দিয়ে কোহালিরা লড়তে পারতেন? মানে, যে দলগুলোকে বিশ্বের সেরা দল হিসেবে ধরা হয়, তাদের প্রেক্ষিতে কোথায় থাকবেন কোহালিরা?
চান্দু বোর্দে: তুলনা টানছি না। তবে এই ভারত ওই দলগুলোর সঙ্গে একই পর্যায়ে থাকবে। যদি এগিয়ে নাও রাখি, কোনও ভাবেই পিছিয়ে রাখা যাবে না। সাতের দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতোই এই দলটার পারফরম্যান্স, মাইন্ডসেট। অ্যাজ গুড অ্যাজ, ইফ নট বেটার দ্যান লয়েড’স টিম। ইয়েস, ইয়েস। আমাদের বোলিং দেখুন। ফিল্ডিংয়ে উন্নতিটাও লক্ষ্য করুন। তাই আমরা খুব উঁচু একটা বন্ধনীতেই পড়ছি। টপ দলগুলোর মধ্যে থাকছি। আমার মনে তো কোনও সংশয় নেই।
স্বর্ণযুগের ক্যারিবিয়ান পেস অ্যাটাক। বোর্দের বিশ্বাস, ইশান্তরা পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা ধরেন এই বোলিংয়ের সঙ্গে। ফাইল চিত্র।
অর্থাৎ, ভারতের এই দলকে বিশ্বের সর্বকালের সেরা টেস্ট দলগুলোর মধ্যে একটা বলাই যায়?
চান্দু বোর্দে: অফকোর্স। অফকোর্স। হোয়াই নট? অতীতের কিছু দল ছিল ভেরি গুড। আর আমাদের দলটাও ঠিক তাই। যদি না আরও ভাল বলি! বেটার যদি না-ও বলি, তবু বিশ্বের সর্বকালের সেরা টেস্ট টিমগুলোর সঙ্গে একই সারিতে থাকবেই বিরাটরা। এটাই আমার মূল্যায়ন।
ধরা যাক, একটা কাল্পনিক টেস্টে মুখোমুখি লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর বিরাটরা। ইশান্ত-উমেশরা কী পাল্লা দিতে পারবে ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারির সঙ্গে?
চান্দু বোর্দে: হ্যাঁ, সংশয়ের কোনও জায়গা নেই। আমাদের পেসারদের দারুণ কনফিডেন্ট এখন। আর ওদের সেই কোয়ালিটিও রয়েছে। কাউকে বল করতেই ভয় পায় না ওরা। যে কোনও ব্যাটসম্যানকে বল করতে ওরা প্রস্তুত। খুব উত্তেজক একটা ম্যাচ হত!
আরও পড়ুন: ঋষভের জন্য এ বার লক্ষ্মণের সতর্কবার্তা
আরও পড়ুন: অস্ট্রেলিয়ায় গোলাপি বলে টেস্ট খেলতে রাজি হবেন কোহালি, মনে করছেন এই প্রাক্তন ক্রিকেটার