মাত্র দু’মাসে দুই অধিনায়কের মহানাটকীয় পৃথিবী বদল

ধোনির গায়ে আজ ‘হোলির রং’, ক্লার্কের জন্য প্রায় কার্ফু

ঠিক নিরানব্বই দিন আগে এই মাঠেই লুটিয়ে পড়েছিল তাঁর প্রিয় বন্ধুর দেহ। ফিল হিউজ বাউন্সারের সেই ছোবলে পড়ে যাওয়ার পর কে ভেবেছিল তাঁর জীবনদীপই যে নিভে যাবে। এসসিজির মতো ক্রিকেট-সভ্যতার এমন গরীয়ান মাঠ তার ইতিহাসের মাঝে যে মৃত্যুও জড়িয়ে নিতে বাধ্য হবে! ঠিক তেমনই ভাবা যায়নি তাঁর প্রিয় হিউজের বধ্যভূমিতেই যে জীবনের এত বড় পরীক্ষা দিতে নামবেন স্বয়ং মাইকেল ক্লার্ক!

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

সিডনি শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৫ ০৩:০০
Share:

ঠিক নিরানব্বই দিন আগে এই মাঠেই লুটিয়ে পড়েছিল তাঁর প্রিয় বন্ধুর দেহ। ফিল হিউজ বাউন্সারের সেই ছোবলে পড়ে যাওয়ার পর কে ভেবেছিল তাঁর জীবনদীপই যে নিভে যাবে। এসসিজির মতো ক্রিকেট-সভ্যতার এমন গরীয়ান মাঠ তার ইতিহাসের মাঝে যে মৃত্যুও জড়িয়ে নিতে বাধ্য হবে!

Advertisement

ঠিক তেমনই ভাবা যায়নি তাঁর প্রিয় হিউজের বধ্যভূমিতেই যে জীবনের এত বড় পরীক্ষা দিতে নামবেন স্বয়ং মাইকেল ক্লার্ক! কে জানত মাত্র দু’মাসে তাঁর ভাগ্যলিপি এমন বদলে গিয়ে তাঁর ওপর বেসরকারি ১৪৪ ধারা জারি করে দেবে! এতটুকু আইনের বেচাল করেছ তো গেলে!

শনিবার বেশ রাতে সিডনি বিমানবন্দরে নেমে দেখলাম বিশ্বকাপ প্রচারজনিত পরিস্থিতির এখনও কোনও উন্নতি হয়নি। কাস্টমস পার করে বেরোতে না বেরোতেই একটা বড় বিলবোর্ড। কিন্তু সেটা কী করে সিডনি অপেরা হাউস সবচেয়ে ভাল ভাবে উপভোগ করতে হবে তার ওপর। কোনার একটা চলমান বিজ্ঞাপনে মাঝেমধ্যে ক্রিকেট আসছে ঠিকই, কিন্তু নেটওয়ার্ক এসেই চলে যাওয়ার মতো করে। এ বারে এ দেশে আরও একটা সমস্যা, পে টিভি ছাড়া অন্য দেশের ম্যাচ দেখা যাচ্ছে না। যেমন আজ দক্ষিণ আফ্রিকা-পাকিস্তান ম্যাচ পে টিভি ছাড়া দেখা গেল না। একমাত্র অস্ট্রেলিয়ায় বসে অস্ট্রেলিয়ার খেলা ফ্রিতে দেখে নেওয়া সম্ভব— চ্যানেল নাইনে। এ দেশে পে টিভি দেখার অনুপাত আমেরিকা-ইংল্যান্ডের তুলনায় অনেক কম। একে তো অনেক বেশি খরচ। তা ছাড়া গড়পড়তা অস্ট্রেলিয়ানের একটা মানসিকতা আছে, স্পোর্টস আমার জন্মগত অধিকার। ওটা দেখার জন্য বাড়তি ডলার খরচ করব কেন?

Advertisement

নিট ফল— ধোনির অপরাজিত ৪৫ বনেদি ক্রিকেটপ্রেমী অস্ট্রেলীয় অনেক কম দেখেছে। কিন্তু ক্লার্কের বিশ্বকাপ-পক্ষাঘাত সকলের চোখের সামনে আর তা আলোচিত হয়েই চলেছে! নেটে এক শ্বেতাঙ্গ অস্ট্রেলিয়ান লিখেছে— অস্ট্রেলিয়া ৫ ম্যাচ খেলে ফেলেছে। চার নম্বরে খেলা অধিনায়ক খেলেছেন কিনা ১৮ বল। জোক!

অস্ট্রেলীয় কাগজগুলো ছিঁড়ে ফেলা অব্যাহত রেখেছে তার দেশের অধিনায়ককে। বলছে মাত্র ৩৭ মিনিটের ব্যাটিং নিয়ে তিনি রবিবার এত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ খেলতে নামছেন! রাতে এসসিজিকে বাঁ দিকে রেখে হোটেল পৌঁছনোর সময় ভাবছিলাম এখন অন্ধকার হয়ে থাকা মাঠ কাল একটাই মানুষকে নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ আর তরোয়াল নিয়ে কাটতে চাওয়ায় মগ্ন থাকবে।

অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটমহলে তীব্র শিরশিরানি ছড়িয়ে গিয়েছে রবিবারের ম্যাচ ঘিরে। সঙ্গকারা-দিলশানরা যেমন ফর্মে ব্যাট করছেন এবং এ দেশে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তাঁদের যা রেকর্ড— ম্যাচ ঘুরে গেলে কী হবে ভাবতেই শিউরে উঠছে ক্রিকেট-সমাজ! তখন গ্রুপ ‘এ’-র তৃতীয় হয়ে যেতে পারে অস্ট্রেলিয়া। আর তা হলে তাদের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ পড়বে গ্রুপ ‘বি’ থেকে দ্বিতীয় হওয়ার তীব্র সম্ভাবনা দেখানো দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে।

ডে’ভিলিয়ার্সদের শনিবার ম্যাচ উত্তর ট্র্যাজিক সাংবাদিক সম্মেলন ইউ টিউবেই রয়েছে। কিন্তু তাতেও কিছু এসে যাচ্ছে না। পাকিস্তান যতই অঘটন ঘটাক, এই অস্ট্রেলিয়া শখ করে চাইছে না এত তাড়াতাড়ি ডে’ভিলিয়ার্স বা স্টেইনকে খেলতে! ভাবাই যায় না অস্ট্রেলিয়া এ ভাবে ভাবতে পারে! আসলে অধিনায়ক নিজেই নড়বড়ে! ক্রিকেটপ্রেমীরা তাই তাঁকে ক্রমাগত ব্যঙ্গ করেই চলেছে—ওহে মাইকেল তুমি কি অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহ্য ভুলে গেলে যে, অধিনায়কত্ব শুধু করলেই চলে না, প্রথমে দলে থাকার মতো যোগ্যতা থাকতে হয়। তোমার যা এখন নেই। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই বিশ্বকাপে অবিসংবাদী ফেভারিট ছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই দেশের ক্রিকেটমহলের অকল্পনীয় কাঁপুনি দেখে এক এক সময় মনে হচ্ছে, সিডনিতে কাল সঙ্গকারাদের হারানোর চেয়েও আসল লক্ষ্য যেন নক আউটের শুরুতেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে এড়ানো!

মাত্র ক’দিন আগেও এই শহরেই ধোনি আর ভারত সম্পর্কে কত তাচ্ছিল্য শুনেছি। আপাতত শুধু এই শহর কেন, গোটা মহাদেশই তার সুর বদলে ফেলেছে। পে টিভি ছাড়া ভারতের খেলা দেখার উপায় নেই বলে অনেকে ইউ টিউবে গিয়ে ম্যাচের আসল জায়গাগুলো দেখে নিচ্ছেন। শনিবার সিডনি-সহ অস্ট্রেলিয়ায় হোলি পালিত হল। পুজো যেমন উইকএন্ডে হয়, দোলও তাই! ডার্লিং হারবারে আসল হোলি উৎসবে নাচানাচি তো হবে আরও পরে। ২৯ মার্চ। মেলবোর্নে যে দিন কাপ ফাইনাল! শনিবার রাতেই অবশ্য সিডনি বিমানবন্দরে কপালে আবির নিয়ে ভারতীয় মুখ ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল। এ হেন অস্ট্রেলিয়ার দোলের উৎসবে গাইতে কলকাতা থেকে রূপঙ্কর এসেছেন। ক্যানবেরায় এ দিন অনুষ্ঠান করে রোববার বাঙালি গায়কের সিডনিতে হোলির শো। এ দিন মাঝরাত পেরিয়েও তো বাঙালি-অবাঙালি বাড়িটাড়িতে রং খেলা চলল।

এদের অনেকেরই মনের আবিরের রং এখন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। শুধু এদেরই বলছি কেন, সাড়ে চার মাস এ দেশে কাটানোর পর এই প্রথম অস্ট্রেলীয় কাগজগুলো ভারত অধিনায়ককে প্রশংসার কারণ খুঁজে পেয়েছে। কট্টর উপমহাদেশ এমনকী সচিন-বিরোধী হিসেবে পরিচিত ম্যালকম নক্স অবধি লিখে ফেলেছেন, টেস্ট সিরিজে ধোনি ঠিক মানসিক ভাবে গোছানো ছিল না। তাই তাড়াতাড়ি রিটায়ারও করে ফেলল। বিশ্বকাপে ও একেবারে অন্য মানুষ। সব দিক গুছিয়ে এসেছে।

কে বলবে মাত্র ক’দিন আগের ত্রিদেশীয় সিরিজের গড় দেখার পর একটা প্রশংসাসূচক কথাও কারও মুখে শোনা যায়নি। ধোনির গড় ছিল ২৩। কোহলি ৮। ধবন ১২। রোহিত ১৭। ধোনি ৪৫ করে ওয়াকায় ম্যাচ জেতানোর পর এত উচ্ছ্বাস। অথচ তার আগে বলা হচ্ছিল ওয়ান ডে ব্যাটিংটাই তিনি ভুলে গিয়েছেন। শেষ পঞ্চাশ আছে গত অক্টোবরে। বলা হচ্ছিল, এ বার সময় এসেছে যথেষ্ট উপযুক্ত এবং এই মুহূর্তে তাঁর চেয়ে বেশি যোগ্য কোহলিকে ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন্সিও ছেড়ে দেওয়ার।

পৃথিবী কেমন আশ্চর্য এত দ্রুত বদলায়! এখন ক্লার্ক শুনছেন আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে নিজে ব্যাট না করে ম্যাক্সওয়েলদের ছেড়ে দেওয়ায় তিনি নাকি টিমে কিছুটা সমর্থন ফিরে পেয়েছেন। যে টিমের অধিকাংশই এখন নাকি স্টিভ স্মিথের অধীনে খেলতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করছে।

এত নেতিবাচক কথা ক্লার্ক রোববারের সিডনি মহাযুদ্ধে নামার আগে শুনছেন যা হয়তো গোটা জীবনে শুনতে হয়নি। অজি নির্বাচকেরাও তাঁর সম্পর্কে প্রকাশ্যে বিরক্তি উগড়ে দিচ্ছেন। প্রিয় বন্ধুর বধ্যভূমিতে রোববার তিনি পা রাখার আগে আশ্চর্য কারও কেন মনে পড়ছে না, এই মাঠেই তাঁর ৩২৯ আছে!

বদলে যাওয়া পৃথিবী বোধহয় এতটাই নিষ্ঠুর হয়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement