কিংবদন্তি: ময়দানের সেই সোনার সময়। মাঠে নামছেন পিকে। —ফাইল চিত্র
এক বছর আগে ২০ মার্চ প্রদীপ কুমার (পিকে) বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছিলেন। ৩০ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন চুনী গোস্বামী। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ভারতীয় ফুটবলের দুই কিংবদন্তির প্রয়াণের যন্ত্রণা এখনও সামলে উঠতে পারিনি।
শনিবার সকাল থেকেই তাই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে। প্রদীপদার কথা খুব মনে পড়ছিল। আমার বাবা কালীপদ সমাজপতিও ফুটবলার ছিলেন। কলকাতা লিগের প্রথম ডিভিশনে কালীঘাট ক্লাবের উত্থানের নেপথ্যে অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। বাবা বলতেন, ‘‘প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৌড়নো, জায়গা নেওয়া, যে কোন পরিস্থিতিতে গোল করার ক্ষমতা— একবারে ইউরোপের ফুটবলারদের মতো।’’ বাবার কাছে গল্প শুনেই প্রদীপদার খেলা দেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।
১৯৫৬ সাল। আমার বয়স তখন ১৬। তৃতীয় ডিভিশনের ক্লাব ইয়ং বেঙ্গলে খেলি। মেলবোর্ন অলিম্পিক্সের আগে চিনের ফুটবল দল কলকাতায় তিনটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছিল। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ও আইএফএ একাদশের বিরুদ্ধে। প্রদীপদা ছিলেন আইএফএ দলে। ক্লাব থেকে টিকিট পেয়ে মাঠে গিয়েছিলাম আমি। তার আগে কখনও প্রদীপদার খেলা দেখিনি। প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। যেমন বলের উপরে নিয়ন্ত্রণ, তেমনই ভয়ঙ্কর গতি ও ডান পায়ে গোলার মতো শট নেওয়ার ক্ষমতা। সর্বক্ষণ ছটফট করতেন গোল করার জন্য। গোল না পেলেই অস্থির হয়ে উঠতেন। যার নেতিবাচক প্রভাব অনেক সময় তাঁর খেলায় পড়ত।
চিনের জাতীয় দলের বিরুদ্ধে প্রদীপদা যে গোলটি করেছিলেন, তা আজও চোখের সামনে ছবির মতো ভাসে। দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হওয়ার মিনিট দশেক পরে ডান প্রান্ত থেকে বল নিয়ে কাট করে ভিতরে ঢুকে বিপক্ষের দুই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোলার মতো শটে গোল করেন। চিন দলের গোলরক্ষক কার্যত নড়তেই পারেননি। ম্যাচটা আইএফএ একাদশ ৩-০ জিতেছিল। প্রদীপদার খেলার আরও একটা বিশেষত্ব হল, বল নিজের দখলে এমন ভাবে রাখতেন, যাতে যে কোনও মুহূর্তে বিপক্ষের গোলে শট মারতে পারেন। অর্জুনের মতোই লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা ছিল ওঁর। অনেকটা লাফিয়ে উঠে (স্পট জাম্প) হেড করার অসাধারণ দক্ষতাও ছিল।
প্রদীপদার সঙ্গে প্রথম খেলার সুযোগ পাই ১৯৫৯ সালে। আমি তখন এরিয়ানে। ইস্টার্ন রেলে খেলতেন প্রদীপদা। আগের বছর কলকাতা লিগে চ্যাম্পিয়ন দুর্ধর্ষ ইস্টার্ন রেলের বিরুদ্ধেই আমাদের প্রথম ম্যাচ। গোলশূন্য শেষ হয়েছিল খেলা। তখন মহমেডান মাঠে হাওড়া ইউনিয়ন ও এরিয়ান একটা তাঁবুই ব্যবহার করত। ম্যাচের পরে প্রদীপদা আমাকে বলেছিলেন, ‘‘অসাধারণ খেলেছো।’’ আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি। প্রদীপদার সঙ্গে একদলে খেলার সৌভাগ্য হয়েছিল জাতীয় দলে। যদিও খুব বেশি ম্যাচ একসঙ্গে খেলেনি।
কোচ হিসেবেও সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছিলেন প্রদীপদা। পরিশ্রম ও হাল-না-ছাড়া মানসিকতাই ওঁকে এই উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। ফুটবলারদের মধ্যে থেকে সেরাটা বার করে আনার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ওঁর। ভারতীয় ফুটবলে আধুনিক কোচিংয়ের রূপকার প্রদীপদাই।