বিরাট মন্ত্র: নিজের উপরে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলো

মেলবোর্নে জিতেই সিডনির ইতিহাসে চোখ কোহালির

প্রতিশ্রুতিমানদের হাতে সাফল্যের থিয়োরি হিসেবে তুলে দেওয়া যায়, এমন কিছু কোহালিয়ানার সন্ধান দ্রুত পাওয়া গেল। যেমন, জয় তাঁর কাছে নেশার মতো। বিশেষ করে বিদেশে যদি সিরিজ জিততে চাও, তা হলে সেটাকে নেশার মতো আঁকড়ে ধরো।

Advertisement

সুমিত ঘোষ 

মেলবোর্ন শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:০৮
Share:

জয়োল্লাস: মুঠোয় জয়। শূন্যে লাফ কোহালির। সঙ্গী রাহানে। গেটি ইমেজেস

ভারতীয় ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে খাবারের জায়গার দিকে যাচ্ছেন তিনি। ১৩৭ রানে জিতে সিরিজে ২-১ এগিয়ে যাওয়ার মহোৎসব চলছে গ্যালারিতে। বিরাট কোহালির কথাবার্তা শুনে কে বলবে, তিনি সদ্য মেলবোর্নে জিতে উঠেছেন! বরং তখনই মনে হচ্ছে, এই জয় অতীত হয়ে গিয়েছে এবং তিনি পৌঁছে গিয়েছেন, সিডনি হারবার ব্রিজে!

Advertisement

প্রতিশ্রুতিমানদের হাতে সাফল্যের থিয়োরি হিসেবে তুলে দেওয়া যায়, এমন কিছু কোহালিয়ানার সন্ধান দ্রুত পাওয়া গেল। যেমন, জয় তাঁর কাছে নেশার মতো। বিশেষ করে বিদেশে যদি সিরিজ জিততে চাও, তা হলে সেটাকে নেশার মতো আঁকড়ে ধরো। অন্যরা বলেন, চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে চাই। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জকে জড়িয়ে ধরতে চাই। আরও আছে। সাফল্য পেতে চাও? কোহালি মন্ত্র হচ্ছে— নিজের উপরে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলো। কখনও ফল আসবে, কখনও আসবে না। যখন আসবে না, তখন ঝড়-ঝাপ্টা সামলানোর জন্য তৈরি থাকো। কিন্তু ভুলেও নিজের বিশ্বাসকে বাইরের লোকের মন্তব্যে প্রভাবিত হতে দিও না। যে দিনই দেবে, নিজস্বতা হারাবে তুমি।

জীবনের চলার পথে তাঁর চূড়ান্ত বিচারক? মাঠের আম্পায়ার বা উপরের বক্সে বসে থাকা ম্যাচ রেফারি নন, তিনি আসলে ঈশ্বর। উপর থেকে সকলকে দেখছেন। আমাকে দেখছেন, বাকিদের দেখছেন। বিচারের বাণী ঠিক সময় মতো শুনিয়ে দেবেন। বিশ্বাস করেন, যেমন কর্ম তেমন ফল!

Advertisement

তাঁর কাছে ভাল নেতার ব্যাখ্যা? প্রথম শর্ত, দলকে কিছু করতে বলার আগে নিজে সেটা করে দেখাবেন। যিনি দুর্যোগের সামনে দলকে এগিয়ে দিয়ে নিজে পিছনের সিট নেবেন না, বরং সকলের আগে গিয়ে দাঁড়াবেন। বাইরের পৃথিবী যতই বিশ্বাস হারাক, সতীর্থদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিনি আউড়ে যাবেন, ‘‘ইয়েস, পারব। আমরাই পারব। আমরা এক নম্বর!’’

আরও পড়ুন: বিরাট জিত, ইতিহাসের মেলবোর্নে দর্পচূর্ণ অস্ট্রেলিয়ার

জিতে উঠেই দু’টো জরুরি বার্তা দিয়ে রাখলেন তিনি। এক) এই জয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। সত্তর বছর ধরে অস্ট্রেলিয়া সফর করছে ভারতীয় দল। আজ পর্যন্ত কোনও অধিনায়ক সিরিজ জিতে ফিরতে পারেননি। সিডনিতে তাই এই কাজ শেষ করার আছে তাঁর। ‘‘এই জয় আমাদের আরও উৎসাহিত করছে। আমরা এখানেই থামতে চাই না। সিডনিতে জিতে সিরিজ জয়ের কাজ সম্পূর্ণ করতে চাই,’’ বলে দিলেন তিনি।

দুই) কেরি ও’কিফকে জবাব দিতেও ভুললেন না ভারত অধিনায়ক। বলে দিলেন, ‘‘আমাদের দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট অসাধারণ। সেই কারণেই আমরা এখানে জিতেছি। আমাদের জয়ের জন্য কৃতিত্ব দিতে হবে দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকেই। সেখানে আমাদের ফাস্ট বোলারদের অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় আর সেটাই বোলারদের তৈরি করে দেয়।’’

অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন লেগস্পিনার কেরি ও’কিফকে নিয়ে ভারতীয়দের ক্ষোভ তুঙ্গে। একের পর এক আপত্তিজনক মন্তব্য করে চলেছেন তিনি। প্রথমে তিনি মায়াঙ্ক আগরওয়ালকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘‘রঞ্জি ট্রফিতে ক্যান্টিন স্টাফের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছে ও।’’ তাঁর পাশে তখন বসেছিলেন মার্ক ওয়। তিনিও হাসতে হাসতে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে থাকেন ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটকে নিয়ে। বলেন, ‘‘ভারতে পঞ্চাশ রান মানে আমাদের এখানে চল্লিশ।’’

আরও পড়ুন: মেলবোর্ন টেস্টে ভারতের ঐতিহাসিক জয়ের কারণ

ও’কিফের সেই কটাক্ষেরই জবাব এ দিন দিয়ে গেলেন কোহালি। যিনি বিদেশের মাটিতে অধিনায়ক হিসেবে ১১টি টেস্ট জিতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নজির স্পর্শ করলেন। শুধু তাই নয়। ভারতের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে একই বছরে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট জিতলেন তিনি।

এর আগে হেড কোচ রবি শাস্ত্রী অস্ট্রেলিয়ার সম্প্রচারকারী চ্যানেলের স্টু়ডিয়োতে বসে ও’কিফের মুখের উপরে যোগ্য জবাব দিয়ে এসেছেন। শাস্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘মায়াঙ্ক দারুণ খেলে তোমার জন্য একটা বার্তা দিয়েছে কেরি। যখন তুমি ক্যান্টিন খুলবে, ও এসে তোমার ক্যান্টিনের কফির গন্ধ নিতে চায়। দেখতে চায়, কোন কফিটা বেশি ভাল। তোমার ক্যান্টিনের না কি ওর দেশেরটা?’’

শাস্ত্রীর পাল্টা স্লেজিংয়ে সে দিন চুপ করে গিয়েছিলেন ও’কিফ। কিন্তু নতুন বিতর্ক বাধিয়েছেন আবার। কমেন্ট্রি করার সময়ে চেতেশ্বর পূজারা এবং রবীন্দ্র জাডেজার নাম ঠিক মতো উচ্চারণ করতে পারছিলেন না তিনি। কার্যত ভারতীয় পিতামাতাদের লক্ষ্য করে তিনি মন্তব্য করে বসেন, ‘‘চেতেশ্বর, জাডেজা... সন্তানদের এ রকম নামই বা রাখতে হয় কেন?’’

সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় এই মন্তব্যের। অবস্থা বেগতিক বুঝে সম্প্রচারকারী চ্যানেলের ওয়েবসাইটে ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের উদ্দেশে খোলা চিঠি লিখেছেন ও’কিফ। তাতে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, তিনি কখনওই ভারতীয় জনগণ বা প্রথাকে অপমান করার জন্য কিছু বলতে চাননি। দাবি করেছেন, কখনও ভারত সম্পর্কে কোনও বিদ্বেষ ছিল না তাঁর। ভারতীয় ধারাভাষ্যকার হর্ষ ভোগলের নাম করে বলেছেন, ‘‘হর্ষের সঙ্গে আমি অনেক দিন ধরে কাজ করছি। ও জানে, আমি ভারত-বিদ্বেষী নই।’’

কোহালি এই খোলা চিঠির কথা জানেন না। ম্যাচের শেষে তাঁকে আলাদা করে যখন পাওয়া গেল, তখনও ফলাফলের চেয়ে প্রক্রিয়ার উপর জোর দিয়ে চলেছেন তিনি। এখনও জোরালো ভাবে বিশ্বাস করেন, দক্ষিণ আফ্রিকাতে সিরিজ হেরে গেলেও জোহানেসবার্গের বিপজ্জনক পিচে টেস্ট জেতা তাঁর এই টিমকে শক্তিশালী করেছে। তেমনই ইংল্যান্ডে ০-২ পিছিয়ে পড়ার পরেও ট্রেন্ট ব্রিজে যে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তাঁরা, সেটা তাঁদের বিদেশের মাটিতে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। সাউদাম্পটনে জেতার মতো জমি তৈরি করেও যদি সেটা নিজেরা নষ্ট না করে দিতেন, তা হলে ইংল্যান্ডে হয়তো ১-৪ হেরে ফিরতে হত না। সাংবাদিক সম্মেলনে যে কারণে বলে এসেছেন, ‘‘খুব খুশি হলেও এই জয়ে আমরা অবাক হইনি। গত বারো মাসে আমরা যে মানসিকতা নিয়ে খেলেছি এবং যে রকম প্রতিভা আমাদের আছে, তাতে সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, এই ধরনের ফলাফল অর্জন করা সম্ভব।’’ সমালোচকদের কথা মাথায় রেখে যোগ করতে ভুললেন না, ‘‘সে যতই যা লেখা হোক না কেন।’’

শুনতে-শুনতে মনে হচ্ছিল, কোহালি এবং তাঁর দলকে বুঝতে গেলে পুরো ‘কনডাক্টেড টুর’ নিতে হবে। শুধু মেলবোর্নের ১৩৭ রানের জয় দেখে মন্তব্য করলে চলবে না। জোহানেসবার্গ মেরুদণ্ড দিয়েছিল, ট্রেন্ট ব্রিজ চোখ ফুটিয়েছিল, মেলবোর্ন হাঁটতে শেখাল। এ বার সিডনিতে দৌড়নোর পালা।

মাঠ থেকে বেরোনোর আগে এক খুদে ভক্তকে প্যাড উপহারও দিয়ে এলেন ভারত অধিনায়ক। বাচ্চাটি বায়না ধরে, একটা স্মারক দেওয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে ড্রেসিংরুম থেকে প্যাড জোড়া এনে খুদে ভক্তকে উপহার দেন। বৃষ্টি এবং মেঘলা পরিবেশ উপেক্ষা করে গ্যালারিতে হাজির ছিলেন অনেক ভারতীয়। জেতার পরে আধা ভিকট্রি ল্যাপও নিলেন। ঘুরে ঘুরে হাত নেড়ে, হাততালি দিয়ে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে গেলেন।

মাঠে যেমন অস্ট্রেলিয়াকে পর্যুদস্ত করল কোহালির দল, তেমনই গ্যালারিতেও ক্যাঙারুর দেশকে পাল্লা দিলেন তেরঙ্গা হাতে ভারতীয়রা। সকালে ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, শেন ওয়ার্নরা বার বার বলছিলেন, যত না অস্ট্রেলিয়ার পতাকা দেখা যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ভারতীয় উপস্থিতি। দু’দিন আগে গ্যালারির একাংশ থেকে ভারত অধিনায়ককে অপমান করেছিল অস্ট্রেলীয় জনতা। সেটার যোগ্য জবাব দিয়েই মাঠ ছাড়ল কোহালির দল।

খাবারের জায়গা থেকে বেরিয়ে ফের ড্রেসিংরুমে ফিরে যাবেন। সেখানে মেলবোর্ন জয়ের গ্রুপ ছবি নেওয়ার অপেক্ষায় দল। তাঁকে দেখতে পেয়ে গ্যালারি থেকে ঝুঁকে ভিতরের দিকে তাকিয়ে ভারতীয় ভক্তরা ফের জয়ধ্বনি দিতে শুরু করে দিলেন। ‘কিং কোহালি’ এবং ‘টিম ইন্ডিয়া’র নামে। সে দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে তাঁর ক্রিকেট সংসারে হারিয়ে গেলেন ভারত অধিনায়ক। নতুন বছরে সিডনি হারবার ব্রিজে বর্ষপূর্তির শোভা দেখে আবার ক্রিকেট ব্যাগ কাঁধে উদয় হবেন। সত্তর বছরে প্রথম বার অস্ট্রেলিয়া থেকে টেস্ট সিরিজ জিতে ফেরার স্বপ্ন পূরণ করার লক্ষ্য নিয়ে নেমে পড়বেন আবার! দেশের ক্রিকেট ভক্তদের সেরা নিউ ইয়ার গিফ্‌ট দিতে চান কিং কোহালি!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement