স্মৃতি: ফুটবলার জীবনে কান্নন। ফাইল চিত্র
ষাটের দশকের শেষ দিকে যাঁর খেলা দেখার আকর্ষণে নিয়মিত মোহনবাগান মাঠে যেতাম, সেই পুঙ্গব কান্ননের সঙ্গে যে কোনও দিন খেলব, ভাবতেই পারিনি।
১৯৭৪ সালে মোহনবাগানে সই করার পরে দারুণ আনন্দ হচ্ছিল। এ বার কান্ননদার সঙ্গে খেলার স্বপ্ন পূরণ হবে। পাশাপাশি আশঙ্কাও ছিল। কান্ননদা সিনিয়র ভারতীয় দলে আগে খেলেছেন। পরে ডাক পান জুনিয়র জাতীয় দলে! অন্যরা জুনিয়র দল থেকে সুযোগ পায় সিনিয়র দলে। এত বড় এক জন ফুটবলার কি আমার মতো জুনিয়রকে গুরুত্ব দেবেন? মোহনবাগান তাঁবুতে প্রথম দিন পা দিয়েই আমার ধারণা বদলে গিয়েছিল।
কান্ননদার বিশেষত্ব ছিল, দু’পায়েই দুর্দান্ত ডজ ও শট ছিল। এই কারণেই ওঁকে এশিয়ার পেলে বলা হত। কান্ননদা ছিলেন যে কোনও ডিফেন্ডারের কাছে আতঙ্ক। আমি তখন বিএনআরে খেলতাম। কান্ননদা ছিলেন মোহনবাগানে। ওঁকে কী ভাবে আটকাব সেটা ভেবেই ম্যাচের আগের দিন ঘুম উড়ে যেত। একটা ভরসা ছিল অরুণদাও (অরুণ ঘোষ) তখন বিনিআর-এ খেলতেন। জানতাম, আমি ব্যর্থ হলে অরুণদা হয়তো সামলে নেবেন। সেই সঙ্গে মনে মনে কান্ননদাকে আটকানোর ছকও কষতাম। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম, কান্ননদা ধাক্কাধাক্কি পছন্দ করতেন না। তাই বল ধরলেই কান্ননদাকে ঘিরে ধরতাম কয়েক জন মিলে। এ ছাড়া ওঁকে আটকানো ছিল অসম্ভব। প্রচণ্ড গতিতে বল নিয়ে দৌড়তে পারতেন। বল ছাড়া ফুটবলটাও দুর্দান্ত খেলতেন। বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের মাঠের এক দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে সতীর্থদের খেলার জায়গা করে দিতেন।
রবিবার সন্ধ্যায় কান্ননদার প্রয়াণের খবরটা শোনার পর থেকে অনেক পুরনো স্মৃতি ভিড় করে আসছে। ইলিয়ট রোডে মোহনবাগানের মেসে কান্ননদাও থাকতেন আমাদের সঙ্গে। বেঙ্গালুরুতে জন্ম হলেও নিজেকে বাঙালি বলেই পরিচয় দিতেন। ফুটবল ছাড়ার পরেও বাংলা ছেড়ে যাননি।
মনে পড়ে যাচ্ছে ১৯৭৪ সালে ডুরান্ড কাপ সেমিফাইনালের সেই ঐতিহাসিক ম্যাচটাও। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে আমাদের সেমিফাইনালটা অবশ্য ছিল ১৯৭৫ সালের ৫ জানুয়ারি। এই ম্যাচটা আমাদের কাছে ছিল অগ্নিপরীক্ষার। কারণ, টানা পাঁচ বছর মোহনবাগান হারাতে পারেনি ইস্টবেঙ্গলকে। সে বছরও দুর্ধর্ষ দল ওদের। মহম্মদ হাবিব, মহম্মদ আকবর, সুভাষ ভৌমিক, সমরেশ চৌধুরী থেকে গৌতম সরকার—ইস্টবেঙ্গলে তখন নক্ষত্র সমাবেশ। সবাই ধরে নিয়েছিল, এ বারও মোহনবাগান হারবে। দলে আমরা যারা নতুন, স্বাভাবিক ভাবেই তারা ম্যাচের আগের দিন প্রচণ্ড চাপে ছিলাম। কান্ননদা আমাদের উজ্জীবিত করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ম্যাচ নিয়ে বেশি ভাবলে নিজেদের উপরেই চাপ বাড়বে। মনে রাখবে কোনও দলই অপরাজেয় নয়।
দিল্লির মাঠে সে দিন ফুল ফুটিয়েছিলেন কান্ননদাই। বলের উপরে দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণ ছিল ওঁর। তা ছাড়া আমাদের কোচ অরুণদা জানতেন, কান্ননদাকে স্বাভাবিক খেলা খেলতে দেবে না ইস্টবেঙ্গল। তাই সে দিন একটু পিছন থেকে খেলিয়েছিলেন ওঁকে। ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা সে দিন কান্ননদাকে ধরতে পারেনি। ২১ মিনিটে দুরন্ত শটে লাল-হলুদ রক্ষণে কান্ননদাই প্রথম ফাটল ধরিয়েছিলেন। জয়সূচক গোল অবশ্য করেছিল ওঁর রুমমেট উলগানাথন। ফাইনালে জেসিটির বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেছিল উলগা। আমরা মজা করে বলতাম, ‘‘খেলছে কান্নন, গোল করছে উলগা।’’
নিজেকে চাপমুক্ত রাখার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল কান্ননদার। কোনও কিছুতেই বিচলিত হতেন না। সেই কান্ননদাকেই দেখেছিলাম পঁচাত্তর সালে ইস্টবেঙ্গলের কাছে মোহনবাগানের পাঁচ গোলে হারের পরে কান্নায় ভেঙে পড়তে!