অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতে বাংলাদেশ দলের উল্লাস।—ছবি পিটিআই।
সকাল থেকেই অপেক্ষা। কাজ থাকলেও তা আটকে রাখা আগামিকালের জন্য। কারণ একটাই— মাঠে মুখোমুখি দুই প্রতিবেশী। দ্বৈরথ দক্ষিণ আফ্রিকায়, কিন্তু উত্তেজনায় ফুটছে গোটা বাংলাদেশ। শহর জুড়ে শীতের তীব্রতা কিছুটা এখনও রয়েছে। কিন্তু, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচের তাপে সেই শীত যেন কমে গিয়েছে বাংলাদেশে।
সকালে কিছুটা ভিড় থাকলেও দুপুরে ফাইনাল ম্যাচ শুরুর আগে থেকেই ঢাকার রাস্তাঘাট হঠাৎ করেই অনেকটা ফাঁকা হতে শুরু করে। সকলের চিন্তা, কী ভাবে আরও দ্রুত ঘরে ফেরা যায়। কারণ একটাই, এই প্রথম ইতিহাস ছুঁয়েছেন জুনিয়র টাইগাররা। পুরনো ঢাকা থেকে গুলশন অথবা বৌবাজার, সকলেই আজ খেলা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। অন্য, দিকে যাঁরা আটকে গিয়েছেন রাস্তায়, ফিরতে পারেননি গন্তব্যে, তাঁদের জটলা শহরের বিভিন্ন টেলিভিশন সেট বিক্রির দোকানের সামনে। কাচের ও পার এ পারে সমান উল্লাস আর স্নায়ুচাপ ভাগ করে নেওয়া। মানুষের জটলা হবে নাই বা কেন? সকলেরই এক কথা, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ বনাম ভারতের ফাইনাল ম্যাচ দেখতেই হবে।
কারওয়ান বাজারে এমন এক জটলায় মধ্যেই কথা হল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আনিসের সঙ্গে। তাঁর সটান যুক্তি, “ভাই, ঘরে পরে ফেরা যাবে। একটা বলও মিস করতে রাজি নই।” বাংলাদেশ শীর্ষ একটি টেলিভিশনের সংবাদকর্মী ইসমাইল হোসেইন জুয়েলের কাজের সময় শেষ হলেও নড়েননি অফিসের চেয়ার ছেড়ে। তাঁরও সটান কথা, “এখন পথে এক মিনিট কাটানো মানে একটা বল দেখা মিস করা। এই ব্যাট-বলের ইতিহাসের একটুও না দেখে থাকতে চাই না।” ম্যাচ শেষে চেয়ার ছাড়ার সময়ে তাঁর কথা, ‘টিমটা জুনিয়র, কিন্তু আসরটা তো বিশ্বকাপ। এই উচ্ছ্বাস বলে বোঝানো যাবে না। ঘরে বিশ্বকাপ এসেছে, তাকে বরণ করতে অফিসসের সহকর্মীদের সঙ্গেই ঐতিহাসিক আনন্দটা ভাগাভাগি করছি।”
বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী তানভিন সুইটি পুরো খেলাটাই দেখছিলেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। খেলার মাঝেই আনন্দবাজারের ফোনের জবাবে তিনি বললেন, “আমরাই জিতে যাব, আমাদের জয় নিশ্চিত। আমাদের এই বিজয়, আমাদের জন্য গৌরবের জয়। আমাদের জুনিয়র টাইগাররা বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন তাঁদের আগমনবার্তা। ওঁরা ভীষণ ভাল খেলেছে। আজ আমাদের গর্ব আর স্বপ্নজয়ের দিন।”
আরও পড়ুন: কাজে এল না বিষ্ণোইয়ের স্পেল, ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ
ঢাকা-সহ সারা দেশের চায়ের দোকানে বেড়েছে বিক্রিবাটার ধুম। দোকানের টেলিভিশন সেটে চলছে ব্যাট-বলের যুদ্ধ, আর আলোচনা-সমালোচনায় চায়ের কাপে উঠছে ঝড়। সে কারণেই শ্যামলী এলাকার চা দোকানি আকবর বললেন, “ আজ লাভলোকসানের হিসাব রাখছি না, বাংলাদেশ ভাল খেলছে, দেশ জিতলে সেটাই তো বড়, সবাই আমার এখানে খেলা দেখছেন। এতেই আমার আনন্দ।”
দেখুন ভিডিয়ো:
এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুড়েই ছিল উৎসবের আমেজ। বিশাল পর্দায় খেলা চলছে। সঙ্গে চলছে স্লোগান। সেই আনন্দ বাঁধ ভাঙল বিজয়ের মূহূর্তে। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখর তারুণ্যের চোখে এক ইতিহাস জয়ের আনন্দ। সেই আনন্দের বাঁধভাঙা জোয়ারে যোগ দিয়েছেন বয়স্ক নাগরিকেরাও।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের তরুণ টিমের ইতিহাস গড়ার দিনে তাদের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, “প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন এই খেলোয়াড়ি মনোভাব ধরে রেখে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ক্রিকেট আরও এগিয়ে যাবে।”
ঢাকা এখন আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের শহর। পাড়ার গলি থেকে শহরের প্রধান রাস্তাগুলোতে মানুষের বিজয় মিছিল। এমন মিছিলে হাঁটা এক তরুণ ঋদ্ধ অনিন্দ্য আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমরা জানান দিয়ে রাখলাম, ভবিষ্যতে বড়দের বিশ্বকাপও আমরা ঘরে আনবই। আর সেই দিন বেশি দূরে নেই।”
আরও পড়ুন: পাপার গোলে মিনার্ভাকে হারাল মোহনবাগান, লিগ টেবলে শীর্ষেই কিবুর ছেলেরা
এক দিকে শহর জুড়ে যখন উৎসবের আমেজ, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক দল তরুণের কণ্ঠে সমবেত সঙ্গীত— ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ/ খুশির হাওয়া ঐ উড়ছে/ বাংলার ঘরে ঘরে/ মুক্তির আলো ঐ ঝরছে’। এই গানটিই স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় মুহূর্তে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত শেষ গান। আজ বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর ছুঁতে চলেছে, তখন বিশ্বকাপ হাতে সে দেশের যুব নাগরিকের কণ্ঠে গানটি যেন এক নতুন মাত্রা পেল।