গর্জন: স্ট্রেট সেটে নাদালকে চূর্ণ করে জোকোভিচ। রবিবার। গেটি ইমেজেস
এ রকম একতরফা ফাইনাল বহুদিন দেখিনি! একটা গ্র্যান্ড স্ল্যামে দু’সপ্তাহ ধরে টেনিসের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লড়াই হয়। সেই পরীক্ষা টপকে শেষ রাউন্ডে মুখোমুখি দু’জন সেরা খেলোয়াড়ের দ্বৈরথের ফল কি না ৬-৩, ৬-২, ৬-৩!
নোভাক জোকোভিচের এই দুর্ধর্ষ দাপট দেখার পরে মনে পড়ে যাচ্ছিল আমাদের খেলোয়াড় জীবনে দেখা একটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালের কথা। ১৯৬২-র উইম্বলডন। রড লেভার ৬-২, ৬-২, ৬-১ উড়িয়ে দিয়েছিলেন সতীর্থ মার্টিন মুলিয়ানকে। সেই একই রকম আধিপত্য দেখালেন আজ জোকোভিচ, লেভারেরই নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে, তাঁরই উপস্থিতিতে!
মার্টিন মুলিয়ানের খেলোয়াড় জীবনে সেটাই গ্র্যান্ড স্ল্যাম সিঙ্গলসে সেরা ফল। এর পরে কোনও দিন আর গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালে উঠতে পারেননি। কিন্তু আজ জোকোভিচ যাঁকে হারালেন তিনি যে ১৭টা গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক! গোটা অস্ট্রেলীয় ওপেনে এ বার একটাও সেট হারাননি। টেনিস বিশ্বে বলা হয়, তাঁর কাছ থেকে একটা পয়েন্টও মাথার ঘাম পায়ে না ফেলে পাওয়া যায় না। সেই রাফায়েল নাদালকেই তিনটে সেটে দাঁত ফোটানোর সুযোগ না দেওয়ার অসম্ভব কাজটা করে দেখালেন জোকোভিচ। জানি না একে কী ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়!
অনেকে ভেবেছিলেন নোভাক-নাদালের ফাইনাল মানেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। সাত বছর আগের সেই প্রায় ছ’ঘণ্টার মহাকাব্যিক দ্বৈরথ না হোক পাঁচ সেটের ধুন্ধুমার ম্যাচ দেখতে পারবেন টেনিসপ্রেমীরা। কিন্তু কোথায় কী! দু’ঘণ্টাতেই খেল খতম!
আসলে খেলোয়াড়দের জীবনে এক একটা দিন এমন আসে, যেখানেই হাত ছোঁয়াবেন সোনা হয়ে যাবে। আজ মনে হয় জোকোভিচেরও সে রকম একটা দিন ছিল। তাই এত অনায়াসে রেকর্ড সাত নম্বর অস্ট্রেলীয় ওপেন খেতাব জিতে মোট গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের (১৫) দিক থেকে টপকে গেলেন পিট সাম্প্রাসকে (১৪)। শুধু তাই নয়, রয় এমার্সন আর রজার ফেডেরারের সর্বোচ্চ ছ’বার অস্ট্রেলীয় ওপেন জেতার রেকর্ড ভেঙে দিলেন।
আরও পড়ুন: ওসাকায় মুগ্ধ নাভ্রাতিলোভারাও
কে বলবে এই লোকটাই কনুইয়ে অস্ত্রোপচারের পরে এক বছর আগেই বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ১২ নম্বরে চলে গিয়েছিলেন। আর গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে পারবেন কি না আশঙ্কা ছিল! রবিবার কলকাতায় ডেভিস কাপ খেলতে ইটালি দলের সঙ্গে ওদের এক নম্বর খেলোয়াড় হিসেবে আসা মার্কো চেখিনাতোর কাছেই তো গত বার ফরাসি ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে হারেন জোকোভিচ। সেই ধাক্কা কাটিয়ে গত বার উইম্বলডনের প্রথম রাউন্ড থেকে শুরু করে রবিবার টানা ২১টা গ্র্যান্ড স্ল্যাম ম্যাচ জিতলেন। ভাবা যায়!
এ বার ম্যাচের প্রসঙ্গে আসি, নাদালকে হারাতে আমার মতে জোকোভিচ দুটো স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিলেন। প্রথম, যতটা সম্ভব বেস লাইনের কাছাকাছি শট রেখে নাদালকে চাপে রেখে দেওয়া। এই ধরনের শট ফেরানো খুব কঠিন। আনফোর্সড এররের (অনিচ্ছাকৃত ভুল) সম্ভাবনা বাড়ে। যে ফাঁদে নাদালকে বারবার ফেলেছেন তিনি। জোকোভিচের ন’টি আনফোর্সড এরর-এর তুলনায় নাদালের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা হল ২৮। আর দ্বিতীয় স্ট্র্যাটেজি হল, নাদালের প্রিয় অস্ত্র অর্থাৎ টপস্পিন ফোরহ্যান্ডকে নির্বিষ করে দেওয়া। নাদালের ফোরহ্যান্ডের জোকোভিচ জবাব দেন সাধারণত ব্যাকহ্যান্ড ডাউন দ্য লাইন শটে। ওঁর সেরা শট। কিন্তু আজ দেখলাম অনায়াসে ব্যাকহ্যান্ড ক্রসকোর্ট উইনার মারছেন। নাদালের ওই টপস্পিন ফোরহ্যান্ডের জবাবে যেটা ভীষণ ঝুঁকির শট। কিন্তু জোকোভিচ একেবারে নিখুঁত ভাবে ইচ্ছেমতো উইনার মেরে নাদালের যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছেন। তাই গোটা ম্যাচে জোকোভিচের ৩৪টা উইনারের তুলনায় নাদালের উইনার দেখা যাচ্ছে অনেকটাই কম, ২১টা। নাদালের পরিকল্পনা ওখানেই গোলমাল হয়ে যায়। জোকোভিচকে থামাতে কোর্টের কোথায় বল রাখবেন বুঝতে পারছিলেন না তিনি। তাই বেপরোয়া হয়ে জোকোভিচের বেসলাইনে আক্রমণ করতে গিয়ে আরও বেশি ভুল করে বসছিলেন।
২০১৫-’১৬ মরসুমে জোকোভিচ উইম্বলডন থেকে শুরু করে টানা চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছিলেন। যাকে বলা হয় ‘নোভাক-স্ল্যাম’। আসন্ন ফরাসি ওপেনে দ্বিতীয় ‘নোভাক-স্ল্যাম’ কিন্তু দেখতে পাচ্ছি আমি। রবিবারই ফের গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের হ্যাটট্রিক করে ফেললেন সার্বিয়ান মহাতারকা। এর পরে বছরের দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম অর্থাৎ ফরাসি ওপেনে যদি নাদালকে কেউ হারাতে পারেন, তিনি এই জোকোভিচই। তবে এক নম্বর জায়গা ধরে রাখাটা কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর চেয়েও কঠিন।
লেভারেরই একটা বিখ্যাত উক্তি রয়েছে, ‘‘যখন তুমি এগিয়ে, জানবে তখনই সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গায় আছ। কখনও ঢিলেমি দিয়ো না।’’
জোকোভিচ নিশ্চয়ই উক্তিটা জানেন!